ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের জগতে রূপা গাঙ্গুলী একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি শুধু একজন অভিনেত্রী নন বরং গায়িকা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের সক্রিয় সদস্য হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন আলাদা একটি গল্প—শৈশব থেকে শুরু করে অভিনয়, তারপর বাংলাদেশে যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্রে অভিষেক, আবার গান, পুরস্কার এবং পরবর্তীতে রাজনীতিতে সক্রিয়তা। এই দীর্ঘ পথচলা একদিকে যেমন সংগ্রামের, অন্যদিকে তেমনি সাফল্যেরও অনন্য দৃষ্টান্ত।
জন্ম ও শৈশব
রূপা গাঙ্গুলীর জন্ম ২৫ নভেম্বর ১৯৬৬ সালে কলকাতায়। কলকাতার সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা এই মেয়েটি ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত, কিন্তু সাংস্কৃতিক অনুরাগ প্রবল। তিনি Jogamaya Devi College থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। কৈশোরকালেই নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। স্কুল–কলেজ জীবনের নাট্যমঞ্চে তিনি যে আত্মবিশ্বাসী উপস্থিতি দেখিয়েছিলেন, সেটিই পরে তার চলচ্চিত্রজীবনে দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
অভিনয়ে আগমন
রূপা গাঙ্গুলীর অভিনয়জীবনের শুরু হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প অবলম্বনে নির্মিত হিন্দি টেলিফিল্ম ‘নিরুপমা’ (১৯৮৬) দিয়ে। এরপর ‘মুক্তবন্ধ’ ধারাবাহিক (১৯৮৬) এবং ‘গণদেবতা’ (১৯৮৭–১৯৮৮) তাকে টেলিভিশন দর্শকের কাছে পরিচিত করে তোলে। তবে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় মহাভারত (১৯৮৮–১৯৯০) ধারাবাহিকে দ্রৌপদীর চরিত্রে অভিনয়।
এই চরিত্র তাকে শুধু ভারত নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় পরিচিতি এনে দেয়। ভারতীয় টেলিভিশনের ইতিহাসে মহাভারত ধারাবাহিক একটি মাইলফলক, আর দ্রৌপদীর ভূমিকায় রূপার অভিনয় এখনো দর্শকদের স্মৃতিতে অম্লান।
চলচ্চিত্রজগতে প্রবেশ
টেলিভিশনের পর তিনি চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। নব্বই দশকের শুরুতে একে একে কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আছে—‘জননী’ (১৯৯৩), ‘উজান’ (১৯৯৫), ‘যুগান্ত’ (১৯৯৬), ‘বারিওয়ালি’ (২০০০), ‘আবার আরণ্য্যে’ (২০০৩), ‘অন্তর্মহল’ (২০০৫), ‘ক্রান্তিকাল’ (২০০৫), ‘অবশেষে’ (২০১২), ‘দত্তা ভার্সেস দত্তা’, ‘পুনশ্চ’ ইত্যাদি। প্রতিটি ছবিতেই তিনি নতুন চরিত্রে নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে আরও পরিণত হয়ে ওঠেন।
পদ্মা নদীর মাঝি: বাংলাদেশে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা
রূপা গাঙ্গুলীর ক্যারিয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত চলচ্চিত্র ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। চলচ্চিত্রটি মণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এবং ১৯৯৩ সালে মুক্তি পায়। গৌতম ঘোষ পরিচালিত এই ছবির শুটিং সম্পূর্ণ হয়েছিল বাংলাদেশে।
এই ছবিতে রূপা অভিনয় করেছিলেন কপিলা চরিত্রে। কপিলা একজন মাঝি পরিবারের মেয়ে, যার জীবনে দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও টানাপোড়েন বিদ্যমান। স্বামী–সংসারের বন্ধন ভেঙে সে নতুন জীবনের পথে হাঁটে। রূপার কপিলা চরিত্রে অভিনয় ছিল এতটাই বাস্তবসম্মত যে দর্শক ও সমালোচক সবাই তাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেন। বিশিষ্ট অভিনেতা উৎপল দত্ত মন্তব্য করেছিলেন—“রূপা সত্যিই কপিলার জীবন যাপন করেছে, একজন জেলেপাড়ার নারীর অঙ্গভঙ্গি, দেহভাষা ও আবেগ তিনি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।”
‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবিটি শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, বরং বাংলাদেশ ও ভারতের সাংস্কৃতিক সম্পর্কের এক অনন্য সেতুবন্ধন। এ চলচ্চিত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা রূপার ক্যারিয়ারে আন্তর্জাতিক মাত্রা যোগ করে। যদিও বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিলেন চম্পা, তবুও রূপার অভিনয় ছিল দর্শকদের কাছে সমান আলোচিত।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সমালোচকদের প্রশংসা
‘পদ্মা নদীর মাঝি’ চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রদর্শিত হয়েছিল। ছবির গল্প, পরিচালনা এবং অভিনয়ের প্রশংসা করা হয় বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে। রূপা গাঙ্গুলীর নামও সেইসঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে কপিলা চরিত্রটি তার অভিনয় জীবনের মাইলফলক হয়ে ওঠে।
গান ও নেপথ্য সংগীতে অবদান
রূপা শুধু অভিনেত্রী নন, তিনি একজন গায়িকাও। তার কণ্ঠস্বর ও সংগীতপ্রতিভা সমানভাবে প্রশংসিত। চলচ্চিত্র ‘অবশেষে’ (২০১১)-তে প্লেব্যাক গেয়ে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (Best Female Playback Singer) অর্জন করেন। এটি তার জীবনের এক বিশেষ সাফল্য, যা প্রমাণ করে তিনি কেবল অভিনয়েই সীমাবদ্ধ নন, বরং গানের মঞ্চেও সমান দক্ষ।
পুরস্কার ও সম্মাননা
রূপা গাঙ্গুলী ক্যারিয়ারে বহু পুরস্কার পেয়েছেন।
- BFJA Awards– ‘উজান’-এ সাপোর্টিং রোলে (১৯৯৬) ও ‘অন্তর্মহল’-এ (২০০৬) পুরস্কার।
- Osian’s Cinefan Special Jury Award– ‘অন্তর্মহল’ (২০০৫)।
- Dhaka International Film Festival (Best Actress)– ‘ক্রান্তিকাল’ (২০০৬)।
- জাতীয় পুরস্কার– সেরা নারী কণ্ঠশিল্পী (২০১১)।
এইসব সম্মাননা প্রমাণ করে তার প্রতিভা বহুমুখী এবং সময়োপযোগী।
রাজনীতিতে রূপা
২০১৫ সালে রূপা গাঙ্গুলী ভারতীয় জনতা পার্টিতে (BJP) যোগ দেন। ২০১৬ থেকে ২০২২ পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাজ্যসভার সদস্য। পাশাপাশি BJP মহিলা মোর্চার পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতিও ছিলেন। রাজনীতিতে তার এই সক্রিয়তা প্রমাণ করে তিনি কেবল শিল্পী নন, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনেও ভূমিকা রাখতে চান।
ব্যক্তিগত জীবন
রূপা গাঙ্গুলীর ব্যক্তিগত জীবনও নানা ওঠানামার সাক্ষী। তিনি বিয়ে করেছিলেন ধ্রুব মুখার্জিকে, তবে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর একমাত্র সন্তানকে নিয়ে তিনি একাই সংসার সামলান। ব্যক্তিগত জীবনের এই লড়াইও তাকে আরও দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী করেছে।
রূপার অবদান: এক সার্বিক মূল্যায়ন
রূপা গাঙ্গুলী হলেন এমন এক শিল্পী যিনি অভিনয়, সংগীত ও রাজনীতির তিন ক্ষেত্রেই নিজেকে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন একজন নারীর প্রতিভা সীমাবদ্ধ নয়—প্রতিকূল পরিস্থিতি আসুক না কেন, তিনি প্রতিটি অঙ্গনে নতুনভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারেন।
বাংলাদেশে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’-তে তার অংশগ্রহণ দুই বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান তৈরি করেছে। ভারতীয় টেলিভিশনে দ্রৌপদীর চরিত্র, বাংলা চলচ্চিত্রে বহুমুখী চরিত্রে অভিনয়, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় অংশগ্রহণ—সব মিলিয়ে রূপা গাঙ্গুলী আজ এক প্রজন্মের অনুপ্রেরণা।
রূপা গাঙ্গুলীর জীবন যেন এক নদীর মতো, যা কখনো শান্ত, কখনো বেগবান, কখনো গভীর আবেগে পূর্ণ। তিনি বাংলা সংস্কৃতি, ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং দুই বাংলার সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক অনন্য নাম। তার অভিনয়, গান, ব্যক্তিত্ব এবং সংগ্রাম আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাবে।