০৪:৪৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
টোকিও গেম শো ২০২৫: গেমিং জগতের উৎসব শুরু বিশ্ব সঙ্গীতে এআই-এর সৃজনশীল ঢেউ আইএফএ বার্লিন ২০২৫: যে গ্যাজেটগুলো নিয়ে সবার আলোচনা এআই প্রশিক্ষণে আইনি নজির: লেখকদের সাথে Anthropic-এর $১.৫ বিলিয়ন সমঝোতা যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনে সবচেয়ে বড় আকাশ হামলা লন্ডনের ডানপন্থী সমাবেশে সহিংসতা, রেকর্ড সমাগমে উত্তেজনা দোহায় হামাস নেতাদের ওপর হামলা, যুদ্ধবিরতির আলাপ জটিলতায় নতুন গবেষণা: আটলান্টিক প্রবাহ ভাঙার ঝুঁকি এখন অনেক বেশি” ডাকসু ও জাকসুতে বৈষম্যবিরোধীদের বিপর্যয়, চ্যালেঞ্জের মুখে এনসিপি? জাতীয় নির্বাচনকে ডাকসুর সঙ্গে মেলানো যাবে না, মডেল হিসেবে কাজ করবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

সেলিম আল দীন: বাংলা নাটকের নবযুগের প্রবর্তক

শৈশব ও শিক্ষাজীবন

সেলিম আল দীন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মাওলানা মাজহারুল হক এবং মাতার নাম আশিয়া খাতুন। শৈশব কেটেছে গ্রামীণ পরিবেশে, যেখানে তিনি প্রকৃতি ও লোকসংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে স্কুলজীবন অতিক্রম করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স করেন। পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটক ও নাট্যতত্ত্বে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

কর্মজীবন ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন

১৯৭৪ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেন। তাঁর প্রচেষ্টাতেই বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নাটক একটি পূর্ণাঙ্গ বিষয় হিসেবে চালু হয়। তিনি শুধু শিক্ষকই ছিলেন না, ছিলেন গবেষক, নাট্যতত্ত্ববিদ ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।

নাট্যভাবনা ও দর্শন

সেলিম আল দীন মূলত “লোকনাট্য” বা “গণনাট্য”কে আধুনিক রূপ দেওয়ার জন্য পরিচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলা নাটকের মূল ভিত্তি নিহিত আছে গ্রামীণ জীবনে, লোককথা ও পালাগানে। পাশ্চাত্য নাটকের অনুকরণ না করে তিনি বাংলার নিজস্ব শেকড় থেকে নাট্যরীতি আবিষ্কার করেন। এজন্য তাঁকে প্রায়ই “লোকনাট্যের জনক” বলা হয়। তাঁর নাটকে গ্রামীণ সংস্কৃতি, লোকশিল্প, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা একসঙ্গে মিলেমিশে নতুন আঙ্গিক তৈরি করে।

Roar বাংলা - নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন ও তার নাটকের ভুবন

উল্লেখযোগ্য নাটক ও রচনা

সেলিম আল দীন ছিলেন একাধারে নাট্যকার, তাত্ত্বিক ও কবি। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • • সর্পবিদ্যা (১৯৭৪)
  • • কিত্তনখোলা (১৯৮১)
  • • বাশের কেল্লা (১৯৮৫)
  • • জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন (১৯৯০)
  • • হাট বানিকের পালা (১৯৯১)
  • • চাকা (১৯৯২)
  • • প্রাচীন বাংলা নাট্যরীতি অবলম্বনে‘সঙ্গীত’ (২০০৬)

এছাড়া তিনি টেলিভিশন নাটকেও কাজ করেছেন। তাঁর নাটকগুলো গ্রামীণ সমাজের জীবনসংগ্রাম, প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই এবং ইতিহাসের গভীর চেতনা তুলে ধরে।

নাট্যচিন্তা ও গবেষণা

শুধু নাটক লেখা নয়, সেলিম আল দীন নাটকের ইতিহাস ও তত্ত্ব নিয়ে গভীর গবেষণা করেছেন। তিনি বাংলা নাট্যভাষার একটি স্বতন্ত্র রূপ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর লেখা প্রবন্ধ, বক্তৃতা ও গবেষণামূলক কাজ নাট্যচর্চায় এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে। তিনি “বাংলা নাটকের স্বরূপ” ধারণা সামনে আনেন, যা ইউরোপকেন্দ্রিক নাট্যভাবনার বিকল্প হিসেবে বাংলা মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেলিম আল দীন : বাংলা নাটকের ভিন্ন ধারার কারিগর

সম্মাননা ও অবদান

বাংলা নাটকে অসামান্য অবদানের জন্য সেলিম আল দীন একাধিক সম্মাননা অর্জন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে—

  • • একুশে পদক (২০০৭)
  • • বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪)
  • • জাতীয় নাট্য উৎসবের বিশেষ সম্মাননা

তাঁর প্রতিষ্ঠিত নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ আজও বাংলাদেশের নাট্যশিক্ষার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে তাঁর রেখে যাওয়া নাটক, নাট্যতত্ত্ব এবং ভাবনা আজও বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় জীবন্ত। বর্তমানে তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশি নাট্যাঙ্গনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ।

উপসংহার

সেলিম আল দীন ছিলেন একাধারে সৃষ্টিশীল নাট্যকার ও দূরদর্শী গবেষক। তিনি বাংলা নাটককে দেশীয় ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত করে এক নবযুগের সূচনা করেন। তাঁর জীবন ও কর্ম বাংলা নাটকের ইতিহাসে স্থায়ী মাইলফলক হয়ে থাকবে।

বাংলা নাটক ও সেলিম আল দীন

দুটি বিখ্যাত নাটকের বিশ্লেষণ

কিত্তনখোলা (১৯৮১)

কাহিনি ও প্রেক্ষাপট

“কিত্তনখোলা” সেলিম আল দীন-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা, যেখানে বাংলাদেশের কৃষক সমাজ, তাদের সংগ্রাম ও শোষণের চিত্র ফুটে ওঠে। নাটকের কেন্দ্রে রয়েছে গরিব কৃষক পরিবারের দুঃখ-কষ্ট, জমিদার-ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাধরদের দমননীতি এবং প্রান্তিক মানুষের প্রতিরোধ।

উল্লেখযোগ্য অংশের বিশ্লেষণ

  • • নাটকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে দেখা যায় কৃষকরা তাদের জীবিকার টানাপোড়েনে বাধ্য হয়ে ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে জমিদারের কাছে মাথা নত করছে। এই দৃশ্যে লেখক একদিকে অর্থনৈতিক শোষণকে তুলে ধরেছেন,অন্যদিকে মানুষের মর্যাদাহানির কষ্টও দেখিয়েছেন।
  • • আরেকটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো গ্রামের কিত্তন দলের গান ও পালা। এগুলো কেবল বিনোদন নয়,বরং শোষিত মানুষের যন্ত্রণা ও বিদ্রোহের ভাষা হিসেবে কাজ করে। লোকসঙ্গীতের মাধ্যমে নাটকের বুনন একদিকে আবেগময়, অন্যদিকে রাজনৈতিক বার্তায় সমৃদ্ধ।

কলকাতার মঞ্চে সেলিম আল দীনের 'কিত্তনখোলা'

চরিত্রপ্রতীক ও নাট্যরীতি

  • • চরিত্রগুলো মূলত গ্রামীণ কৃষক,জমিদার ও গানবাজনাদলের সদস্য। তারা সমাজের শ্রেণি বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি।
  • • প্রতীক হিসেবে “কিত্তন” এখানে শোষিত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিবাদের রূপ।
  • • নাট্যরীতি লোকগীতি,পালাগান ও মঞ্চের বাস্তবতার মিশ্রণ, যা দর্শককে সরাসরি সমাজের সঙ্গে যুক্ত করে।

বিশ্লেষণ

এই নাটকের মাধ্যমে সেলিম আল দীন প্রমাণ করেছেন যে গ্রামীণ সংস্কৃতিই আসল নাটকের প্রাণশক্তি। লোকগীতি ও গ্রামীণ ভাষা ব্যবহার করে তিনি নাটককে মাটির কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন। ফলে নাটকটি শুধু মঞ্চের নয়, মানুষের হৃদয়েরও অংশ হয়ে ওঠে।

চাকা (১৯৯২)

কাহিনি ও প্রেক্ষাপট

“চাকা” হলো সেলিম আল দীন-এর সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত নাটকগুলোর একটি। এর কেন্দ্রে রয়েছে একটি লাশ, যা কয়েকজন গরিব মানুষ বহন করছে। লাশ বহনের পথে তারা যে যন্ত্রণা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরুপায় অবস্থার সম্মুখীন হয়, তাই নাটকের মূল কাহিনি।

উল্লেখযোগ্য অংশের বিশ্লেষণ

  • • নাটকের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশে চরিত্ররা লাশ বহন করতে করতে ক্ষুধায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। তারা আলোচনা করে,মানুষের জীবনে মৃত্যু এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলেও জীবিত অবস্থার সংগ্রামই সবচেয়ে ভয়ংকর। এই অংশে লেখক জীবন ও মৃত্যুর দার্শনিক দিক তুলে ধরেছেন।
  • • আরেকটি গভীর অংশ হলো যখন লাশ বহনকারীরা পথে নানা মানুষের উপহাস ও উদাসীনতার সম্মুখীন হয়। এই দৃশ্য সমাজের ভণ্ডামি ও অসংবেদনশীলতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে।

চাকা

চরিত্রপ্রতীক ও নাট্যরীতি

  • • চরিত্রগুলো নামহীন,যেন তারা সমগ্র সমাজের প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি।
  • • লাশ এখানে প্রতীক—অসহায় জীবনের ভার,দারিদ্র্যের চরম সত্য এবং সামাজিক অবহেলার প্রতিফলন।
  • • নাট্যরীতি হিসেবে লেখক বাস্তবতা ও প্রতীকী ইঙ্গিত একসাথে ব্যবহার করেছেন,যা নাটককে গভীর দার্শনিক রূপ দিয়েছে।

বিশ্লেষণ

“চাকা” নাটকটি কেবল একটি লাশ বহনের গল্প নয়; এটি বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চরম বাস্তবতার প্রতীক। লাশ বহনের অবিরাম যাত্রা যেন সমাজে চলমান অন্যায়, দারিদ্র্য আর অবহেলার প্রতিচ্ছবি। এই নাটকে সেলিম আল দীন দর্শকদের সামনে এক নির্মম বাস্তবতার দর্পণ ধরেছেন।

“কিত্তনখোলা” ও “চাকা” – এই দুটি নাটকের উল্লেখযোগ্য অংশে আমরা দেখতে পাই প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম, সমাজের শোষণব্যবস্থা ও দারিদ্র্যের নগ্ন চিত্র। প্রথমটিতে তিনি লোকসংস্কৃতি ও প্রতিরোধের শক্তিকে মঞ্চে এনেছেন, দ্বিতীয়টিতে মানবজীবনের অনিবার্য কষ্ট ও সামাজিক অসংবেদনশীলতার নির্মম সত্য প্রকাশ করেছেন। দুটি নাটকই প্রমাণ করে, সেলিম আল দীন শুধু নাট্যকার নন, বরং তিনি ছিলেন সমাজ ও জীবনের গভীর ভাষ্যকার।

টোকিও গেম শো ২০২৫: গেমিং জগতের উৎসব শুরু

সেলিম আল দীন: বাংলা নাটকের নবযুগের প্রবর্তক

০৬:৪৯:৪৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫

শৈশব ও শিক্ষাজীবন

সেলিম আল দীন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মাওলানা মাজহারুল হক এবং মাতার নাম আশিয়া খাতুন। শৈশব কেটেছে গ্রামীণ পরিবেশে, যেখানে তিনি প্রকৃতি ও লোকসংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে স্কুলজীবন অতিক্রম করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স করেন। পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটক ও নাট্যতত্ত্বে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

কর্মজীবন ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন

১৯৭৪ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেন। তাঁর প্রচেষ্টাতেই বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নাটক একটি পূর্ণাঙ্গ বিষয় হিসেবে চালু হয়। তিনি শুধু শিক্ষকই ছিলেন না, ছিলেন গবেষক, নাট্যতত্ত্ববিদ ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।

নাট্যভাবনা ও দর্শন

সেলিম আল দীন মূলত “লোকনাট্য” বা “গণনাট্য”কে আধুনিক রূপ দেওয়ার জন্য পরিচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলা নাটকের মূল ভিত্তি নিহিত আছে গ্রামীণ জীবনে, লোককথা ও পালাগানে। পাশ্চাত্য নাটকের অনুকরণ না করে তিনি বাংলার নিজস্ব শেকড় থেকে নাট্যরীতি আবিষ্কার করেন। এজন্য তাঁকে প্রায়ই “লোকনাট্যের জনক” বলা হয়। তাঁর নাটকে গ্রামীণ সংস্কৃতি, লোকশিল্প, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা একসঙ্গে মিলেমিশে নতুন আঙ্গিক তৈরি করে।

Roar বাংলা - নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন ও তার নাটকের ভুবন

উল্লেখযোগ্য নাটক ও রচনা

সেলিম আল দীন ছিলেন একাধারে নাট্যকার, তাত্ত্বিক ও কবি। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • • সর্পবিদ্যা (১৯৭৪)
  • • কিত্তনখোলা (১৯৮১)
  • • বাশের কেল্লা (১৯৮৫)
  • • জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন (১৯৯০)
  • • হাট বানিকের পালা (১৯৯১)
  • • চাকা (১৯৯২)
  • • প্রাচীন বাংলা নাট্যরীতি অবলম্বনে‘সঙ্গীত’ (২০০৬)

এছাড়া তিনি টেলিভিশন নাটকেও কাজ করেছেন। তাঁর নাটকগুলো গ্রামীণ সমাজের জীবনসংগ্রাম, প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই এবং ইতিহাসের গভীর চেতনা তুলে ধরে।

নাট্যচিন্তা ও গবেষণা

শুধু নাটক লেখা নয়, সেলিম আল দীন নাটকের ইতিহাস ও তত্ত্ব নিয়ে গভীর গবেষণা করেছেন। তিনি বাংলা নাট্যভাষার একটি স্বতন্ত্র রূপ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর লেখা প্রবন্ধ, বক্তৃতা ও গবেষণামূলক কাজ নাট্যচর্চায় এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে। তিনি “বাংলা নাটকের স্বরূপ” ধারণা সামনে আনেন, যা ইউরোপকেন্দ্রিক নাট্যভাবনার বিকল্প হিসেবে বাংলা মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেলিম আল দীন : বাংলা নাটকের ভিন্ন ধারার কারিগর

সম্মাননা ও অবদান

বাংলা নাটকে অসামান্য অবদানের জন্য সেলিম আল দীন একাধিক সম্মাননা অর্জন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে—

  • • একুশে পদক (২০০৭)
  • • বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪)
  • • জাতীয় নাট্য উৎসবের বিশেষ সম্মাননা

তাঁর প্রতিষ্ঠিত নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ আজও বাংলাদেশের নাট্যশিক্ষার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে তাঁর রেখে যাওয়া নাটক, নাট্যতত্ত্ব এবং ভাবনা আজও বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় জীবন্ত। বর্তমানে তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশি নাট্যাঙ্গনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ।

উপসংহার

সেলিম আল দীন ছিলেন একাধারে সৃষ্টিশীল নাট্যকার ও দূরদর্শী গবেষক। তিনি বাংলা নাটককে দেশীয় ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত করে এক নবযুগের সূচনা করেন। তাঁর জীবন ও কর্ম বাংলা নাটকের ইতিহাসে স্থায়ী মাইলফলক হয়ে থাকবে।

বাংলা নাটক ও সেলিম আল দীন

দুটি বিখ্যাত নাটকের বিশ্লেষণ

কিত্তনখোলা (১৯৮১)

কাহিনি ও প্রেক্ষাপট

“কিত্তনখোলা” সেলিম আল দীন-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা, যেখানে বাংলাদেশের কৃষক সমাজ, তাদের সংগ্রাম ও শোষণের চিত্র ফুটে ওঠে। নাটকের কেন্দ্রে রয়েছে গরিব কৃষক পরিবারের দুঃখ-কষ্ট, জমিদার-ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাধরদের দমননীতি এবং প্রান্তিক মানুষের প্রতিরোধ।

উল্লেখযোগ্য অংশের বিশ্লেষণ

  • • নাটকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে দেখা যায় কৃষকরা তাদের জীবিকার টানাপোড়েনে বাধ্য হয়ে ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে জমিদারের কাছে মাথা নত করছে। এই দৃশ্যে লেখক একদিকে অর্থনৈতিক শোষণকে তুলে ধরেছেন,অন্যদিকে মানুষের মর্যাদাহানির কষ্টও দেখিয়েছেন।
  • • আরেকটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো গ্রামের কিত্তন দলের গান ও পালা। এগুলো কেবল বিনোদন নয়,বরং শোষিত মানুষের যন্ত্রণা ও বিদ্রোহের ভাষা হিসেবে কাজ করে। লোকসঙ্গীতের মাধ্যমে নাটকের বুনন একদিকে আবেগময়, অন্যদিকে রাজনৈতিক বার্তায় সমৃদ্ধ।

কলকাতার মঞ্চে সেলিম আল দীনের 'কিত্তনখোলা'

চরিত্রপ্রতীক ও নাট্যরীতি

  • • চরিত্রগুলো মূলত গ্রামীণ কৃষক,জমিদার ও গানবাজনাদলের সদস্য। তারা সমাজের শ্রেণি বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি।
  • • প্রতীক হিসেবে “কিত্তন” এখানে শোষিত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিবাদের রূপ।
  • • নাট্যরীতি লোকগীতি,পালাগান ও মঞ্চের বাস্তবতার মিশ্রণ, যা দর্শককে সরাসরি সমাজের সঙ্গে যুক্ত করে।

বিশ্লেষণ

এই নাটকের মাধ্যমে সেলিম আল দীন প্রমাণ করেছেন যে গ্রামীণ সংস্কৃতিই আসল নাটকের প্রাণশক্তি। লোকগীতি ও গ্রামীণ ভাষা ব্যবহার করে তিনি নাটককে মাটির কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন। ফলে নাটকটি শুধু মঞ্চের নয়, মানুষের হৃদয়েরও অংশ হয়ে ওঠে।

চাকা (১৯৯২)

কাহিনি ও প্রেক্ষাপট

“চাকা” হলো সেলিম আল দীন-এর সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত নাটকগুলোর একটি। এর কেন্দ্রে রয়েছে একটি লাশ, যা কয়েকজন গরিব মানুষ বহন করছে। লাশ বহনের পথে তারা যে যন্ত্রণা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরুপায় অবস্থার সম্মুখীন হয়, তাই নাটকের মূল কাহিনি।

উল্লেখযোগ্য অংশের বিশ্লেষণ

  • • নাটকের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশে চরিত্ররা লাশ বহন করতে করতে ক্ষুধায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। তারা আলোচনা করে,মানুষের জীবনে মৃত্যু এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলেও জীবিত অবস্থার সংগ্রামই সবচেয়ে ভয়ংকর। এই অংশে লেখক জীবন ও মৃত্যুর দার্শনিক দিক তুলে ধরেছেন।
  • • আরেকটি গভীর অংশ হলো যখন লাশ বহনকারীরা পথে নানা মানুষের উপহাস ও উদাসীনতার সম্মুখীন হয়। এই দৃশ্য সমাজের ভণ্ডামি ও অসংবেদনশীলতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে।

চাকা

চরিত্রপ্রতীক ও নাট্যরীতি

  • • চরিত্রগুলো নামহীন,যেন তারা সমগ্র সমাজের প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি।
  • • লাশ এখানে প্রতীক—অসহায় জীবনের ভার,দারিদ্র্যের চরম সত্য এবং সামাজিক অবহেলার প্রতিফলন।
  • • নাট্যরীতি হিসেবে লেখক বাস্তবতা ও প্রতীকী ইঙ্গিত একসাথে ব্যবহার করেছেন,যা নাটককে গভীর দার্শনিক রূপ দিয়েছে।

বিশ্লেষণ

“চাকা” নাটকটি কেবল একটি লাশ বহনের গল্প নয়; এটি বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চরম বাস্তবতার প্রতীক। লাশ বহনের অবিরাম যাত্রা যেন সমাজে চলমান অন্যায়, দারিদ্র্য আর অবহেলার প্রতিচ্ছবি। এই নাটকে সেলিম আল দীন দর্শকদের সামনে এক নির্মম বাস্তবতার দর্পণ ধরেছেন।

“কিত্তনখোলা” ও “চাকা” – এই দুটি নাটকের উল্লেখযোগ্য অংশে আমরা দেখতে পাই প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম, সমাজের শোষণব্যবস্থা ও দারিদ্র্যের নগ্ন চিত্র। প্রথমটিতে তিনি লোকসংস্কৃতি ও প্রতিরোধের শক্তিকে মঞ্চে এনেছেন, দ্বিতীয়টিতে মানবজীবনের অনিবার্য কষ্ট ও সামাজিক অসংবেদনশীলতার নির্মম সত্য প্রকাশ করেছেন। দুটি নাটকই প্রমাণ করে, সেলিম আল দীন শুধু নাট্যকার নন, বরং তিনি ছিলেন সমাজ ও জীবনের গভীর ভাষ্যকার।