ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত। তবে সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠার কারণে ছোটবেলা থেকেই গান, নাচ ও অভিনয়ের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়। স্কুলজীবনে তিনি নাচ, চিত্রাঙ্কন ও সাহিত্যচর্চায় দক্ষতা দেখান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। এই ধারাবাহিক চর্চাই তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি তৈরি করে এবং তাঁকে অভিনয়ের পথে নিয়ে যায়।
অভিনয়ে প্রবেশের শুরু
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত প্রথমে টেলিভিশনের মাধ্যমে অভিনয় শুরু করেন। ধীরে ধীরে তাঁর প্রতিভা চলচ্চিত্রজগতের মানুষের নজরে আসে। ১৯৯২ সালে তিনি চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন এবং তাঁর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ছবি ছিল শ্বেতপাথরের থালা। এই ছবি তাঁকে চলচ্চিত্রে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এর পরবর্তী সময়ে তিনি বিভিন্ন ছবিতে কাজ করতে থাকেন। তবে তাঁর প্রকৃত পরিচিতি আসে ১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দহন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এই চলচ্চিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এরপর থেকে তিনি বাণিজ্যিক ও সমান্তরাল দুই ধারার চলচ্চিত্রেই নিজেকে প্রমাণ করে তোলেন। পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষসহ সমসাময়িক অনেক শিল্পী ও নির্মাতা তাঁর ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বিয়ে ও ব্যক্তিজীবন
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ১৯৯৯ সালে সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন। তাঁদের দুটি সন্তান রয়েছে। পারিবারিক দায়িত্ব সামলিয়েও তিনি ধারাবাহিকভাবে চলচ্চিত্রজগতে সক্রিয় থেকেছেন। পারিবারিক ও পেশাগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার এই ক্ষমতা তাঁকে অনন্য করে তুলেছে।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
অভিনয় জীবনে তিনি অসংখ্য সম্মাননা অর্জন করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (ভারত) – দহন (১৯৯৭)। এছাড়া তিনি ফিল্মফেয়ার ইস্ট অ্যাওয়ার্ডস, আনন্দলোক পুরস্কার, কালার্স বাংলা আইকনিক অ্যাওয়ার্ডসসহ আরও বহু স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি শুধু বাণিজ্যিক ছবিতে নয়, বরং সমান্তরাল ধারার চলচ্চিত্রেও তাঁর শক্তিশালী অভিনয়ের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।
বাংলাদেশে আগমন ও প্রথম ছবি
ঋতুপর্ণা প্রথমবার বাংলাদেশে আসেন ২০০০ সালের শেষ দিকে। সে সময় দুই বাংলার সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা তৈরি হচ্ছিল এবং তাঁর উপস্থিতি সেটিকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। তাঁর প্রথম বাংলাদেশি ছবি ছিল শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ (২০০১)। এই ছবিতে তিনি শাকিব খানের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন। ছবিটি মুক্তির পর ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং ঋতুপর্ণা বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এরপর তিনি একাধিক বাংলাদেশি ছবিতে অভিনয় করেন এবং ঢাকার দর্শক ও সমালোচকদের কাছে পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন।

বাংলাদেশে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র
বাংলাদেশে ঋতুপর্ণা যে চলচ্চিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ (২০০১), তোমার জন্য পাগল, মা মাতৃভূমি, দোস্ত দুশমন, মনের মানুষ, বিচার হবে, দাদি মা এবং চিরদিন তোমার আমার। প্রতিটি চলচ্চিত্রেই তিনি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে নিজের বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। এসব চলচ্চিত্র তাঁকে ঢালিউডে বিশেষ স্থান এনে দিয়েছে এবং তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকের কাছে অতি প্রিয় হয়ে ওঠেন।
দুই বাংলার সাংস্কৃতিক যোগাযোগ
ঋতুপর্ণার বাংলাদেশে আগমন শুধু একটি ব্যক্তিগত অভিনয় যাত্রা ছিল না, বরং এটি দুই বাংলার সাংস্কৃতিক বিনিময়ে নতুন মাত্রা আনে। কলকাতার শিল্পীরা ঢাকায় যেমন গ্রহণযোগ্যতা পান, তেমনি বাংলাদেশি শিল্পীরাও কলকাতায় কাজ করার সুযোগ পেতে শুরু করেন। যৌথ প্রযোজনা, চলচ্চিত্র উৎসব এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। দর্শকের চোখে ঋতুপর্ণা হয়ে ওঠেন দুই বাংলার একাত্মতার প্রতীক, যিনি সীমান্ত পেরিয়ে দুই বাংলার মানুষকে একসঙ্গে বেঁধেছিলেন।
বিদেশে অংশগ্রহণ
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত শুধু ভারত ও বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি বিদেশেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অংশ নিয়েছেন। সিঙ্গাপুর, লন্ডন, টরন্টোসহ বিশ্বের নানা শহরে তিনি চলচ্চিত্র উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
![]()
কেন তাঁকে আর বাংলাদেশে দেখা যায় না
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনা নিয়ে নীতিগত জটিলতা দেখা দেয়। সেন্সর বোর্ডের কড়াকড়ি এবং কোটা সমস্যার কারণে কলকাতার শিল্পীদের নিয়মিতভাবে বাংলাদেশে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তও ধীরে ধীরে ঢালিউড থেকে সরে যান এবং পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রজগতে নিজের মনোযোগ বাড়ান।
পশ্চিমবঙ্গে ক্যারিয়ার
বর্তমানে ঋতুপর্ণা পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ অভিনেত্রীদের একজন হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে দহন, উৎসব, চোখের বালি, পরমিতার একদিন, প্রাক্তন, বেলাশেষে এবং বেলাশুরু। প্রতিটি ছবিতে তিনি নিজস্ব অভিনয়শৈলী ও শক্তিশালী উপস্থিতির মাধ্যমে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। কিছু সমালোচক মনে করেন, ক্যারিয়ারের এক পর্যায়ে তিনি বাণিজ্যিক ছবিতে বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন। তবে পরবর্তী সময়ে সমান্তরাল ধারার চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি আবারও অভিনেত্রী হিসেবে নিজের প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন।

সাফল্য ও ব্যর্থতা
ঋতুপর্ণার সাফল্যের ঝুলিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ একাধিক সম্মাননা রয়েছে। তবে সব ছবিই যে বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়েছে তা নয়। তাঁর কিছু সিনেমা ব্যর্থও হয়েছে। কিন্তু অভিনয়শক্তি, বহুমুখী চরিত্রে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এবং দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তার কারণে তিনি আজও দুই বাংলার চলচ্চিত্র ইতিহাসে বিশেষ স্থান ধরে রেখেছেন।
সেরা চলচ্চিত্র
ভারতে তাঁর সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে ধরা হয় দহন এবং চোখের বালি। আর বাংলাদেশে তাঁর সেরা ও সর্বাধিক জনপ্রিয় ছবি হলো শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ। এই চলচ্চিত্র এখনো দর্শকদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















