খ) রাঢ়ী ব্রাহ্মণ-পুত্রেষ্টি যাগ সম্পন্ন জন্য আদিশূর কান্যকুব্জ হইতে সাগ্নিক বেদজ্ঞ পঞ্চ গোত্রিয় পঞ্চ ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশে আনেন। তাহাদের নাম দক্ষ, ভট্টনারায়ণ, শ্রীহর্ষ, বেদগর্ভও ছান্দড়। ইহাদের সন্তান সন্ততি কেহ রাঢ়দেশে এবং কেহ বরেন্দ্রভূমে বাস করেন। যাহারা রাঢ় দেশে বাস করেন, তাহারাই রাঢ়ী ব্রাহ্মণ হইলেন। কিন্তু হন্টার সাহেব বলেন, যে মহারাষ্ট্রীয়দের আক্রমণ সময় রাঢ়ীশ্রেণি ব্রাহ্মণেরা পশ্চিম বাঙ্গালা হইতে আসিয়া রাজসাহী জেলায় বাস করে। রাজসাহী বরেন্দ্রভূমি এবং হন্টার সাহেবের “পশ্চিম-বাঙ্গালা” বোধ হয় রাঢ়দেশ। এই দুই প্রদেশ পদ্মা নদী দ্বারা বিচ্ছেদ হইয়াছে। মহারাষ্ট্রীয়দের পক্ষে পদ্মানদী পার হইয়া রাজসাহী আক্রমণ করা কঠিন বিবেচনায়, পশ্চিমবাঙ্গালা হইতে রাঢ়ীশ্রেণি ব্রাহ্মণ যে রাজসাহীতে বাস নির্দেশ করেন, তাহা হন্টার সাহেবের অসঙ্গত কথা বলিয়া বোধ হয় না। কান্যকুব্জাগত পঞ্চ ব্রাহ্মণ মধ্যে দক্ষের ১৬, ভট্টনারায়ণের ১৬, শ্রীহর্ষের ৪, বেদগর্ভের ১২ এবং ছান্দড়ের ৮ সন্তান জন্মে। অতএব রাঢ়ীশ্রেণি ব্রাহ্মণেরা বলেন, “পঞ্চ গোত্র ছাপান্ন গাঁই তাহা ছাড়া ব্রাহ্মণ নাই।” বারেন্দ্রশ্রেণি ব্রাহ্মণের একশত গাঁই এবং ইহাদের আদিপুরুষ সুষেণ প্রভৃতি পঞ্চ ব্রাহ্মণ। ইহারাও কান্যকুব্জাগত পঞ্চ ব্রাহ্মণের সন্তান।” “কালক্রমে যখন ভ্রাতৃগণ মধ্যে অপ্রণয় ও বিদ্বেষ জন্মিল তখনই রাঢ়ী ও বারেন্দ্রগণ পরস্পর পৃথক হন। তৎকালে যাহারা পৃথক হইলেন, তাহারা পুনর্বার রাজার নিকট নিজ নিজ বাসের জন্য আরও কতকগুলি গ্রাম প্রাপ্ত হইলেন। সেই গ্রামগুলি বরেন্দ্রভূমের মধ্যে নির্দিষ্ট হইল। সুতরাং উহা রাঢ়দেশের ছাপান্ন গ্রাম নামমালার মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না।” রাঢ়ী শ্রেণি ব্রাহ্মাণগণের ৫৬ গাঁই মধ্যে আট গাঁই নবগুণ বিশিষ্ট এবং কুলীন বলিয়া প্রসিদ্ধ। যথা বন্দো, চট্ট, মুখুটি, ঘোষাল, পুতিত্বও, গাঙ্গুলি, কাঞ্জিলাল, কুন্দগ্রামী। এই আট বংশে সর্বসমেত উনিশ জন কুলীন হইলেন। ইহাদের অধস্তন সন্তানগণ মধ্যে পালধি, পাকড়াশি, বটব্যাল প্রভৃতি বংশগুলি অষ্টগুণবিশিষ্ট হওয়াতে শ্রোত্রিয় বলিয়া প্রসিদ্ধ হইল। আবার আদানপ্রদানে অসাবধান থাকায় দীর্ঘাঙ্গী, ঘন্টেশ্বরী প্রভৃতি বংশ গৌণ কুলীন বলিয়া পরিচিত হইল। এই রাঢ়ীশ্রেণি ব্রাহ্মহ্মগণের কোন শাখায় কত গাঁই তাহা নিম্ন তালিকায় জানা যাইবে।
কুলীনেরা কুলীনের সঙ্গে আদান প্রদান করিবেন এবং কুলীন শ্রোত্রিয়ের কন্যা গ্রহণ করিতে পারিবেন কিন্তু শ্রোত্রিয়কে কন্যা দান করিতে পারিবেন না, যদি করেন, তাহারা কুলভ্রষ্ট হইয়া বংশজ নামে পরিচিত হইবেন। যাহারা বংশজ হইলেন, তাহারা মর্যাদায় গৌণ কুলীনের সমতুল্য হইবেন।
এই রাঢ়ী শ্রেণি ব্রাহ্মণগণের সংখ্যা রাজসাহীতে অতি অল্প। রাজসাহীতে আড়ানী, পাঁকা, কামারগাঁ, দমদমা, বান্দাইখারা, মহাদেবপুর, প্রভৃতি স্থানে অল্প সংখ্যক রাঢ়ী শ্রেণি ব্রাহ্মণ বাস করে। পাঁকার রাঢ়ী ব্রাহ্মণেরা পুঁঠিয়া রাজার গুরুবংশ। মহাদেবপুরের ও ডিহিবিসার জমিদারগণ রাঢ়ীশ্রেণি ব্রাহ্মণ।
(গ) বৈদিক ব্রাহ্মণ-আদিশূর যে ৫ জন ব্রাহ্মণ কান্যকুব্জ হইতে বঙ্গদেশে আনেন বৈদিক ব্রাহ্মণেরা তাহাদের বংশীয় নহে। ইহারা বঙ্গদেশের আদিম নিবাসীও নহে। ইহাদের বল্লালসেন প্রদত্ত কৌলীন্য মর্যাদা না থাকিলেও ইহাদের কোন একপ্রকার কৌলীন্য মর্যাদা আছে। যাহারা সৎক্রিয়ান্বিত তাহারাই কুলীন বলিয়া প্রসিদ্ধ। ইহাদের গাঁই নাই; কিন্তু ইহাদের মধ্যে অনেক গোত্র আছে তন্মধ্যে শাণ্ডিল্য, কাশ্যপ, বাৎস্য প্রভৃতি ২৪টি গোত্র প্রসিদ্ধ। ইহা কথিত আছে যে, বল্লালসেনের কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত হইবার পর সাগ্নিক ব্রাহ্মণের অভাব হইলে রাজা শ্যামলবর্ণ কান্যকুব্জ হইতে ৫ জন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশে আনেন। তাহাদেরই বংশে বৈদিক ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হয়। এই বৈদিক ব্রাহ্মণ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত, দাক্ষিণাত্য ও পাশ্চাত্য। পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মহ্মণ কান্যকুব্জ হইতে এবং দাক্ষিণাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণগণ কেশরীবংশীয় রাজাদের সময় উৎকল হইতে বাঙ্গালায় আইসেন। পাশ্চাত্য বৈদিকেরা দুইভাগে বিভক্ত-জোঁয়াড়ি ও কোঁয়াড়ি। জোঁয়াড়ির অপভ্রংশে জোয়াড়ি একটি গ্রাম রাজসাহী জেলায় আছে এবং সেই গ্রামের বৈদিক ব্রাহ্মণেরা প্রসিদ্ধ। জোঁয়াড়িদিগের মধ্যে শাণ্ডিল্য, সাবর্ণ, ভরদ্বাজ, বশিষ্ট ও মৌদগল্য গোত্রীয় বংশগুলি কুলীন। রাজসাহীতে বৈদিক শ্রেণি ব্রাহ্মণের সংখ্যা অতি কম। জোঁয়াড়ি (জোয়াড়ি), লালুর, বান্দাইখারা প্রভৃতি স্থানে অল্প সংখ্যক মাত্র আছে। ইহারা প্রায়শ দাসত্ব স্বীকার করে না। কেহ কেহ গুরুর কার্য এবং যাজকের কার্য নির্বাহ করিয়া থাকে।
(ঘ) বর্ণ ব্রাহ্মণ-রাজসাহী জেলায় এ ব্রাহ্মণের সংখ্যা অতি কম। নীচ শূদ্রের যাজক কার্য করিয়া ইহারা জীবিকা নির্বাহ করে। ইহারা অপকৃষ্ট শূদ্রের দান গ্রহণে পতিত হয়। এ শ্রেণির ব্রাহ্মণেরা নিতান্ত দরিদ্র।
(ঙ) কনৌজ ব্রাহ্মণ-এ ব্রাহ্মণের সংখ্যা এত কম যে দুই শতের বেশি হইবে না। ইহারা কান্যকুব্জাগত পশ্চিমা ব্রাহ্মাণ বলিয়া পরিচয় দেন। ইহাদের অনেকে পশ্চিম দেশ হইতে কন্যা আনিয়া বিবাহ করেন এবং পশ্চিম দেশীয় ব্রাহ্মণগণের সহিত বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ আছেন। ইহাদের অনেক স্ত্রীলোক হিন্দিতে স্বামীর সহিত কথোপকথন করেন। ইহাদের রীতিনীতি প্রায় বঙ্গদেশীয় ব্রাহ্মণগণের ন্যায় এবং ইহাদের পুরোহিতও বাঙালি ব্রাহ্মণ। ইহারা উত্তর কি পশ্চিম ভারত হইতে আসিয়া সম্ভবত বাণিজ্য উপলক্ষে মুসলমানদের রাজত্ব সময় হইতে রাজসাহীতে বাস করিতেছেন। ইহাদের অবস্থা মন্দ নহে। ইহাদের সামান্য ভূ-সম্পত্তি আছে এবং ইহারা বাণিজ্যও করিয়া থাকে।
উপরের লিখিত ব্রাহ্মহ্মণগণ ব্যতীত “সাতশতী” ও “মধ্য শ্রেণি” ব্রাহ্মণ আছে বলিয়া কথিত। কিন্তু এই দুই প্রকার ব্রাহ্মণ রাজসাহী জেলায় দেখা যায় না। সুতরাং তাহাদের বিবরণ লেখা এস্থলে নিষ্প্রয়োজন।
(২) ক্ষত্রিয়-পৌরাণিক মতে ইহারা ব্রহ্মার বাহু হইতে জাত হয় বলিয়া ব্রাহ্মণের নীচে ও অন্যান্য বর্ণের উপরিভাগে আসন প্রাপ্ত হন। পুরাকালে এই জাতিই রাজা এবং যুদ্ধব্যবসায়ী ছিল। পরশুরাম পৃথিবীকে একবিংশতিবার নিঃক্ষত্রিয় করেন। ইহার পর কোন কোন ক্ষত্রিয়পত্নীরা বংশরক্ষার্থে ব্রাহ্মণগণ দ্বারা সন্তান উৎপাদন করিয়া লন। এই ব্রাহ্মণ ঔরসজাত ক্ষত্রিয়গণ ভ্রষ্ট ক্ষত্রিয় বলিয়া কথিত। এইরূপ ক্ষত্রিয় ভিন্ন প্রকৃত ক্ষত্রিয়ের ঔরসজাত ক্ষত্রিয় আতবিরল। রাজসাহী জেলায় যাহাদের ক্ষত্রিয় বলা যায়, তাহারা দুই কি তিন শতের বেশি হইবে না। ইহারা পশ্চিম ভারত হইতে আসিয়া এ জেলায় বাস করে। ইহাদের অধিকাংশ ধনী মহাজন। ক্ষত্রিয়ের ঔরসে ও বৈশ্যাণীর গর্ভে যে পুত্র জন্মে, তাহাকে “রাজপুত” বলে। রাজপুত ও ঘাটওয়াল বর্তমান ক্ষত্রিয় জাতির অন্তর্ভূত বলিয়া কেহ কেহ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। এই জেলায় “রাজপুতের” সংখ্যা প্রায় ১৫০০ বা ১৬০০ হইবে। ইহারা প্রায়ই দ্বারবানের কার্য করে। “ঘাটওয়ালের” সংখ্যা প্রায় ২০০ হইবে। ইহারা প্রায়ই চৌকিদারের কার্য নির্বাহ করে।
(৩) বৈশ্য-পৌরাণিক মতে এই জাতি ব্রহ্মার উরু হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। ইহারা দ্বিজ বলিয়া কথিত ছিল। ইহাদের জাতীয় ব্যবসা কৃষি, বাণিজ্য ও কুশীদব্যবহার। বঙ্গদেশীয় বৈশ্যগণের শূদ্রের ন্যায় আচার ব্যবহার। বঙ্গে প্রকৃত বৈশ্য অতি বিরল। মাড়ওয়ারী এই জাতির অন্তর্গত বলিয়া পরিচিত, কিন্তু মাড়ওয়ারীরা নিজে ক্ষত্রিয় বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকে। রামপুরবোয়ালিয়াতে কতকগুলি মাড়ওয়ারী ব্যবসা বাণিজ্য জন্য বাস করে। ইহাদের সংখ্যা ২০০ কি ২৫০ মাত্র হইবে।
(৪) বৈদ্য-ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারি বর্ণ ব্যতীত পঞ্চম বর্ণ নাই। ইহা ব্যতীত সকল জাতি সঙ্কর জাতি বলিয়া পরিচিত। স্কন্দ পুরাণ-মতে অম্বাকুলোদ্ভব বৈশ্যকন্যা বীরভদ্রার গর্ভে বেদমন্ত্রের বলে ধন্বন্তরি জন্মগ্রহণ করেন। বেদমন্ত্রবলে বালকের জন্ম হয়
বলিয়া “বৈদ্য” এবং অম্বাকুলে জন্ম হয় বলিয়া “অন্বষ্ট” এ জাতির নাম “বৈদ্য” বা “অন্বষ্ট” হইল। ধন্বন্তরি অশ্বিনীকুমারের মানুষী কন্যা সিদ্ধ বিদ্যার পাণিগ্রহণ করিয়া, ধরাতলে চিকিৎসাবিশারদ বলিয়া প্রসিদ্ধ হইলেন। সিদ্ধবিদ্যার গর্ভে এবং ধন্বন্তরির ঔরসে সেন, দাস ও গুপ্ত এই তিন পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। এই তিন জনের বংশধরেরা বৈদ্য জাতিরূপে বঙ্গদেশ ব্যাপিয়া পড়ে। পৌরাণিক মত ছাড়িয়া দিয়া পুরাণের সারভাগ গ্রহণ করিলে, ইহা প্রতীতি হইবে যে ব্রাহ্মণের ঔরসে বৈশ্যার গর্ভজাত পুত্র “বৈদ্য” বা “অন্বষ্ট” হইয়া বৈশ্য হইতে শ্রেষ্ঠ হইয়াছে। ইহা মনুর ব্যবস্থানুসারে সিদ্ধান্ত। ইহা দ্বারা ইহাও প্রমাণ হইল যে বৈদ্যেরা শূদ্রজাতীয় নহে; এবং বৈশ্য অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ও ব্রাহ্মণ অপেক্ষা নিকৃষ্ট। ইহাদের মধ্যে যাহারা উপনীত, তাহারা ১৫ দিন এবং যাহারা উপনীত নহে, তাহারা একমাস অশৌচ গ্রহণ করেন। কোন স্থলে ইহাদের আচার ব্যবহার প্রায় ব্রাহ্মণ সদৃশ এবং কোন স্থলে কায়স্থের মত। ইহাদের জাতীয় ব্যবসা চিকিৎসা এবং ইহারা স্মৃতিশাস্ত্র পর্যন্ত অধ্যয়ন করিয়া থাকে। আদিশূর, বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেন, রাজবল্লভ প্রভৃতি রাজগণ এই বংশোদ্ভব। “দানসাগর” নামক গ্রন্থে, সেনবংশের তাম্রশাসনে ও প্রস্তরফলকে ইহা প্রতিপন্ন হইবে যে বল্লালসেন চন্দ্রবংশীয় ব্রহ্মা-ক্ষত্র-কুলোদ্ভব বিজয়সেনের পুত্র। ইহাতে বৈদ্যজাতিকে ক্ষত্রিয় বলিলেও বলা যাইতে পারে। এইরূপ বৈদ্যজাতি সাধারণত তিন শ্রেণিতে বিভক্ত, যথা-(১) বঙ্গজ, (২) রাঢ়ী, (৩) পঞ্চকোটি। রাজসাহীর বৈদ্যগণ বঙ্গজ শ্রেণিভুক্ত। ইহাদের অনেকে যশোহর জেলার অন্তর্গত সেনহাটি সমাজভুক্ত। যদিও ইহারা চিকিৎসক বলিয়া পরিচিত, ইহাদের অনেকেই চাকরি করিয়া জীবিকানির্বাহ করে। প্রায় সকলেরই অবস্থা ভাল। রাজসাহীতে ইহাদের সংখ্যা প্রায় ১১০০ কি ১২০০ হইবে। বেলঘরিয়া, পুঁঠিয়া, মরকটি প্রভৃতি গ্রামে বৈদ্যের বাস।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















