বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে কৌতুক অভিনয়ের কথা উঠলেই প্রথমে যাঁর নাম উচ্চারিত হয় তিনি হলেন দিলদার। প্রকৃত নাম দেলোয়ার হোসেন হলেও দর্শকদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন শুধু ‘দিলদার’ নামেই। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রায় পাঁচ শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি ঢালিউডে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী হাস্যরসের নায়ক হিসেবে।
জন্ম ও শৈশব
দিলদারের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৩ জানুয়ারি চাঁদপুরে। শৈশব ও কৈশোরে সাধারণ পরিবেশেই বেড়ে ওঠেন তিনি। এসএসসি পাস করার পর আর উচ্চশিক্ষায় অগ্রসর হননি। ছোটবেলা থেকেই মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর প্রবল ঝোঁক ছিল তাঁর মধ্যে, যা পরবর্তীতে তাঁকে চলচ্চিত্র জগতে নিয়ে আসে।
চলচ্চিত্রে আগমন
১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কেন এমন হয়’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দিলদারের চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। প্রথম থেকেই তাঁর সংলাপ, ভঙ্গিমা ও মুখভঙ্গি দর্শকদের দৃষ্টি কাড়ে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন নির্মাতা ও প্রযোজকদের কাছে নির্ভরযোগ্য কৌতুক অভিনেতা।
দুটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র
১. আব্দুল্লাহ
‘আব্দুল্লাহ’ ছিল দিলদারের অভিনীত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবি। এই চলচ্চিত্রে তিনি প্রথমবারের মতো নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর বিপরীতে নায়িকা ছিলেন নূতন। যদিও ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সফলতা পায়নি, তবু দর্শকদের মনে এক ভিন্নধর্মী ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়। এই ছবির মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, তিনি কেবল কৌতুকশিল্পীই নন, নায়কোচিত চরিত্রও ধারণ করতে সক্ষম। চলচ্চিত্র সমালোচকরা বলেন, এই ছবির ব্যর্থতা দিলদারের জনপ্রিয়তায় কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি; বরং কৌতুক অভিনেতা হিসেবে তাঁর অবস্থান আরও দৃঢ় হয়।
২. তুমি শুধু আমার
২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘তুমি শুধু আমার’ ছবিটি দিলদারের ক্যারিয়ারের সেরা অর্জনগুলির একটি। এই ছবিতে অসাধারণ কৌতুকাভিনয়ের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ছবির চরিত্রে তিনি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন হাস্যরসাত্মক দিক তুলে ধরেন, যা দর্শকদের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে যায়। এই কাজ প্রমাণ করে যে, দিলদার কেবল জনপ্রিয় অভিনেতা নন, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও পাওয়ার যোগ্য শিল্পী।
আরও জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ও অবদান
৩. কী প্রেমে পড়া যায় না (১৯৯৭)
এই ছবিতে দিলদার ছিলেন এক হাস্যরসাত্মক পার্শ্বচরিত্রে, যিনি মূল কাহিনির রোমান্টিক টেনশনকে ভেঙে দিয়ে দর্শকদের বারবার হাসতে বাধ্য করতেন। ছবিটির নায়ক-নায়িকার প্রেমকাহিনির মাঝে দিলদারের সংলাপ এবং তার নির্দোষ অথচ বুদ্ধিদীপ্ত চরিত্র দর্শকদের মনে আলাদা মাত্রা যোগ করেছিল।
৪. ব্যাচেলর (২০০১)
তরুণ প্রজন্মকেন্দ্রিক গল্পের এই ছবিতে দিলদার ছিলেন এক প্রাজ্ঞ অথচ মজাদার চরিত্র। তিনি গল্পের তরুণ নায়কদের পরামর্শ দিয়ে আবার নিজেই মজার মজার পরিস্থিতি তৈরি করতেন। শহুরে জীবনের টানাপোড়েনকে তাঁর অভিনয় এক অনন্য হাস্যরসে ভরিয়ে দিয়েছিল।
৫. বেদের মেয়ে জোসনা (১৯৮৯)
বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বাণিজ্যিকভাবে সফল ছবিতে দিলদারের ভূমিকাও ছিল স্মরণীয়। ছবিটির মূল কাহিনি ছিল রোমান্টিক ও নাটকীয়, তবে দিলদারের কমেডি দৃশ্যগুলো পুরো সিনেমাটিকে ভারসাম্যপূর্ণ করে তোলে। অনেক দর্শক বলেন, তাঁর উপস্থিতি ছাড়া ছবিটি এত প্রাণবন্ত হতো না।
৬. এইটো প্রেম (১৯৯৫)
এ ছবিতে তিনি ছিলেন এক গ্রামীণ চরিত্রে, যিনি সাধারণ মানুষের সহজ-সরল জীবনযাপনকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর হাস্যরস একদিকে যেমন দর্শকদের আনন্দ দিয়েছে, তেমনি গ্রামীণ সমাজের বাস্তবতাকেও উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরেছে।
৭. জীবন সাথী (১৯৯৮)
এ ছবিতে দিলদার ছিলেন পরিবারের এক ঘনিষ্ঠ সদস্যের ভূমিকায়। কাহিনির আবেগঘন দৃশ্যের মাঝে তাঁর কৌতুক দর্শকদের চোখের জল ও হাসি একসাথে এনেছিল। দর্শকরা বলেছিলেন, দিলদারের এই ভারসাম্য রক্ষার ক্ষমতাই তাঁকে অনন্য করে তুলেছে।
৮. কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩)
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের এক যুগান্তকারী ছবিতেও দিলদারের হাস্যরসাত্মক অভিনয় ছিল দর্শকদের বিশেষ আনন্দের উৎস। সালমান শাহ ও মৌসুমীর প্রেমকাহিনির মাঝে দিলদারের চরিত্র কাহিনিকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। এই ছবির মাধ্যমে তিনি নতুন প্রজন্মের দর্শকদের কাছেও সমান জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তিত্ব
চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্র যতটা প্রফুল্ল, ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি ছিলেন তেমনই প্রাণবন্ত। শুটিং সেটে সবার মাঝে হাসি ছড়িয়ে দিতেন তিনি। তাঁর উপস্থিতি মানেই ছিল এক অন্যরকম উদ্দীপনা। এ জন্যই সহকর্মীরা তাঁকে ডাকতেন ‘হাসির ফেরিওয়ালা’।
পরিবার ও ব্যক্তিগত জীবন
দিলদারের স্ত্রী ছিলেন রোকেয়া বেগম। তাঁদের দুটি কন্যা রয়েছে—মাসুমা আখতার (রুমা) এবং জিনিয়া আফরোজ (শোমা)। প্রথমজন দাঁতের চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। পরিবারকে তিনি সবসময় প্রাধান্য দিতেন। রাত ১০টার পর আর শুটিংয়ে থাকতেন না; পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতেন।
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড
অভিনয়ের বাইরে দিলদার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত ছিলেন। তিনি বিএনপির সহযোগী সংগঠন ‘জিয়া সাংস্কৃতিক সংসদ’-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
মৃত্যু
২০০৩ সালের ১৩ জুলাই, মাত্র ৫৮ বছর বয়সে দিলদার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর আকস্মিক প্রস্থান ঢালিউডে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করে। হাসির জগতে তিনি যে শূন্যতা রেখে গেছেন, তা আজও পূরণ হয়নি।
উত্তরাধিকার
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দিলদারের অবস্থান আজও অনন্য। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলির সংলাপ ও ভঙ্গিমা এখনও দর্শকের মুখে মুখে ফিরছে। ‘আব্দুল্লাহ’ ও ‘তুমি শুধু আমার’ ছাড়াও অসংখ্য চলচ্চিত্রে তাঁর হাস্যরস চিরকাল মনে থাকবে। তিনি ছিলেন এক প্রজন্মের প্রিয় শিল্পী এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে হাসির এক চিরন্তন প্রতীক।