০৫:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
লেবাননের শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় ১৩ নিহত, নতুন সহিংসতার আশঙ্কা ‘আমার কোনও দোষ ছিল না, কিন্তু আমাকে সব কিছু হারাতে হয়েছে’ ‘সুইম শেডি’ নাম নিয়ে আইনি লড়াইয়ে এমিনেম দক্ষিণ-পশ্চিম জাপানের উপকূলীয় শহর ওওইতায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, পুড়ল শতাধিক ঘর বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুতে এগোচ্ছে জাপান গ্রাহকদের ভোগান্তি কমছে না, এবার রবির বিরুদ্ধে অভিযোগ — জিপি ও বাংলালিংকের আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ইশতেহারে শিশু নিরাপত্তা জোরদারের প্রতিশ্রুতি ভারতের স্পষ্ট বার্তা: যেখানেই হোক, সন্ত্রাস দমনে অভিযান চালানোর পূর্ণ অধিকার আছে ইভি আর স্মার্ট গ্যাজেটের জোরে দ্বিগুণের বেশি মুনাফা দেখাল শাওমি ভারতের রেড ফোর্ট হামলার উদ্ধার হওয়া ভিডিও: আত্মঘাতী হামলার সাফাই দিচ্ছিলেন উমর উন-নবী

আরাকান আর্মির অর্থসংকটের সুযোগে বাংলাদেশে ইয়াবা প্রবেশ

অভিনব কৌশলে মাদক পাচার

নানা নতুন কৌশলে মাদক কারবারিরা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবার বড় চালান আনছে। গত নয় মাস ধরে ওষুধ, খাদ্য, নির্মাণসামগ্রী, কৃষি উপকরণসহ নানা পণ্যের বিনিময়ে ইয়াবা, আইস ও অন্যান্য মাদক দেশে প্রবেশ করছে। এ লেনদেন মূলত সাগরের মিয়ানমার অংশে হয়। সেখানে মাছ ধরার নৌযানে পণ্য পৌঁছে দেওয়া হয় আরাকান আর্মির হাতে। বিনিময়ে একই নৌযানেই ইয়াবা ও অন্যান্য মাদক বাংলাদেশে ফেরত আসে।

সাগরপথ ও সীমান্তের রুট

কোস্ট গার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মিয়ানমার থেকে আনা ইয়াবার চালান নাফ নদী পার হয়ে টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়ি ও থানচির দুর্গম এলাকায় প্রবেশ করে। এরপর কমপক্ষে ১৭টি রুটে সারা দেশে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সম্প্রতি কোস্ট গার্ড এক মাসে চারটি চালান আটক করেছে এবং অধিদপ্তরও একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে মূল হোতারা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

আরাকান আর্মি ও পণ্যের চাহিদা

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম দপ্তরের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার জানান, রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য তারা বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সংঘবদ্ধ অপরাধচক্র এই সুযোগে পণ্য দিয়ে ইয়াবা ও আইস সংগ্রহ করছে। তার মতে, এতে একটি আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট কাজ করছে, যার সদস্যরা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ—দুই সীমান্তেই সক্রিয়। শত শত বাহক এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত।

বিনিময়ের ধরন বদলেছে

আগে ইয়াবা-আইসের বিনিময় হতো ডলার, টাকা বা স্বর্ণ দিয়ে। কিন্তু এখন আরাকান আর্মির চাহিদার কারণে বাংলাদেশ থেকে চিনি, সার, পেঁয়াজ, সিমেন্ট, রসুন, লবণ, ভোজ্যতেল, শুঁটকি, চিংড়ি পোনা, টিন, কাঠ, টাইলস, শাড়ি, থ্রি-পিস, কম্বল, প্রসাধনী, গয়না ও মোবাইল ফোন পাচার হচ্ছে। এসব পণ্যের বিনিময়েই ইয়াবা দেশে ঢুকছে।

সাম্প্রতিক অভিযান

১১ আগস্ট চট্টগ্রামের হালিশহরে ৭৫০ বস্তা সিমেন্ট ও দুটি বোটসহ ২০ জন পাচারকারী আটক হয়।
৮ আগস্ট বাঁশখালীতে ১০০ বস্তা সিমেন্ট জব্দ করা হয়, যা মিয়ানমারে পাচার হচ্ছিল।
৩ জুলাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ১০ হাজার ইয়াবাসহ জয়নাল আবেদীন নামে এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে অধিদপ্তর। তিনি ২৪ লাখ টাকার কাপড় দিয়ে ইয়াবার চালান সংগ্রহ করেছিলেন।
কোস্ট গার্ডের কর্মকর্তারা জানান, মাছ ধরার ট্রলারের মাধ্যমে এসব পণ্য গভীর সমুদ্র ঘুরে মিয়ানমারে নেওয়া হয়। সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবেশ করে পণ্য হস্তান্তর করা হয়, এরপর মাদক ফেরত আসে বাংলাদেশে।

অর্থসংকট ও মাদকের রুট

মিয়ানমারের চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মি অর্থসংকটে পড়েছে। তাই তারা ইয়াবা ও অন্যান্য মাদকের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করছে। তবে কোস্ট গার্ডের কর্মকর্তাদের দাবি, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা কেবল বাহক। তদন্তের মাধ্যমে আসল হোতাদের শনাক্ত করা যাবে।

বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব

সামাজিক প্রভাব

ইয়াবা দেশে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তি বাড়ছে, পরিবারে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে এবং অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে অপরাধচক্রের অংশ হয়ে পড়ছে। এর ফলে সামাজিক অবক্ষয়, সহিংসতা এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে।

অর্থনৈতিক প্রভাব

অর্থনৈতিক দিক থেকেও এ পাচার ভয়াবহ ক্ষতির কারণ। কৃষি ও শিল্পে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় চিনি, সার, পেঁয়াজ, সিমেন্টসহ নানা দ্রব্য পাচারের কারণে স্থানীয় বাজারে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এতে দাম বেড়ে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার বৈদেশিক মুদ্রার বদলে পণ্য পাচারের কারণে অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে। বৈধ বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ একই পথে অবৈধ বাণিজ্য জোরদার হয়ে উঠছে।

দীর্ঘমেয়াদি সংকট

যদি এভাবে ইয়াবা পাচার ও পণ্যের বিনিময় চলতে থাকে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমাজে উৎপাদনশীল শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং অপরাধ অর্থনীতি বিস্তৃত হবে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেয়, তবে এটি কেবল সীমান্ত সমস্যা নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

লেবাননের শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় ১৩ নিহত, নতুন সহিংসতার আশঙ্কা

আরাকান আর্মির অর্থসংকটের সুযোগে বাংলাদেশে ইয়াবা প্রবেশ

০১:০৮:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫

অভিনব কৌশলে মাদক পাচার

নানা নতুন কৌশলে মাদক কারবারিরা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবার বড় চালান আনছে। গত নয় মাস ধরে ওষুধ, খাদ্য, নির্মাণসামগ্রী, কৃষি উপকরণসহ নানা পণ্যের বিনিময়ে ইয়াবা, আইস ও অন্যান্য মাদক দেশে প্রবেশ করছে। এ লেনদেন মূলত সাগরের মিয়ানমার অংশে হয়। সেখানে মাছ ধরার নৌযানে পণ্য পৌঁছে দেওয়া হয় আরাকান আর্মির হাতে। বিনিময়ে একই নৌযানেই ইয়াবা ও অন্যান্য মাদক বাংলাদেশে ফেরত আসে।

সাগরপথ ও সীমান্তের রুট

কোস্ট গার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মিয়ানমার থেকে আনা ইয়াবার চালান নাফ নদী পার হয়ে টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়ি ও থানচির দুর্গম এলাকায় প্রবেশ করে। এরপর কমপক্ষে ১৭টি রুটে সারা দেশে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সম্প্রতি কোস্ট গার্ড এক মাসে চারটি চালান আটক করেছে এবং অধিদপ্তরও একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে মূল হোতারা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

আরাকান আর্মি ও পণ্যের চাহিদা

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম দপ্তরের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার জানান, রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য তারা বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সংঘবদ্ধ অপরাধচক্র এই সুযোগে পণ্য দিয়ে ইয়াবা ও আইস সংগ্রহ করছে। তার মতে, এতে একটি আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট কাজ করছে, যার সদস্যরা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ—দুই সীমান্তেই সক্রিয়। শত শত বাহক এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত।

বিনিময়ের ধরন বদলেছে

আগে ইয়াবা-আইসের বিনিময় হতো ডলার, টাকা বা স্বর্ণ দিয়ে। কিন্তু এখন আরাকান আর্মির চাহিদার কারণে বাংলাদেশ থেকে চিনি, সার, পেঁয়াজ, সিমেন্ট, রসুন, লবণ, ভোজ্যতেল, শুঁটকি, চিংড়ি পোনা, টিন, কাঠ, টাইলস, শাড়ি, থ্রি-পিস, কম্বল, প্রসাধনী, গয়না ও মোবাইল ফোন পাচার হচ্ছে। এসব পণ্যের বিনিময়েই ইয়াবা দেশে ঢুকছে।

সাম্প্রতিক অভিযান

১১ আগস্ট চট্টগ্রামের হালিশহরে ৭৫০ বস্তা সিমেন্ট ও দুটি বোটসহ ২০ জন পাচারকারী আটক হয়।
৮ আগস্ট বাঁশখালীতে ১০০ বস্তা সিমেন্ট জব্দ করা হয়, যা মিয়ানমারে পাচার হচ্ছিল।
৩ জুলাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ১০ হাজার ইয়াবাসহ জয়নাল আবেদীন নামে এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে অধিদপ্তর। তিনি ২৪ লাখ টাকার কাপড় দিয়ে ইয়াবার চালান সংগ্রহ করেছিলেন।
কোস্ট গার্ডের কর্মকর্তারা জানান, মাছ ধরার ট্রলারের মাধ্যমে এসব পণ্য গভীর সমুদ্র ঘুরে মিয়ানমারে নেওয়া হয়। সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবেশ করে পণ্য হস্তান্তর করা হয়, এরপর মাদক ফেরত আসে বাংলাদেশে।

অর্থসংকট ও মাদকের রুট

মিয়ানমারের চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মি অর্থসংকটে পড়েছে। তাই তারা ইয়াবা ও অন্যান্য মাদকের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করছে। তবে কোস্ট গার্ডের কর্মকর্তাদের দাবি, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা কেবল বাহক। তদন্তের মাধ্যমে আসল হোতাদের শনাক্ত করা যাবে।

বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব

সামাজিক প্রভাব

ইয়াবা দেশে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তি বাড়ছে, পরিবারে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে এবং অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে অপরাধচক্রের অংশ হয়ে পড়ছে। এর ফলে সামাজিক অবক্ষয়, সহিংসতা এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে।

অর্থনৈতিক প্রভাব

অর্থনৈতিক দিক থেকেও এ পাচার ভয়াবহ ক্ষতির কারণ। কৃষি ও শিল্পে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় চিনি, সার, পেঁয়াজ, সিমেন্টসহ নানা দ্রব্য পাচারের কারণে স্থানীয় বাজারে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এতে দাম বেড়ে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার বৈদেশিক মুদ্রার বদলে পণ্য পাচারের কারণে অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে। বৈধ বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ একই পথে অবৈধ বাণিজ্য জোরদার হয়ে উঠছে।

দীর্ঘমেয়াদি সংকট

যদি এভাবে ইয়াবা পাচার ও পণ্যের বিনিময় চলতে থাকে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমাজে উৎপাদনশীল শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং অপরাধ অর্থনীতি বিস্তৃত হবে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেয়, তবে এটি কেবল সীমান্ত সমস্যা নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হবে।