ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের আলোচনায় কিছু নাম চিরকালীন হয়ে গেছে। তারা কেবল রুপালি পর্দার তারকা নন, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে তারা অনুপ্রেরণা, সংগ্রামের প্রতীক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। শাবানা আজমি, রেখা ও কবরী সারওয়ার—এই তিন মহাতারকা তিন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে জন্মগ্রহণ করেছেন, অভিনয় করেছেন ভিন্ন ভিন্ন চলচ্চিত্র জগতে। তবু তাদের মধ্যে একটি মিল রয়েছে: তারা তিনজনই ছিলেন নারীর শক্তি, প্রতিভা ও মানবিকতার প্রতীক।
প্রথম অধ্যায়: শাবানা আজমি – সমান্তরাল সিনেমার কিংবদন্তি
১৯৫০ সালে হায়দরাবাদে জন্ম নেওয়া শাবানা আজমি বড় হয়েছেন সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনা পরিবারে। কবি কাইফি আজমি ও অভিনেত্রী শওকত আজমির কন্যা তিনি। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক চর্চায় বেড়ে ওঠা শাবানা পড়াশোনা করেছেন সমাজবিজ্ঞান নিয়ে, পরে ভর্তি হন পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে।
চলচ্চিত্রে আগমন
১৯৭৪ সালে শ্যাম বেনেগালের অঙ্কুর ছবির মাধ্যমে তিনি বড় পর্দায় আসেন। প্রথম ছবিতেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এখান থেকেই শুরু হয় তার সোনালি যাত্রা।
সমান্তরাল সিনেমার শক্তি
শাবানা আজমি ছিলেন সমান্তরাল সিনেমার অন্যতম মুখ। অর্থ, প্যার, মাসুম, ফায়ার
পুরস্কার ও সম্মাননা
তিনি পাঁচবার জাতীয় পুরস্কার, অসংখ্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ পেয়েছেন। মানবিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকার কারণে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবেও কাজ করেছেন।
উত্তরাধিকার
শাবানা আজমি প্রমাণ করেছেন—অভিনেত্রী মানেই শুধু পর্দার চরিত্র নন, বরং সমাজ পরিবর্তনেরও কণ্ঠস্বর।
রেখা – রহস্যময় ও চিরসবুজ দেবী
১৯৫৪ সালে চেন্নাইয়ে জন্ম নেওয়া রেখা ছিলেন দক্ষিণের কিংবদন্তি অভিনেতা জেমিনি গণেশান ও অভিনেত্রী পুষ্পাবল্লির কন্যা। শৈশব ছিল দারিদ্র্য, অবহেলা ও কষ্টে ভরা। কিন্তু তিনি নিজের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি দিয়ে বলিউডে জায়গা করে নেন।
চলচ্চিত্রে প্রবেশ ও সংগ্রাম
মাত্র ১৩ বছর বয়সে তেলুগু ছবিতে অভিনয় শুরু করেন। হিন্দি সিনেমায় অভিষেক হয় ১৯৭০ সালে সাওন ভাদো ছবিতে। প্রথম দিকে তার উচ্চারণ ও অভিনয় নিয়ে সমালোচনা হলেও তিনি নিরলস পরিশ্রম করে সব জয় করেন।
উত্থান
১৯৭০–এর শেষ থেকে ১৯৮০–এর দশক পর্যন্ত তিনি ছিলেন বলিউডের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের একজন। মুকাদ্দর কা সিকন্দর, সিলসিলা, উমরাও জান, খুন পসিনাসহ অসংখ্য ছবিতে তার অভিনয় কিংবদন্তি হয়ে আছে। বিশেষ করে উমরাও জান ছবির জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
রহস্যময়তা ও বিতর্ক
রেখার জীবন সবসময় বিতর্কে ঘেরা। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে তার সম্পর্ক আজও বলিউডে আলোচনার বিষয়। বিয়ে, একাকীত্ব ও রহস্যময় জীবন তাকে ঘিরে এক বিশেষ আভা তৈরি করেছে।
সম্মাননা
তিনি জাতীয় পুরস্কার, ফিল্মফেয়ারসহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন। ২০১০ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী প্রদান করে।
উত্তরাধিকার
আজও রেখা বলিউডের এক জীবন্ত কিংবদন্তি, যিনি সৌন্দর্য, রহস্য ও প্রতিভার প্রতীক হয়ে আছেন।
কবরী সারওয়ার – বাংলার মিষ্টি মেয়ে
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কবরী সারওয়ার ছিলেন এক অনন্য নাম। ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া কবরী কিশোর বয়সেই চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন।
চলচ্চিত্রে আগমন
তার প্রথম ছবি সুতরাং (১৯৬৪), পরিচালনায় সুভাষ দত্ত। প্রথম ছবিতেই তিনি দর্শকের মন জয় করেন।
জনপ্রিয় চলচ্চিত্র
সুজন সখী, সারেং বৌ, নীল আকাশের নিচে, দেবদাসসহ অসংখ্য ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। নায়ক রাজ রাজ্জাকের সঙ্গে তার জুটি দর্শকের কাছে ছিল অবিস্মরণীয়।
মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা
১৯৭১ সালে তিনি কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন শিল্পীসমাজের অগ্রভাগে ছিলেন তিনি।
রাজনৈতিক জীবন
২০০৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাজে সক্রিয় ছিলেন জীবনভর।
মৃত্যু
২০২১ সালে করোনা মহামারির সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার প্রয়াণে জাতি হারায় এক কিংবদন্তি অভিনেত্রীকে।
উত্তরাধিকার
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে কবরী সারওয়ার চিরকালীন “মিষ্টি মেয়ে”, যিনি প্রমাণ করেছেন একজন অভিনেত্রী একইসাথে দেশপ্রেমিক, সমাজসেবী ও জননেত্রী হতে পারেন।
শাবানা আজমি, রেখা ও কবরী সারওয়ার—এই তিন মহাতারকা তিনটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে জন্ম নিয়েও একই জায়গায় মিলিত হয়েছেন: তারা সকলেই নারীর শক্তি, শিল্পের মহিমা ও সমাজে প্রভাব বিস্তারের প্রতীক। শাবানা আজমি দেখিয়েছেন কিভাবে অভিনয় সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারে; রেখা প্রমাণ করেছেন রহস্যময় ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা দিয়ে দশকের পর দশক দর্শকের মনে জায়গা করা যায়; আর কবরী সারওয়ার দেখিয়েছেন শিল্পী শুধু সিনেমার পর্দায় নয়, মুক্তিযুদ্ধের ময়দান ও সংসদেও দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন।
তিন মহাতারকার জীবনকাহিনি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শিল্প কেবল বিনোদন নয়, বরং তা সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে গড়ে তোলার অন্যতম মাধ্যম।