২০২৬ সালে চালু হবে প্লান্ট
সিঙ্গাপুরের তুয়াস এলাকায় নির্মিত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র–ভিত্তিক কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) অপসারণ কেন্দ্র। আগামী ২০২৬ সালের প্রথম প্রান্তিকে এর কার্যক্রম শুরু হবে। প্রাথমিক স্থাপনা কাজ শুরু হবে এ বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে।
এই কেন্দ্রটির নাম ইকোয়াটিক–১ ডেমোনস্ট্রেশন প্লান্ট। এটি সিঙ্গাপুরের জাতীয় পানি সংস্থা পিইউবি (PUB) এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান ইকোয়াটিক–এর যৌথ উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে।
কীভাবে কাজ করবে প্রযুক্তি
প্রযুক্তিটি মূলত সমুদ্রের পানি থেকে দ্রবীভূত CO2 আলাদা করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে তা সংরক্ষণ করবে। পানি প্রক্রিয়াজাত করে ফের সমুদ্রে ফেলা হলে, সেটি আবার নতুন করে বায়ুমণ্ডল থেকে আরও বেশি পরিমাণ CO2 শোষণ করতে পারবে। বড় আকারে এটি প্রয়োগ করা গেলে সমুদ্র আরও বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড টেনে নিতে সক্ষম হবে।
তবে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, এ ধরনের রাসায়নিক পরিবর্তন সামুদ্রিক প্রাণী ও পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ অংশ জুড়ে থাকা সমুদ্র প্রাকৃতিকভাবেই মানুষের নির্গত CO2–এর প্রায় ৩০ শতাংশ শোষণ করে থাকে।

বিনিয়োগ ও অর্থায়ন
এই প্রযুক্তি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহও কাড়ছে। গত ১২ আগস্ট টেমাসেক ট্রাস্টের Catalytic Capital for Climate and Health (C3H) এবং সিঙ্গাপুরভিত্তিক কিবো ইনভেস্ট যৌথভাবে ইকোয়াটিকের জন্য ১ কোটি ১৬ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ১৪৯ কোটি টাকা) বিনিয়োগ ঘোষণা করেছে।
বিনিয়োগের অর্থ মূলত উত্তর আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিতব্য ইকোয়াটিকের প্রথম বাণিজ্যিক প্লান্ট এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ব্যয় হবে।
সিঙ্গাপুরের প্লান্টটি প্রথমে দিনে ১ টন CO2 সরাতে পারবে। পুরোপুরি চালু হলে প্রতিদিন ১০ টন CO2 অপসারণ সম্ভব হবে, যা প্রায় ৮৭০টি যাত্রীবাহী গাড়ি রাস্তা থেকে তুলে দেওয়ার সমান।
প্রক্রিয়ার ভেতরের ধাপ
এই প্লান্টে সমুদ্রের পানিতে বৈদ্যুতিক স্রোত প্রয়োগ করা হবে। এতে পানির ভেতরে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন তৈরি হবে। দ্রবীভূত CO2 ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চুনা পাথর ও ম্যাগনেসিয়াম বাইকার্বনেটে পরিণত হবে। এগুলো কমপক্ষে ১০ হাজার বছর পর্যন্ত CO2 আটকে রাখতে সক্ষম।
এটি প্রকৃতিতে শামুক–ঝিনুকের খোলস তৈরির প্রক্রিয়ার মতোই। উৎপাদিত কঠিন উপাদান সমুদ্রের তলায় সংরক্ষণ করা যেতে পারে বা নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
হাইড্রোজেন উৎপাদনের সুবিধা
এই প্রক্রিয়ায় অতিরিক্তভাবে হাইড্রোজেনও উৎপাদিত হবে, যা পরিচ্ছন্ন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। পিইউবি জানিয়েছে, প্রতিদিন প্রায় ৩০০ কেজি হাইড্রোজেন তৈরি হবে। এটি প্লান্ট চালাতে কিংবা অন্য শিল্পে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
অর্থায়ন ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান
এই প্রদর্শনী প্লান্টে অর্থ দিচ্ছে পিইউবি, সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেসের ইনস্টিটিউট ফর কার্বন ম্যানেজমেন্ট।
পিইউবির লক্ষ্য ২০৪৫ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষ হওয়া, যা জাতীয় লক্ষ্যমাত্রার পাঁচ বছর আগেই। এজন্য তারা নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করছে, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছে এবং পানি শোধন প্রক্রিয়ায় জ্বালানি খরচ কমাতে গবেষণায় বিনিয়োগ করছে।
আগে চালু হওয়া পরীক্ষামূলক প্রকল্প
এর আগে ২০২৩ সালের এপ্রিলে তুয়াসের গবেষণাধর্মী ডেসালিনেশন প্লান্ট এবং লস অ্যাঞ্জেলেস বন্দরে দুটি ক্ষুদ্র প্লান্ট পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হয়েছিল। সেগুলো দিনে ১০০ কেজি CO2 সরাতে সক্ষম হয়েছিল।
প্রথমে ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে এ প্লান্ট চালুর কথা থাকলেও নকশা চূড়ান্ত করতে সময় লাগায় প্রকল্পে বিলম্ব হয়েছিল।
পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ
এনটিইউ–এর সামুদ্রিক বিজ্ঞানী অধ্যাপক প্যাট্রিক মার্টিন বলেছেন, বড় আকারে এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হলে তা সমুদ্রের রাসায়নিক গঠনে বড় পরিবর্তন আনবে। এতে পানির কার্বন ও অম্লতার মাত্রা বদলে কিছু সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে ইকোয়াটিক জানিয়েছে, তারা সব প্রক্রিয়া নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার মাধ্যমে পরিবেশগত মান রক্ষা করবে।
ন্যাশনাল পার্কস বোর্ডের মতামত
সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল পার্কস বোর্ডের জীববৈচিত্র্য কেন্দ্রের পরিচালক ড. ক্যারেন টুন বলেছেন, মানুষের হস্তক্ষেপে সামুদ্রিক পরিবেশ প্রভাবিত হতে পারে। তবে এই প্রদর্শনী প্রকল্পে ঝুঁকি ন্যূনতম কারণ পানি প্রক্রিয়াজাত করার পর আবার সমুদ্রে ফেরত দেওয়া হবে, এতে সমুদ্রের সামগ্রিক রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট হবে না।
তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে বড় পরিসরে এই প্রযুক্তি চালু হলে পিইউবি, ইকোয়াটিক ও অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে মিলে পরিবেশগত মান বজায় রাখার বিষয়টি নিয়মিত পর্যালোচনা করা হবে।

নির্গমন নিয়ন্ত্রণে নিয়মকানুন
পিইউবি জানিয়েছে, প্লান্ট থেকে নির্গত তরল প্রবাহ নিয়ম মেনে শোধন করা হবে এবং সামুদ্রিক পরিবেশে ফেলার আগে তা পরীক্ষা করে অনুমোদিত সীমার মধ্যে রাখা হবে।
অতিরিক্তভাবে, একটি স্বাধীন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সম্ভাব্য প্রভাব নিরূপণ করতে এবং পরীক্ষামূলক মডেল চালাতে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















