বরিশালের অলৌকিক সুরের মিশ্রণে জন্ম নিলেন এক চারণ কবি, যিনি শুধু গান-নৃত্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর নাম যজ্ঞেশ্বর দে, ভক্তির উচ্চারণে এবং সাহিত্যিক অঙ্গনে পরিচিত মুকুন্দ দাস নামে। গানের চারণ সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের বাণীকে আমূল সর্বত্র ছড়িয়ে দেন।
শৈশব ও বরিশালে বসবাস
১৮৭৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুকুন্দ দাস (যজ্ঞেশ্বর দে) ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। সাত বছর বয়সে তাঁর পরিবার বরিশালে চলে আসে, যেখানে তাঁর পিতা একটি মুদি দোকান চালাতেন। সেই সময় বরিশালের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মুকুন্দ দাসের পিতার সুরমধুর গানের ক্ষমতা দেখে তাঁকে আদালতে অর্ডারলি হওয়ার সুযোগ দেন।
শিক্ষা ও প্রথম প্রেরণা
বরিশাল জেলা স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি, কিন্তু নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন না—গান, কবিতা, মেঘ, প্রকৃতি তাঁর আকর্ষণ বেশি ছিল। পরবর্তীতে ব্রজমোহন স্কুলে ভর্তি হন কিন্তু অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীনই পড়াশোনা ছেড়ে দেন। তখন বরিশালের শিক্ষাবিদ অশ্বিনী কুমার দত্ত তাঁর গুণ শুনে তাঁর পিতাকে এবং তাঁকেও সাহিত্যের প্রতি উৎসাহ দেন—এটাই পাল্টে দেয় মুকুন্দ দাসের জীবনপথ।

“মাতৃপূজা”—মুকুন্দ দাসের স্বদেশভক্তির নাট্যাভিনয়
১৯০৫ সালে অশ্বিনী কুমার দত্ত বরিশাল টাউন হলে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এক ভাষণ দেন, যেখানে তিনি আবেদন করেন গ্রামাঞ্চলে নাট্যরূপে জাতীয় চেতনা ছড়াতে। এই অনুপ্রেরণায় মুকুন্দ দাস মাত্র তিন মাসে রচনা করলেন নাটক “মাতৃপূজা”, যা দেশপ্রেম ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আবহ নিয়ে মঞ্চস্থ হয়।
গ্রাম্য নাট্যসভার অভিযান
স্বদেশবাদের বক্তব্য গ্রামে ছড়াতে নিজের নাট্যদল গঠন করলেন মুকুন্দ দাস। ১৯০৬ সালে বরিশাল, নোয়াখালী, ত্রিপুরা, সহ নানা অঞ্চলে “মাতৃপূজা” নাট্য মঞ্চস্থ করা শুরু করলেন। ১৯০৬ সালের জুনে বরিশালে অনুষ্ঠিত স্বদেশী উৎসবে নাটকটির অভ্যর্থনা ছিল ব্যাপক, এবং জাতীয় নেতৃবৃন্দও প্রশংসা করেছিলেন।
সাফল্যের প্রভাব ও বাধা
সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৯০৭–০৮ সালের মধ্যে নাটকটি ব্যাপকভাবে মঞ্চস্থ হলো। তবে ব্রিটিশ সরকার একে বিপদসঙ্কেত হিসেবে দেখতে শুরু করে এবং “হিংসার উসকানি” বা বিদ্রোহমূলক বক্তব্যের অভিযোগে নাটকের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা চাপায়। মুকুন্দ দাস ১৯০৮ সালে গ্রেপ্তার হন এবং তাঁর নাটক বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

নিষেধাজ্ঞার পরবর্তী জীবন
১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন মুকুন্দ দাসও। তাঁর নাটক ‘মাতৃপূজা’ আবার নিষিদ্ধ হলে তিনি সামাজিক নাট্য-সাহিত্য রচনায় মন দেন, কিন্তু তা দ্রুত নিষিদ্ধ হয় এবং তিনি অবশেষে গান পরিবেশনে সীমাবদ্ধ হন। ১৭ মে ১৯৩৪—জীবনের সন্ধ্যাকালে তিনি এক আত্মীয়শূন্য রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
বিশেষ থিম: বরিশালের সাহসী চারণকবি
বরিশাল ও চারণ সাহিত্যে মুকুন্দ দাস—বরিশালে বেড়ে ওঠা এক চারণ কবি, যিনি কেবলমাত্র একজন শিল্পী নন, বরং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সাহসিকভাবে যুদ্ধে নেমে সমাজকে জাগ্রত করেছিলেন। তিনি গ্রামাঞ্চলে নাট্যসভার মাধ্যমে সরাসরি স্বাধীনতা চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর নাটক ‘মাতৃপূজা’ ছিল স্বদেশী চেতনার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, যা গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যেও দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















