বঙ্গোপসাগর বিশ্বের সবচেয়ে ঘূর্ণিঝড়প্রবণ অঞ্চলের একটি, এবং এর ইতিহাস বহু শতাব্দী ধরে অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাক্ষী। তবে খ্রিস্টাব্দ ৭৭৩ সালের ঘূর্ণিঝড়কে ইতিহাসবিদরা শুধু এক বিপর্যয় নয়, বরং মধ্যযুগীয় উপকূলীয় সভ্যতার ধারা বদলে দেওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আরব ও চীনা সমুদ্রযাত্রীদের নৌ-দলিল, উপকূলীয় লোককথা, এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মিলিয়ে এই ঘূর্ণিঝড়ের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়।
জলবায়ু ও মৌসুমি প্রেক্ষাপট
৭৭৩ সালের সেই সময়টি ছিল বর্ষা-পরবর্তী মৌসুমের সূচনা। গ্রীষ্মকালে বঙ্গোপসাগরের পানি ছিল অস্বাভাবিক উষ্ণ, যার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে একটি নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। এই নিম্নচাপ দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে এক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। তৎকালীন আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ বা সতর্কবার্তা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা না থাকায়, উপকূলবাসীরা ঘূর্ণিঝড়ের আগমনের বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলেন।
তৎকালীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা
বাংলা অঞ্চল তখন পাল সাম্রাজ্যের অধীনে, যা নৌ-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ ছিল। চট্টগ্রাম, সোনারগাঁও, তাম্রলিপ্ত ও উড়িষ্যার উপকূলীয় বন্দরগুলো ছিল আরব, চীনা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নাবিকদের নিয়মিত গন্তব্য। এই বন্দরগুলো থেকে রপ্তানি হতো চাল, নীল, তুলা, মসলা, ও লবণ, আর আমদানি হতো চীনামাটি, সিল্ক, ঘোড়া ও সুগন্ধি।
এমন সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত শুধু মানবজীবন নয়, বরং সমগ্র বাণিজ্যব্যবস্থাকেই বিপর্যস্ত করে দেয়।

আঘাতের স্থান ও ধ্বংসযজ্ঞ
ঐতিহাসিক দলিল ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়ের মূল আঘাত পড়ে—
সুন্দরবন ও বর্তমান খুলনা-বাগেরহাট এলাকা – বিশাল জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপ ও চরাঞ্চল সম্পূর্ণ ডুবে যায়, মিষ্টি পানির পুকুর ও কৃষিজমি নোনা জলে ভরে যায়।
চট্টগ্রাম উপকূল ও বন্দর – আরব নাবিক সুলাইমান আল-তাজিরের ভ্রমণ বিবরণে উল্লেখ আছে, বন্দরটি “জাহাজের কবরস্থানে” পরিণত হয়েছিল। শত শত কাঠের নৌকা ও জাহাজ ভেঙে তীরে ভেসে আসে।
উড়িষ্যা উপকূল – সমুদ্রের ঢেউ ২০–২৫ ফুট উচ্চতায় উঠে গ্রামগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নদীর মোহনা বদলে যায়, ফলে কিছু নদীপথ চিরতরে পরিবর্তিত হয়।
প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি
নথিপত্রের অভাবে সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও, অনুমান করা হয় কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারান। অসংখ্য গবাদিপশু মারা যায়, খাদ্যশস্য ধ্বংস হয়। বন্দরগুলোর মালপত্র, কাঠের গুদামঘর, নৌকা ও জাহাজের বিশাল ক্ষতি হয়।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে:
- খাদ্যসংকট– ফসলি জমি নোনা জলে ডুবে থাকায় কয়েক বছর ধরে উৎপাদন কমে যায়।
- বাণিজ্যপথের পরিবর্তন– অনেক বন্দর অকার্যকর হয়ে পড়ায় নাবিকরা বিকল্প পথে যাতায়াত শুরু করেন।
- জনবসতির স্থানান্তর– বিপর্যস্ত গ্রামগুলোর মানুষ অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে চলে যান।
আরব ও চীনা নাবিকদের বিবরণ
- আরব বণিকদের দলিল– “আল-মাসালিক ওয়াল মামালিক” (ভ্রমণপথ ও রাজ্যসমূহ) নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে, বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি ‘কালো ঝড়’ সমুদ্র ও আকাশের সীমারেখা মুছে দেয় এবং অল্প কয়েক ঘণ্টায় পুরো উপকূল ধ্বংস করে ফেলে।
- চীনা ভ্রমণলিপি– টাং রাজবংশের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু ই-চিং তাঁর নৌযাত্রার বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন, বঙ্গোপসাগরে হঠাৎ এক মহা-বায়ুঝড়ে বহু জাহাজ ডুবে যায় এবং কয়েকটি মাত্র সিল্কবাহী জাহাজ কোনো রকমে তীরে পৌঁছায়।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে উপকূলীয় সমাজে বেশ কিছু স্থায়ী পরিবর্তন আসে:
- উপকূলীয় স্থাপনায় কাঠের বদলে মজবুত ইট-গাঁথুনি ব্যবহার শুরু হয়।
- ধর্মীয় স্থাপনা ও বৌদ্ধবিহার পুনর্নির্মাণের সময় সমুদ্রজলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উঁচু ভিত্তি তৈরি করা হয়।
- লোককথা ও গানগুলোতে‘সাত শত তিয়াত্তরের কালো ঝড়’ একটি ভয়ের প্রতীক হিসেবে স্থান পায়।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
ঘূর্ণিঝড়ের পরে কয়েক দশক ধরে ওই অঞ্চলের অর্থনীতি দুর্বল ছিল। অনেক বন্দর আর কখনও পূর্বের মতো প্রাণ ফিরে পায়নি। এই বিপর্যয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সতর্ক করে দিয়েছিল যে, বঙ্গোপসাগরের বুকে সভ্যতা গড়া মানেই প্রকৃতির সঙ্গে এক অবিরাম সংগ্রাম।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















