ইতিহাস–সংস্কৃতির ১০১–ধারার মতো এক সড়কভ্রমণ
থাইল্যান্ডের হাইওয়ে ১০১ এমন এক গ্রামীণ মহাসড়ক, যা ধরে ভ্রমণ করলে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভূদৃশ্যের প্রাথমিক ধারণা যেন একটি ১০১–কোর্সের মতোই হাতেকলমে শেখা যায়। মধ্য থাইল্যান্ডের কামফেংফেট থেকে উত্তর–পূর্বে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরের নান পর্যন্ত এই রাস্তা ছোট শহর, ধানক্ষেত আর সবুজ টিলা পেরিয়ে এগিয়েছে; নান শহর আবার লাওস সীমান্ত থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে।
রুটের সারসংক্ষেপ: কোন কোন জায়গা দেখবেন
• কামফেংফেটের প্রতিরক্ষা প্রাচীর ও ঐতিহাসিক পার্ক
• সুখোথাইয়ের ওয়াত সি চুমে বিখ্যাত ফ্রা আচানা বুদ্ধমূর্তি
• সি সাচ্চানালাইয়ে সাথর্ন স্বর্ণ বস্ত্র জাদুঘরের নকশা–তাঁত ও লোকঐতিহ্য
• ফ্রায়ে শহরের মনোরম সেগুনকাঠের স্থাপত্য
• ফায়ে মুয়াং ফি–তে বাতাস–বৃষ্টির ক্ষয়ে গড়া অদ্ভুত শিলাস্তম্ভ
• নান শহরের ওয়াত ফুমিনের খ্যাতিমান প্রাচীরচিত্র
কামফেংফেট: পিং নদীর ধারে প্রাচীরঘেরা স্মৃতি
পিং নদীর পূর্বতীরে, সুখোথাই থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ–পশ্চিমে, প্রায় ৩০ হাজার মানুষের ছোট্ট বাজারশহর কামফেংফেট। শহরের ঐতিহাসিক পার্কটি ইউনেসকোর ‘সুখোথাই ও সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক নগরসমূহ’ বিশ্বঐতিহ্য স্থানের অংশ। ১৩শ থেকে ১৫শ শতকের সুখোথাই যুগে এটি ছিল প্রাচীন সিয়ামের (বর্তমান থাইল্যান্ড) একটি প্রতিরক্ষা প্রহরীচৌকি। এখনো ল্যাটেরাইট পাথরের প্রাচীর অটুট থেকে সেই অতীতকে মনে করায়।
শহরে ভোর–সন্ধ্যায় হাঁটার জন্য নদীতীরের পার্ক জনপ্রিয়। রাতে নৈশবাজারে নানা রকমের গরম–গরম থাই খাবারের চমৎকার আয়োজন থাকে। পার্কের উত্তর দিকে জঙ্গলের নীরব পরিবেশে ওয়াত চাং রপ মন্দিরে ভাঙা স্তূপের চারপাশে হাতির মূর্তি ঘিরে থাকা স্থানটিও দেখার মতো।

সুখোথাই: ফ্রা আচানা বুদ্ধ ও সুখোথাই শিল্পরীতি
কামফেংফেট থেকে হাইওয়ে ১০১ ধরে উত্তর–পূর্বে, তারপর ১২ নম্বর মহাসড়কে বাঁয়ে গেলেই সুখোথাই ঐতিহাসিক পার্কের উত্তর অংশে ওয়াত সি চুম। এখানে ১৫ মিটার উচ্চতা ও ১১ মিটার প্রস্থের বিশাল বসা বুদ্ধ—ফ্রা আচানা—ইটের বেষ্টনীতে বসে আছে। সুখোথাই যুগের বুদ্ধমূর্তির বৈশিষ্ট্য—স্নিগ্ধ ডিম্বাকৃতি মুখ, সংযত–নির্বিঘ্ন হাসি, গড়ানো অঙ্গভঙ্গি—এই মূর্তিতে স্পষ্ট। মাটিকে স্পর্শ করে ‘পৃথিবীকে সাক্ষী ডাকা’ ভঙ্গিতে হাঁটুর ওপর ঝুলে থাকা সরু–লম্বা আঙুলে ভক্তরা সোনালি পাত লাগিয়ে রাখেন।
সুখোথাই যুগেই প্রথম দাঁড়ানো ও হাঁটতে থাকা বুদ্ধমূর্তি গড়া শুরু হয়। পার্কের ছিমছাম উদ্যানে এমন অনেক অনুপম ভাস্কর্য ছড়িয়ে আছে। কমলাসদৃশ কলসাকৃতি স্তূপও সুখোথাই স্থাপত্যরীতির চিহ্ন—ওয়াত মহাথাত ও ওয়াত ত্রাপাং ঙ্গুয়েনের স্তূপে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখা যায়।
সি সাচ্চানালাই: তাঁতে বোনা ঐতিহ্য, লোকজ জীবনের জাদুঘর
সুখোথাই বিমানবন্দর পেরিয়ে ধানক্ষেত ও গ্রাম পেরোতে পেরোতে ১০১ নম্বর সড়ক পৌঁছে দেয় সি সাচ্চানালাইয়ে। ১০১ ও ১০২ নম্বর সড়কের সংযোগস্থলে সাথর্ন স্বর্ণ বস্ত্র জাদুঘরে থাই পৌয়ান জনগোষ্ঠীর বোনা নকশাদার ‘ফাসিন’ (মোড়ানো স্কার্ট) দেখে–কিনে নেওয়ার সুযোগ আছে। জাদুঘরের পেছনের উঠোনে মাছধরা ফাঁদ, আখচাপা, ঘরোয়া কৃষি–ঔজার—এমন নানা লোকঐতিহ্যের কারিগরি সাজানো।
ফ্রায়ে: সেগুনকাঠের শহর, বার্মিজ ঢঙের মন্দির
এখান থেকে ১০১ নম্বর সড়ক উত্তরাঞ্চলের টিলায় ঢুকে পৌঁছে যায় ফ্রায়ে। উনিশ শতকের শেষভাগে সেগুন ব্যবসার জোরে শহরটি বেড়ে ওঠে; তখনকার অনেক সেগুনকাঠের বাড়িঘর আজও সংরক্ষিত। ওয়াত চম সুয়ান মন্দিরে বহুস্তর ছাদ ও খচিত প্যানেলে বার্মিজ প্রভাব দেখা যায়—তৎকালীন অনেক ব্যবসায়ীই ছিলেন মিয়ানমার থেকে আসা। ভংবুরি হাউস জাদুঘর ও প্রাতুবজাই হাউসও সেগুন স্থাপত্যের আকর্ষণীয় উদাহরণ। শহরের মন্দিরচত্বরেও মাঝে–মধ্যে স্থানীয়দের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রে বাজনার আয়োজন চোখে পড়ে।

ফায়ে মুয়াং ফি: বাতাস–বৃষ্টির রহস্যময় ভাস্কর্য
ফ্রায়ে ছেড়ে সামান্য বাঁক নিলে ফায়ে মুয়াং ফি—স্থানীয়দের কাছে ‘ভূতেদের বাগান’—আসলেই এক মজার জায়গা। বাতাস–বৃষ্টির ক্ষয়ে তৈরি অদ্ভুত বালুকাপাথরের স্তম্ভ ও খাড়া–খাড়া দেয়াল দেখে কারও কারও মনে পড়ে চাঁদ বা মঙ্গলের পৃষ্ঠের কথা। কেন্দ্রীয় সমভূমি ও পাহাড় পেরিয়ে এরকম ভিন্ন ভূদৃশ্য থাইল্যান্ডের ভূপ্রকৃতির বৈচিত্র্য মনে করায়।
নান: মুরাল, তাঁত আর নীরবতার শহর
ফায়ে মুয়াং ফি থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার গাড়ি চালালে নানে পৌঁছানো যায়। লাওস সীমান্তের দিকে তুলনামূলক দুর্গম অবস্থান হওয়ায় পর্যটকের ভিড় কম, কিন্তু হস্তশিল্প, তাঁত ও মন্দির–মুরালের ঐতিহ্যে শহরটি সমৃদ্ধ।
ওয়াত ফুমিনের বিখ্যাত মুরালগুলো—যদিও আবছা—বুদ্ধের জীবনের দৃশ্যের সঙ্গে স্থানীয় জীবনের ছবি, যেমন অক্টোবরের লংবোট দৌড় বা প্রেমালাপরত যুগল—এক অদ্ভুত মিশেলে তুলে ধরে। কাছের ওয়াত মিং মুয়াং–এ একই থিমে উজ্জ্বল ও আধুনিক মুরাল দেখা যায়; এখানেই শহরের পবিত্র ‘সিটি পিলার’ স্থাপিত। শহরের ওপর থেকে নীরব দৃশ্য দেখতে চাইলে পাহাড়চূড়ার ওয়াত খাও নোই–এর দর্শনীয় স্থানটি উপযুক্ত, যেখানে দাঁড়ানো একটি বুদ্ধমূর্তি যেন পুরো নানকে নজরে রাখে।
তাড়া না থাকলে নানে দু–একদিন থামা যায়—জাতীয় জাদুঘর, তাঁত–দোকান, নির্ঝঞ্ঝাট মন্দির আর বন্ধুসুলভ ভিক্ষুদের সঙ্গে কথাবার্তা আপনাকে ধীরগতি ভ্রমণের স্বাদ দেবে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে ব্যাংককে উড়ে গিয়ে সেখান থেকে সুখোথাইয়ের ফ্লাইট ধরতে পারেন; ফেরার ফ্লাইট নান থেকে ধরলে রুটটি চক্রাকারে সম্পন্ন হয়। সুখোথাইয়ে নামার পর একমুখী গাড়ি বা মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে অল্প পথ গিয়ে কামফেংফেটে ট্যুর শুরু করা সুবিধাজনক।

কোথায় থাকবেন ও কী খাবেন
কামফেংফেট: চাকুংরাও রিভারভিউ হোটেলে থাকা যায়। সন্ধ্যায় নৈশবাজার থেকে প্যাড থাই (ভাজা নুডলস), গ্যাং পানেং (লাল কারি), ইয়াম হুয়া প্লি (কলা–ফুলের সালাদ)সহ অর্ডারমতো অগণিত আইটেম পাওয়া যায়।
সুখোথাই: লেজেন্ডহা রিসোর্টে থাকা ও ‘সুখোথাই নুডলস’ চেখে দেখা যায়—এতে কিমা করা শূকরমাংস, শুকনা চিংড়ি, মুগের অঙ্কুর, লম্বা শিম, খাসির ঝুরি, পেঁয়াজকলি ও বাদাম থাকে; শুকনোভাবেও, হালকা ঝোল দিয়েও পরিবেশন করা হয়। মাই ক্লাং ক্রুং রেস্তোরাঁয় এই খাবারটি পুরোনো বাড়ির আবহে পরিবেশন করা হয়।
ফ্রায়ে: জিঞ্জারব্রেড হাউস গ্যালারিতে থাকা যায়। প্রাতুচাই নৈশবাজারে ভাজা মাছ, গ্রিল করা মুরগি থেকে শুরু করে নানা রুচির তরকারি মেলে।
নান: পুখা নানফা হোটেলে থাকা ও নদীর ধারে সোনাঝরা বিকেলের দৃশ্য দেখতে দেখতে হুয়েন জাও নাং রেস্তোরাঁয় খাওয়া যেতে পারে।
কেন এই রুটটি ‘থাইল্যান্ড বোঝার’ সেরা শুরু
হাইওয়ে ১০১ একসঙ্গে কয়েকটি বিষয় শেখায়—সুখোথাইয়ের শিল্পজাগরণ, সেগুন–বাণিজ্যের ইতিহাস, গ্রামীণ তাঁত–ঐতিহ্য, অদ্ভুত ভূপ্রকৃতি, আর নানের লোকজ মুরালে ধরা সাধারণ মানুষের হাসি–কান্না। সময় থাকলে দু–একদিন বাড়তি নিয়ে এই সড়কভ্রমণ থাইল্যান্ডের মানুষ, প্রকৃতি আর ইতিহাসকে ধীরে–সুস্থে চিনে নেওয়ার সহজতম উপায় হয়ে উঠতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















