“যে হলটায় আমরা শোলে দেখতে গিয়েছিলাম, তার পর্দাটা এতটাই বড় ছিল যে ডান দিক থেকে বাঁদিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সিনেমা দেখতে হত।”
এই কাহিনীটা আমাকে বলেছিলেন নেপালের নামজাদা চলচ্চিত্র সমালোচক বিজয়রত্ন তুলাধর। শোলের বিরাট বড় ফ্যান তিনি।
মি. তুলাধরের এখনো মনে আছে যে, তার ছোটবেলার বন্ধুরা বাসে চেপে প্রায় দুশো কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে নেপাল থেকে ভারতে এসে শোলে দেখে গিয়েছিল। আর ফিরে গিয়ে প্রচুর রঙচঙ চড়িয়ে সিনেমার গল্পটা বলেছিল।
ধর্মেন্দ্রর কোনও একটা মন্তব্যের জন্য নেপালে তার সিনেমা দেখানোর ওপরে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তাই শোলেও সেইসময়ে নেপালে দেখানো হত না।
তবে সিনেমাটার জাদু এমনই যে, ঠিক ৫০ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট মুক্তি পাওয়া শোলে নিয়ে নানা কাহিনী, অনেক স্মৃতি পাঁচ দশক পরেও মানুষের মনে গেঁথে আছে – আর শুধু ভারতে নয়, ভারতের বাইরে নানা দেশে।
আইকন হয়ে ওঠা খলনায়ক গব্বর সিং-য়ের নাম এখনও জনপ্রিয় – ভারত থেকে অনেক দূরে ইরানেও। সেখানে অবশ্য তার নামটা হয়ে গেছে ‘জব্বর সিং’।

জয়-ভিরু জুটি
ইরানে গোপনে ‘শোলে’ দেখতে হত
ভারতে শোলে মুক্তি পাওয়ার কয়েক বছর পরে ১৯৮০-র দশকে ইরান আর ইরাকের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল।
একটা অপরিচিত ভাষায় তৈরি একটা সিনেমা, তাও আবার যুদ্ধের সময়ে – তাই শোলের প্রতি অদম্য একটা আকর্ষণ ছিল কাতায়ূন কেজেলবাষের।
তিনি বলছিলেন, “সেটা যুদ্ধের সময়। বাড়িতে ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ার রাখা তখন ইরানে অপরাধ। কোনোভাবে খুব কষ্ট করে, গোপনে ভিডিও ক্যাসেট জোগাড় করতে হত। তারপর ঘর বন্ধ করে সিনেমা দেখতে দেখতে যেন হারিয়ে যেতাম আমরা। ওইসব সিনেমারই অন্যতম ছিল শোলে। জয় আর ভিরুর বন্ধুত্ব আর মজা আমাদের হৃদয় জয় করে নিয়েছিল।
“যখন বাসন্তী রঙিন পোশাক পরে, খালি পায়ে গব্বরের সামনে নাচ করে, সেটা দেখে আমিও ঘরের মধ্যেই একটা চক্কর নেচে নিতাম, যেন ক্যামেরায় আমার ছবি উঠছে। যুদ্ধের অনিশ্চয়তা আর আতঙ্কের মধ্যে আমাদের ছোটদের কাছে সেগুলোই ছিল ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্ত। আমার কাছে শোলে তো শুধু একটা সিনেমা নয় – ইরানে আমার ছোটবেলার একটা খুব দামী অংশ,” বলছিলেন কাতায়ূন কেজেলবাষ।

সিনেমাটির শুটিং হয়েছিল যে রামনগরম গ্রামে
গব্বরের সামনে বাসন্তীর সেই নাচ
খালি পায়ে গরম পাথর আর ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোর ওপরে হেমা মালিনীর নাচের দৃশ্য তো সবারই মনে আছে। ‘জব তক হ্যায় জান’ গানের সঙ্গে নাচের দৃশ্যের শুটিং করা হবে। সেটা ছিল গরমের সময় আর পাথর থেকে যেন আগুন বেরুচ্ছে। সেখানেই গব্বরের সামনে খালি পায়ে নাচতে হবে হেমা মালিনীকে।
আগুন-গরম পাথর থেকে তার পা বাঁচানোর জন্য প্যাড লাগানো হয়েছিল, কিন্তু সেই প্যাড পরে নাচতে অসুবিধা হচ্ছিল হেমা মালিনীর। তাই দৃশ্যায়নের বড় অংশে তিনি খালি পায়েই নেচেছিলেন।
একটি দৃশ্যে, যেখানে গব্বরের শাগরেদ সাম্বা একটা কাচের বোতল ভেঙ্গে ফেলে আর সেই ভাঙা কাচের টুকরোর ওপরেই হেমা মালিনীকে নাচতে হয়।
হেমা মালিনীর পায়ে কাঁচের টুকরো ফুটে গিয়েছিল, তবে সেই অবস্থাতেই তিনি শুটিং শেষ করেছিলেন।

‘কিতনে আদমী থে?’
ঢাকার শিশুদের নতুন ‘গব্বর-গব্বর’ খেলা
পড়শি দেশ বাংলাদেশেও অনেক শোলে-ভক্ত খুঁজে পাওয়া যাবে।
ঢাকার বাসিন্দা ফারজানা বারি রত্নার মনে আছে, “সেটা ১৯৯০এর দশক হবে। আমাদের ছোটবেলায় ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ারে আমরা শোলে দেখতাম। আমাদের ছোটদের কাছে খুব প্রিয় চরিত্র ছিল গব্বর সিং। আমাদের একটা খেলা খুব প্রিয় ছিল : শোলের দৃশ্যগুলো আমরা নিজেরা অভিনয় করে দেখাতাম আর একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করতাম ‘কিতনে আদমি থে’ – গব্বর সিংয়ের সেই বিখ্যাত ডায়ালগ। পরে যখন ডিশ টিভি এল, শোলের সেই গানটা বার বার বাজানো হত – ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে’ আর ওই হোলির গানটা,” বলছিলেন রত্না।
আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই তিনি গুনগুন করে গেয়ে উঠলেন শোলের আরেকটা বিখ্যাত হয়ে যাওয়া গান মেহবুবা ও মেহবুবা।
হেলেনের নৃত্য আর রাহুল দেব বর্মনের গলায় গাওয়া মেহবুবা ও মেহবুবা ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল। এই গানটির সুর অনেকটা গ্রিক গায়ক ডেমিস রুসোসের গাওয়া ‘সে ইউ লাভ মি’র সঙ্গে মিলে যায়। ওই গানটি শোলে মুক্তি পাওয়ার এক বছর আগে, ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। সেই গানটিতেও পুরনো লোকসঙ্গীতের সুরে গাওয়া হয়েছিল।
শোলে সিনেমাটি নিয়ে তার বইতে অনুপমা চোপড়া লিখেছেন, “এই গানটি সিনেমায় জোড়ার ব্যাপারে ছবিটির স্ক্রিপ্টলেখক জাভেদ আখতার প্রথমে একেবারেই রাজি ছিলেন না। তার মনে হয়েছিল যে গব্বর সিংয়ের মতো একজন দুর্ধর্ষ ডাকাত এরকম একটা গান দেখছে – এটা ঠিক মানাবে না। তবে গানটি শোনার পরে জাভেদের দারুণ লেগেছিল গানটা। তিনি পরামর্শ দেন যে ধর্মেন্দ্র আর হেমা মালিনী ওই গানের চিত্রায়ন করুন। তবে রমেশ সিপ্পি সহ অন্যদের মত ছিল যে ভিরু আর বাসন্তী এই গানটিতে ঠিক মানাবে না।”

বাসন্তীর চরিত্রে হেমা মালিনী
বাড়ি থেকে পালিয়ে ভারতে
নেপালের সিনিয়র সাংবাদিক বিজয়রত্ন তুলাধরের এখনও শোলে সিনেমার অনেক দৃশ্য মনে আছে।
তিনি বলছিলেন, “শোলে মুক্তি পাওয়ার পরে কাঠমান্ডুর অনেক ছেলে ভারতের বিহার রাজ্যের রক্সৌলে যেত শোলে দেখার জন্যই। আমার কয়েকজন বন্ধু তো বাড়ি থেকেই পালিয়ে গিয়েছিল। বহু কম বয়সী ছেলে বাবা-মায়ের পকেট থেকে পয়সা চুরি করে শোলে দেখেছিল।”

ডাকু গব্বর সিংয়ের দলের একটি দৃশ্য
পাকিস্তানে শোলের অডিও টেপ বিক্রি হত
মুক্তি পাওয়ার ঠিক ৪০ বছর পরে, ২০১৫ সালে পাকিস্তানে মুক্তি পায় শোলে। গব্বর, বাসন্তী, জয় আর ভিরুর ডায়লগগুলো সব মানুষ গড়গড় করে বলে যেতেন সিনেমা দেখতে দেখতেই।
শোলে সিনেমাটা পাকিস্তানে মুক্তি না পেলেও ১২০ মিনিট দীর্ঘ অডিও ক্যাসেট সেদেশে খুব বিক্রি হত।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে কোনও অতিথি এলে তারা শোলের অডিও ক্যাসেট নিয়ে আসতেন পাকিস্তানে আত্মীয়দের উপহার দেওয়ার জন্য। সেইভাবেই সব ডায়লগ মানুষের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
বিবিসি-র জন্য লেখা একটি নিবন্ধে এম ইলিয়াস খান এক পাকিস্তানী সাংবাদিক হামিদ ভুট্টোর বলা একটা কাহিনী জানিয়েছিলেন।
মি. ভুট্টোর কাহিনীটা এরকম: “এক বন্ধু আমাকে একটা গাড়ি কিনতে সাহায্য করেছিল। কয়েকদিন পরে সেই বন্ধু ফোন করে জানতে চায় যে আমার ‘ধান্নো’ কেমন চলছে?”
শোলে যে কয়েক প্রজন্মের মানুষের কাছে জনপ্রিয়, সেটা ওই একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়।

শোলের হিন্দি পোস্টার
আফ্রিকার মানুষেরও পছন্দ ছিল শোলে
একটা বিতর্ক সবসময়েই থেকেছে যে হলিউডের ছবি ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শোলে নির্মাণ করা হয়েছিল কী না।
ইউটিউবে দুটি ছবির তুলনা দেখে আফ্রিকার এক শোলে-ভক্ত তেমনটা মনে করেন না। তার কথায়, “হলিউডের ছবির তুলনায় আমরা, আফ্রিকার মানুষ শোলে বেশি পছন্দ করি কারণ ভারতীয় সংস্কৃতি আর প্রথাগুলোর সঙ্গে আমরা অনেকটাই নিজেদের মিল খুঁজে পাই। হলিউডের ছবির তুলনায় শোলে দেখে আমরা অনেক আবেগ-তাড়িত হয়ে পড়ি।”
শোলে সিনেমাটাতে আর কী ছিল যে কারণে ভাষা, দেশ, সংস্কৃতির সীমানা ছাড়িয়ে এত মানুষ ছবিটাকে ভালবেসেছিলেন?
ইরানের গণমাধ্যম ইতিহাসবিদ বেহরুজ তুরাণি ব্যাখ্যা করছিলেন, “১৯৮০র দশকে ইরানের সরকার গান গাওয়া বা নাচা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও শোলে চূড়ান্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ইরানে কারণ যেসব বিষয়গুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, ঠিক সেগুলোই ছিল শোলে-তে – রোমান্স, হিরোইজম, গান আর ওই যে ভারতীয় ছবির বাস্তবের থেকেও বড় করে দেখানোর কায়দা – ইরানিরা এই সব ব্যাপারগুলোই পছন্দ করেছিল।”

পাঁচ বছর ধরে সিনেমা হলে চলেছিল শোলে – মুম্বাইয়ের একটি হলের সামনে ভিড় – ফাইল ছবি
গোড়ায় ফ্লপ ছবি ছিল শোলে
ভারতীয় চলচ্চিত্রের সবথেকে বড় হিট ছবির অন্যতম শোলে কিন্তু মুক্তি পাওয়ার পরে প্রথম কয়েক সপ্তাহ ফ্লপ ছিল।
অনুপমা চোপড়ার বইতে ডেলোরেস পেরেইরা নামে ব্যাঙ্গালোরের এক নারীর কাহিনী আছে, যিনি টেরো কার্ড পড়ে ভবিষ্যতবাণী করতে পারতেন।
বইটিতে লেখা হয়েছে, “১৯৭৪ সালে তিনজন তার বাড়িতে গিয়েছিলেন – একজন একটু বেঁটে মতো – মাথায় হ্যাট পড়া সেই ব্যক্তি ফিল্ম ডিরেক্টর, একজন দাড়িওয়ালা মানুষ – যাকে দেখে মনে হয়েছিল যে অনেকদিন বোধহয় স্নান করেন নি (আমজাদ খান) এবং তার স্ত্রী। ওই অভিনেতার (আমজাদ খান) দিকে তাকিয়ে ডেলোরেস বলেছিলেন যে এই ভদ্রলোক শীর্ষে পৌঁছবেন এবং তার সিনেমা বহু বছর ধরে হলগুলিতে চলবে।”
ব্যাপারটা সবাই ভুলেই গিয়েছিল – কিন্তু ছবিটা মুক্তি পাওয়ার পরে গব্বর সিংয়ের ভূমিকায় অভিনয় করা আমজাদ খানকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেল আর সিনেমা হলগুলোতে পাঁচ বছর ধরে শোলে চলতে লাগল।
ঘটনাচক্রে গব্বর সিং নামে সত্যিই একজন ডাকাত ছিল ভারতে, যার বদনাম ছিল যে সে মানুষের নাক কেটে দিত।

রামনগরম -এখানেই শুটিং হয়েছিল শোলে ছবির
প্রথম দিনের শুটিং
ছবিটার শুটিং শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালের দোসরা অক্টোবর ব্যাঙ্গালোরের কাছে রামনগরম-এ। প্রথম দিনের শুটিং বৃষ্টিতে ভেস্তে গিয়েছিল।
পরের দিন, তিন তারিখ প্রথম যে দৃশ্যটার শুটিং করা হয়েছিল, সেটা ছিল অমিতাভ বচ্চন জয়া বচ্চনের হাতে চাবির গোছা তুলে দিচ্ছেন।
যেটা ছিল মাত্র চার লাইনের একটা ভাবনা, সেটাই হিন্দি সিনেমার খেলাটা চিরকালের মতো ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
বিবিসি নিউজ
বন্দনা ,সিনিয়র নিউজ এডিটর 



















