সভ্যতার সংযোগস্থল
বঙ্গোপসাগর বহু শতাব্দী ধরে শুধু সাগরসীমা নয়, বরং বাণিজ্য, ধর্ম ও রাজনৈতিক ভাবধারার গতিশীল কেন্দ্র ছিল। এই আন্তঃসংযোগের কেন্দ্রস্থলে ছিল আরাকান (বর্তমান রাখাইন রাজ্য)। ধন্যবতী, ভেসালী ও পরবর্তীতে ম্রাউক-ইউ নগরীগুলো ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইসলামি বিশ্বের প্রভাবকে একত্রিত করেছিল। ভারতীয় ব্রাহ্মণরা রাজকীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতেন, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জ্ঞান বিনিময় করতেন, আর মুসলিম ব্যবসায়ীরা স্থাপত্য ও শাসন ব্যবস্থায় ছাপ রেখে গেছেন। এই ঐতিহাসিক ঐতিহ্য আজও ইঙ্গিত দেয় যে আরাকান দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে নতুন করে সেতুবন্ধন গড়তে পারে।
ভারত-আরাকান সম্পর্কের ঐতিহাসিক গভীরতা
ভারত ও আরাকানের সম্পর্ক শত শত বছর ধরে বহুমুখী ছিল—ধর্ম, শাসনব্যবস্থা, শিল্প ও বাণিজ্যে। ধন্যবতী ও ভেসালীর চন্দ্র বংশ হিন্দু দেবতা শিবের বংশধর দাবি করলেও তারা বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ভেসালীতে আবিষ্কৃত শিবের বাহন নন্দীর পাথরের মূর্তি এবং গুপ্ত যুগের লিপি এই সংযোগের বাস্তব প্রমাণ।
ম্রাউক-ইউ যুগে এই সম্পর্ক আরও গভীর হয়। ১৫শ শতকে রাজা মুন সাও মোন বাংলার গৌড় সুলতানের কাছে আশ্রয় নিয়ে সামরিক সহায়তায় ম্রাউক-ইউ প্রতিষ্ঠা করেন। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আরাকানের বৌদ্ধ রাজারা মুসলিম উপাধি গ্রহণ করেন। এতে আরাকানি সংস্কৃতি দুর্বল না হয়ে বরং এক নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল।

সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক সেতুবন্ধন হিসেবে আরাকান
আরাকান ছিল ভৌগোলিকভাবেই সংযোগমুখর অঞ্চল। মহামুনি মন্দির এই আধ্যাত্মিক সম্পর্কের প্রতীক। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী, বুদ্ধ নিজেই আরাকানে এসে নিজের প্রতিকৃতি নির্মাণে সম্মতি দেন। এই কাহিনী আরাকানি জাতীয়তাবোধকে সরাসরি ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে।
পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণও এই যোগসূত্রকে সমর্থন করে। ময়নামতিতে আবিষ্কৃত ব্রোঞ্জ বুদ্ধমূর্তি, শ্রীলঙ্কা থেকে আনা ভাস্কর্য এবং সূর্যদেবের ভাস্কর্য প্রমাণ করে যে আরাকান ছিল বিশ্বাস ও শিল্পের মিলনকেন্দ্র।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে কৌশলগত গুরুত্ব
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে সিলিগুড়ি করিডোরের ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন। কলকাতা থেকে মিজোরামকে সিত্তওয়ের মাধ্যমে যুক্ত করতে কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প (KMMTTP) শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, বরং ভারতের “অ্যাক্ট ইস্ট” নীতির একটি মূল ভিত্তি।
কিন্তু রাখাইনের রাজনৈতিক বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়েছে। আরাকান আর্মি (ULA/AA) এখন প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের বড় অংশে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। তাদের বিচার বিভাগ হাজারো মামলা নিষ্পত্তি করেছে, যা প্রশাসনিক সক্ষমতার প্রমাণ। ফলে ভারতের জন্য প্রকল্পটি টেকসই করতে হলে কেবল নেপিদো নয়, আরাকানের বাস্তব কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও সহযোগিতা জরুরি।

পারস্পরিক উন্নয়নের জন্য নীতিগত সুপারিশ
১. সাংস্কৃতিক কূটনীতি ও শিক্ষা: ভারত ও আরাকানের মধ্যে যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন, শিক্ষাবৃত্তি ও চলমান প্রদর্শনীর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা ও বিনিময়।
২. আধ্যাত্মিক পর্যটন: ভারতের বৌদ্ধ পীঠস্থানগুলোর সঙ্গে আরাকানের ঐতিহাসিক নগরীগুলোকে সংযুক্ত করে তীর্থযাত্রা সার্কিট গঠন, যা অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন মজবুত করবে।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা: স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে KMMTTP বাস্তবায়ন, যাতে আরাকানবাসীর উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।
৪. অবকাঠামো ও বাণিজ্য: ক্ষুদ্রঋণ, বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করা, যাতে অর্থনৈতিক সুফল স্থানীয় জনগণের হাতে পৌঁছে।

সীমান্ত নয়, সেতুবন্ধন
আরাকানের ইতিহাস প্রমাণ করে ভৌগোলিক অবস্থান বিভাজনের নয়, বরং ঐক্যের শক্তি। বহুধর্মীয় সহাবস্থান, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সমুদ্রবাণিজ্যের ঐতিহ্য ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে একত্রে সমৃদ্ধ করতে পারে। কালাদান প্রকল্প শুধু একটি বন্দর বা রাস্তা নয়, বরং এটি প্রাচীন বন্ধুত্ব পুনরুদ্ধারের সুযোগ।
আরাকানকে প্রান্ত নয়, বরং সেতু হিসেবে বিবেচনা করা—এই দৃষ্টিভঙ্গিই পারস্পরিক নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার স্থায়ী পথ তৈরি করতে পারে।
( রিপোর্টটি ভারতের একটি থিঙ্কট্যাঙ্ক এশিয়ান কনফুলেন্সের প্রবন্ধ’র ওপর ভিত্তি করে তৈরি)
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















