পরমাণু নীতি পুনঃবিবেচনা: যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা প্রশ্নে
লন্ডনের বাইরে ১৮শ শতাব্দীর একটি জর্জিয়ান ম্যানরে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে জাপানের প্রভাবশালী আইননির্মাতা রুই মাতসুকাওয়া হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা অঙ্গীকার নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত ও পূর্বসূরিদের প্রতি নিরুৎসাহজনক মনোভাবের কারণে ইউরোপ নিজ নিজ নিরাপত্তার দায় বেশি নিতে বাধ্য হচ্ছে, এমন কথাই তিনি শুনেছিলেন অনেকের কাছ থেকে।
এই চিন্তাই জাপানের কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে—বিশ্বজুড়ে সর্বাধিক মার্কিন সেনা মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও, “আমেরিকান উপস্থিতিকে স্বাভাবিক ধরে নেওয়া যায় না।”
‘পরমাণু শেয়ারিং’-এর সম্ভাবনায় দ্বন্দ্ব
জাপান, যেটি একমাত্র দেশ যেখানকার মাটিতে পরমাণু বোমা আছড়ে পড়েছিল, আজ সেই ‘অচিন্তনীয়’ বিকল্প ভাবছে—পরমাণু অস্ত্র নিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার ব্যাপারটি। অস্ত্রসজ্জিত প্রতিবেশী (চীন, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া) একদিকে, আর অন্যদিকে মার্কিন নির্ভরতার অনিশ্চয়তা—এই দুইয়ের সমন্বয়ে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা স্বতন্ত্র হয়ে পরমাণু পথে যাওয়ার পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়।
এছাড়াও, জাপানের অনেক সিনিয়র আইননির্মাতা চেষ্টা করছেন ১৯৬৭ সাল থেকে বিদ্যমান “ত্রৈপরমাণু অপ্রধান নীতি” শিথিল বা পুনঃব্যাখ্যা করতে, যাতে মার্কিন পরমাণু অস্ত্র গ্রহণের রাস্তা খোলা যায়।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিক্রিয়া: “নিউক্লিয়ার লেটেন্সি”
দক্ষিণ কোরিয়াতেও একই সঙ্কটে মানুষের মনোভাব বদলেছে—সর্বমোট প্রায় ৭৫% মানুষ মনে করে দেশটির নিজস্ব পরমাণু অস্ত্র থাকা উচিত। যদিও জুনে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লি জে-মিয়ং সরাসরি পরমাণু অস্ত্র নিয়ে আলোচনাকে কমিয়েছেন, তবুও তাঁর দলের মধ্যেও “নিউক্লিয়ার লেটেন্সি”—অর্থাৎ জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত পরমাণু অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা অর্জনের—কথা ভাবা হচ্ছে।
জনমনে পরিবর্তন: “তৃতীয় নন-নিউক্লিয়ার নীতি” আর কতদিন?
যদিও জাপানে সরকারি অবস্থান খানিকটা রক্ষণশীল—যুক্তরাষ্ট্র আজও গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, এবং তায়ওয়ানের সংকট মোকাবিলায় মার্কিন প্রতিরক্ষা অপরিহার্য—তবুও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে।
হিরোশিমা-নাগাসাকির স্মারক হিসেবে মানুষের অনুভূতি সময়ের স্রোতে দূরে সরে যাচ্ছে, তা বোঝাচ্ছেন হিরোশিমার বাসিন্দা তৎসুয়াকি তাকাহাশি। তিনি বলেছেন—“রাষ্ট্রের স্বার্থেই মার্কিন পরমাণু অস্ত্র অনিবার্য হতে পারে,” যদিও তিনি ব্যবহারের বিরোধী।
একটি সার্বজনীন জরিপে দেখা গেছে—মার্চ মাসে ৪১% মানুষ তৃতীয় নন-নিউক্লিয়ার নীতি সংশোধনের পক্ষে মত দিয়েছে। তিন বছর আগেও এই সংখ্যা ছিল মাত্র ২০%।
‘থ্রেশহোল্ড রাষ্ট্র’ হিসেবে জাপানের ক্ষমতা?
বিশ্লেষকরা বলছেন, জাপান ইতোমধ্যেই একটি “থ্রেশহোল্ড নিউক্লিয়ার স্টেট”—অর্থাৎ যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তবে খুব দ্রুত পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারবে।
উদাহরণ হিসেবে, এক বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেছেন, “কয়েক বছরের মধ্যেই জাপান ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি পরমাণু অস্ত্র প্রস্তুত করতে পারে।” একজন শীর্ষ আইননির্মাতা অনুমান করেছেন, “ছয় মাসেও তৈরি সম্ভব”—যদি মার্কিন নির্ভরতা ভেঙে যায়।
প্রযুক্তিগতভাবে, জাপানের কাছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্লুটোনিয়াম, উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, মহাকাশ কর্মসূচির প্রযুক্তি—সবকিছুই অস্ত্র তৈরিতে সহায়ক হতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়া তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে আছে—তাদের কাছে প্লুটোনিয়াম বা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার সুযোগ নেই, যদিও ২৬টি নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর রয়েছে। দক্ষতা থাকলেও একটি ‘গোপন অস্ত্র’ কর্মসূচি চালু করতে কয়েক বছর সময় লাগবে।
আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা
পরমাণু অস্ত্র প্রস্তুতির ক্ষেত্রে জাপানের জন্য বড় বাধা হবে—জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা, নিউক্লিয়ার জ্বালানির সরবরাহ হারানো, এবং দেশের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় তীব্র জনবিরোধিতা।
উপরন্তু, এমন পদক্ষেপ চীনের উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া ডেকে আনতে পারে—চীন আরও পরমাণু অস্ত্র বাড়িয়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
সরকারী স্থিতি ও সাম্প্রতিক উন্নয়ন
আনুষ্ঠানিকভাবে জাপান এখনও নন-নিউক্লিয়ার নীতি মেনে চলার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশটি পরমাণু শেয়ারিং সমর্থন করে না এবং অস্ত্র অধিকার করবে না বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সেনাবাহিনীর মতে, মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্ডের প্রতি আস্থা “অটল”। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রও জানিয়েছে, এ ক্ষেত্রে কোনও নীতি পরিবর্তন হয়নি।
ট্রাম্পের অনিশ্চিত কূটনীতি, আঞ্চলিক হুমকি এবং দীর্ঘদিনের মার্কিন নির্ভরতার সন্দেহ—এসব মিলিয়ে এখন জাপান (এবং কোরিয়া) নতুন করে “পরমাণু বিকল্প” নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। যদিও সরকারি মনোভাব এখনও সংযত, তবে জনমনে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে, পারমাণবিক প্রতিরক্ষা নিয়ে ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে।
পরমাণু অস্ত্রের দ্বারপ্রান্তে জাপান: মার্কিন অনিশ্চয়তায় বাড়ছে চাপ
-
সারাক্ষণ রিপোর্ট - ০১:০০:৩১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫
- 95
জনপ্রিয় সংবাদ




















