২০১২ সালে লন্ডন স্কুল অব পাপেট্রিতে পড়াশোনার সময় জাপানি শিল্পী সেরি ইয়ানাই এবং তার কানাডিয়ান সহপাঠী ড্যানিয়েল উইশেস প্রতিষ্ঠা করেন ছায়ানাট্য সংস্থা মোচিনোশা। বর্তমানে সাইতামার কোশিগায়া-ভিত্তিক এই সংস্থা বিশ্বের ৫০টিরও বেশি শহরে পরিবেশনা করেছে।
ছায়ানাট্য কী?
ছায়ানাট্যে মূল চরিত্রগুলোর কাহিনি প্রকাশ পায় তাদের ছায়ার মাধ্যমে। পুতুলকে নাড়াচাড়া করে তৈরি হয় ছায়া, আর সেই ছায়াই হয়ে ওঠে কাহিনির প্রাণ।
শিল্পে প্রবেশের অনুপ্রেরণা
কৈশোরে সেরি ইয়ানাই গভীরভাবে প্রভাবিত হন হিদেকি নোদার নাটক হানশিন: হাফ-গড দেখে। এটি তাকে বুঝিয়েছিল নাটক, সঙ্গীত, গল্প ও শরীরী প্রকাশের সমন্বয়ে এক পূর্ণাঙ্গ শিল্প। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর নাটক পড়লেও জাপানে নাট্যসংস্থা গড়ে ওঠা কঠিন বুঝে তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে।
কেন পুতুল?
ইউকে-তে তিনি দেখেন ব্লাইন্ড সামিট থিয়েটার–এর এক অভিনব পাপেট শো, যেখানে তিনজন শিল্পী কার্ডবোর্ড পুতুলকে জীবন্ত করে তুলেছিল। সেই অভিজ্ঞতাই তাকে পুতুলনাট্যে পথচলার সিদ্ধান্তে অনুপ্রাণিত করে।
সূচনায় সংগ্রাম
মোচিনোশা প্রতিষ্ঠার পর স্নাতক শেষ করে দুজনকেই নিজ নিজ দেশে ফিরতে হয়। কেবল স্কাইপ ও ইমেইলের মাধ্যমে যোগাযোগে কাজ এগোনো কঠিন হয়ে পড়েছিল। প্রায় তিন বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তারা নিজেদের ভিশন খুঁজে পান।

মোচিনোশার বৈশিষ্ট্য
জাপানের অন্য ছায়ানাট্যের তুলনায় ভিন্নভাবে তারা দর্শকের সামনে থেকেই পুতুল নাড়াচাড়া করেন। পাশাপাশি আধুনিক ও অ্যানালগ কৌশলের মিশ্রণে নতুন কিছু তৈরি করেন।
ঐতিহ্য ও অনুপ্রেরণা
জাপানে এডো যুগে (১৬০৩–১৮৬৭) ছায়ানাট্য জনপ্রিয় ছিল, বিশেষ করে উৎসুশি-এ নামে ইউরোপীয় প্রজেক্টরের মাধ্যমে। তবে আজকের ছায়ানাট্য মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের। মোচিনোশা আবার প্রভাবিত হয়েছে বালিনিজ ওয়ায়াং কুলিত ঐতিহ্য থেকে, যেখানে দর্শক উভয় দিক থেকেই নাটক উপভোগ করতে পারে।
অ্যানিমের মতো পরিবেশনা
তাদের শোগুলোকে অনেকেই ‘অ্যানিমে-সুলভ’ বলেন। কারণ, প্রতিটি নাটকের জন্য আগে স্টোরিবোর্ড আঁকা হয়, যা অ্যানিমে তৈরির মতো। ৬০ মিনিটের একটি শোতে ২০০ থেকে ৪০০ কাগজের পুতুল ব্যবহার করা হয়।
পুতুল তৈরির প্রক্রিয়া
প্রথমে গল্প ও স্টোরিবোর্ড তৈরি করে পুতুলের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। এরপর আঁকা, কাটা, রঙ করা ও জোড়া লাগানো—সব মিলিয়ে তিন মাস দিন-রাত পরিশ্রম করতে হয়।
কাজের বণ্টন
ড্যানিয়েল গল্পের আইডিয়া ও চিত্রনাট্য লিখেন। সেরি আঁকতে ভালোবাসেন, তাই তিনি স্টোরিবোর্ড ও শিল্পকর্ম সামলান।
আলোচিত থিম
তাদের নাটকগুলো সাধারণত ফ্যান্টাসি ও সায়েন্স ফিকশন ঘরানার। যুদ্ধ ও পরিবেশ ধ্বংসের মতো বিষয় থাকে, তবে সরাসরি নয়—বরং এক ভিন্ন জগতের গল্পের মধ্যে আশার বার্তা হিসেবে ফুটে ওঠে।
জনপ্রিয় নাটক “স্পেস হিপ্পো”
২০১৬ সালে শুরু হওয়া এই নাটক ডোনাল্ড ট্রাম্প-সদৃশ এক রাজনীতিক ও এক বিজ্ঞানীর বিতর্ক দিয়ে শুরু হয়। পৃথিবী ধ্বংস থেকে রক্ষার নাম করে রাজনীতিক একটি জলহস্তীকে মহাকাশে পাঠায়। এরপর শুরু হয় সেই হিপ্পোর রোমাঞ্চকর মহাকাশযাত্রা।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
তাদের অন্যতম স্মরণীয় পরিবেশনা লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে, যেখানে রাফায়েলের চিত্রকর্মের মাঝে তারা অভিনয় করেন। দর্শক প্রতিক্রিয়া দেশভেদে ভিন্ন—জাপানে নীরবতা, আর আমেরিকা বা ব্রাজিলে হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হাসি।
ব্যর্থতা ও চ্যালেঞ্জ
কানাডায় এক শোতে মাঝপথে সাউন্ড সিস্টেম ভেঙে গেলে তারা আতঙ্কের মধ্যেই সঙ্গীত ছাড়াই অভিনয় চালিয়ে যান। সেই অভিজ্ঞতা ছিল সেরির জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত।
প্রভাব ও অনুপ্রেরণা
সেরি অনুপ্রাণিত হয়েছেন লেখক আঙ্গো সাকাগুচি ও মাঙ্গাশিল্পী রুমিকো তাকাহাশির কাছ থেকে। আলো-ছায়া নিয়েও তার গভীর সংবেদনশীলতা রয়েছে।
গর্বের মুহূর্ত
তারা একসময় শুধু স্বপ্ন দেখতেন লন্ডনে শো করার। আজ সেই স্বপ্ন বাস্তব হয়ে গেছে। এতে তারা নিজেদের পথচলায় গর্বিত।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
তাদের আজীবনের স্বপ্ন জাপান ও যুক্তরাজ্যে স্থায়ী ঘাঁটি তৈরি করা। আগামী দশ বছরে এ লক্ষ্য পূরণের আশা করছেন।
সর্বশেষ পরিবেশনা
এডিনবার্গ ফেস্টিভ্যাল ফ্রিঞ্জে তারা সম্প্রতি জাপানি শুঙ্গা (ঐতিহ্যবাহী ইরোটিক শিল্প) অবলম্বনে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এক নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। নাটকটি প্রশংসা পেয়েছে, কিছু শো ছিল পূর্ণ দর্শকসংখ্যায় বিক্রি শেষ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















