ভূমিকা
বাংলা নাট্যজগতে শম্ভু মিত্র এমন এক নাম, যিনি একসাথে নাট্যকার, অভিনেতা এবং নির্দেশক হিসেবে অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে সমকালীন নাট্যকারদের লেখা মঞ্চে তুলেছেন তিনি এক ভিন্ন শৈলীতে। তার পরিচালনা, অভিনয় এবং নাট্যভাবনা শুধু বাংলা নাটক নয়, ভারতীয় নাট্যচর্চার ইতিহাসকেও তিনি নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন।
শৈশব ও গঠনকাল
১৯১৫ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন শম্ভু মিত্র। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য ও অভিনয়ের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা চলাকালেই নাটকে যুক্ত হন। অভিনয় শুধু তার কাছে পেশা ছিল না, বরং এক ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা। সমাজকে আলোড়িত করার হাতিয়ার হিসেবে তিনি মঞ্চকে বেছে নেন।
“রক্তকরবী”: রবীন্দ্রনাথের নাটকে নতুন প্রাণ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক “রক্তকরবী” শম্ভু মিত্রের হাতে নতুন রূপ পায়। রবীন্দ্রনাথের প্রতীকী নাটককে তিনি এমন এক ভিজ্যুয়াল ভাষায় মঞ্চে তুলেছিলেন, যা দর্শককে মোহিত করেছিল। তার নির্দেশনায় আলো, সঙ্গীত, সংলাপ ও মঞ্চসজ্জা নাটকের প্রতীকী শক্তিকে আরও জীবন্ত করে তোলে। সমালোচকরা একে বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মঞ্চায়ন বলে মনে করেন।
“গণনাট্য সংঘ”: মানুষের নাটক মানুষের জন্য
১৯৪৩ সালে তিনি এবং তৎকালীন কয়েকজন নাট্যকর্মী মিলে প্রতিষ্ঠা করেন “গণনাট্য সংঘ”। এটি ছিল বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ। এখানে তিনি মঞ্চে আনলেন সমাজের বঞ্চিত মানুষদের কথা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, কৃষক-শ্রমিকের সংগ্রাম, দারিদ্র্য আর বৈষম্যের বাস্তবতাগুলো তার নাটকে উঠে আসত। এই সংস্থার অন্যতম জনপ্রিয় নাটক ছিল “নবান্ন”—যা দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার মানুষের হাহাকারকে মঞ্চে রূপ দিয়েছিল।
অভিনেতা হিসেবে সাফল্য
শম্ভু মিত্র শুধু নাট্যকার বা নির্দেশক নন, তিনি ছিলেন অনবদ্য অভিনেতা। তার গম্ভীর কণ্ঠস্বর, সংলাপের নিখুঁত উচ্চারণ এবং চরিত্রে গভীর ডুবে যাওয়ার ক্ষমতা তাকে অনন্য করে তুলেছিল। “নবান্ন”, “রক্তকরবী” ছাড়াও তিনি “চণ্ডালিকা” ও অন্যান্য নাটকে অভিনয় করে দর্শকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন।
চলচ্চিত্রে অবদান
বাংলা চলচ্চিত্রেও শম্ভু মিত্র নিজের ছাপ রেখেছেন। তিনি সত্যজিৎ রায়ের “অশনি সংকেত” চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এছাড়া “ঝিন্দের বন্দী”, “ঝর্ণাধারা” প্রভৃতি ছবিতে তার অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। সিনেমার মাধ্যমে তিনি বৃহত্তর দর্শকের কাছে পৌঁছেছিলেন।
দৃষ্টিভঙ্গি ও উত্তরাধিকার
শম্ভু মিত্র বিশ্বাস করতেন, নাটক কেবল বিনোদন নয়; এটি সামাজিক পরিবর্তনের শক্তিশালী হাতিয়ার। তাই তিনি সমাজের বাস্তবতাকে মঞ্চে তুলতে কুণ্ঠিত হননি। তার নাটকগুলোতে ছিল প্রান্তিক মানুষের বেদনা, শোষণ আর মুক্তির স্বপ্ন।
আজও গণনাট্য সংঘ এবং অন্যান্য থিয়েটার গ্রুপ তার পথ অনুসরণ করে চলছে। শম্ভু মিত্রের নাট্যচিন্তা পরবর্তী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করেছে সমাজ সচেতন নাটক রচনায়।
শম্ভু মিত্র শুধু একজন নাট্যকর্মী ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক যুগপ্রবর্তক। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে মঞ্চে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, গণনাট্য আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে আলোয় এনেছেন, আর নাটককে দিয়েছেন নতুন সামাজিক গুরুত্ব। তাই শম্ভু মিত্রকে বাংলা নাট্যজগতে আজও স্মরণ করা হয় শ্রদ্ধা ও গৌরবে।