সংক্ষিপ্তসার
- • রাশিয়ার তেল কেনার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের আমদানির ওপর অতিরিক্ত ২৫% শুল্ক বসিয়েছে।
- • সর্বোচ্চ ৫০% পর্যন্ত শুল্ক ভারতীয় রপ্তানি ও কর্মসংস্থানের জন্য হুমকি।
- • আলোচনার ব্যর্থতার কারণ রাজনৈতিক ভুল ও সংকেত না বোঝা।
- • বিশ্লেষকদের মতে, ভারত এ সংকটকে অর্থনৈতিক সংস্কারের সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের ধাক্কা
ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লি থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বুধবার থেকে কার্যকর হওয়া নতুন শুল্ক ভারতের অর্থনীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২১ শতকের শুরু থেকে দুই দেশ কৌশলগত অংশীদার হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত সম্পর্ককে নতুন করে সংকটে ফেলেছে।
ভারতের রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনাকে শাস্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর আগে ২৫% শুল্ক থাকলেও এখন মোট শুল্ক দাঁড়াল সর্বোচ্চ ৫০%। পোশাক, রত্ন ও গয়না, জুতা, খেলাধুলার সামগ্রী, আসবাব ও রাসায়নিক—সব ক্ষেত্রেই এই শুল্ক প্রযোজ্য হবে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম উচ্চ শুল্কহার, যা চীন ও ব্রাজিলের সমান পর্যায়ে।

অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের হুমকি
বিশ্লেষকদের মতে, নতুন শুল্ক ভারতে হাজার হাজার ক্ষুদ্র রপ্তানিকারক ও কর্মসংস্থানের ওপর হুমকি সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাট বড় ধরনের আঘাত পেতে পারে। এতে বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধিশীল বড় অর্থনীতির গতিতেও প্রভাব পড়তে পারে।
বুধবার শেয়ারবাজার বন্ধ থাকায় তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও আগের দিন শুল্ক নিশ্চিত হওয়ার ঘোষণার পর বাজার তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পতন দেখেছে। টানা পাঁচ দিন ধরে রুপির দরপতন হয়েছে এবং তিন সপ্তাহের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সরাসরি কোনো মন্তব্য করেনি। তবে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে এবং চীন, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো নতুন বাজার খুঁজতে উৎসাহিত করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র কাস্টমস বিভাগ জানিয়েছে, শুল্ক কার্যকরের আগে যেসব ভারতীয় পণ্য জাহাজে করে রওনা হয়েছে সেগুলো তিন সপ্তাহ পর্যন্ত শুল্কমুক্ত থাকবে। এছাড়া ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, গাড়ি ও কপারসহ কিছু পণ্যে আগেই আলাদা নিরাপত্তাজনিত শুল্ক থাকায় এগুলোও নতুন সিদ্ধান্তের বাইরে।

ব্যর্থ আলোচনা ও অভিযোগ
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে পাঁচ দফা আলোচনা হলেও সমাধান আসেনি। ভারত আশা করেছিল শুল্ক সর্বোচ্চ ১৫% এ সীমাবদ্ধ রাখা হবে, যেমনটি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অংশীদারদের ক্ষেত্রে হয়েছে।
আলোচনার ব্যর্থতার পেছনে রাজনৈতিক ভুল ও সংকেত না বোঝাকে দুই পক্ষই দায়ী করছে। যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবে ২০২৪ সালে দুই দেশের মধ্যে পণ্য বাণিজ্য দাঁড়িয়েছিল ১২৯ বিলিয়ন ডলার, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি ছিল ৪৫.৮ বিলিয়ন ডলার।
ওয়াশিংটন অভিযোগ করেছে, ভারতের রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কোকে সহায়তা করছে এবং ভারত এতে লাভবান হচ্ছে। তবে ভারত এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেরও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য রয়েছে।
রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতার ঝুঁকি
রপ্তানিকারক সংগঠনগুলোর হিসাবে, ভারতের প্রায় ৮৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির ৫৫% পর্যন্ত এ শুল্কের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ ও চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীরা সুবিধা পাবে।

অর্থনীতিবিদ রাজেশ্বরী সেনগুপ্তা বলেছেন, রুপির দর আরও কিছুটা পড়তে দিলে রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে সহায়তা হতে পারে। তিনি বলেন, সরকারের এখন দরকার সুরক্ষাবাদী নীতি বাদ দিয়ে আরও মুক্ত বাণিজ্যকেন্দ্রিক কৌশল নেওয়া।
ভারতীয় রপ্তানিকারক সংগঠনের সভাপতি এস. সি. রালহান প্রস্তাব করেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকদের জন্য এক বছরের ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ছাড়, সহজ ঋণ ও স্বল্প সুদে অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ দিতে হবে।
কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের শঙ্কা
বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের শুল্ক ভারতের বিকল্প উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে। এতে স্মার্টফোন ও ইলেকট্রনিকসের মতো পণ্যে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যেতে পারে।
আনন্দ রাঠি গ্রুপের প্রধান অর্থনীতিবিদ সুজন হাজরা বলেছেন, প্রায় ২০ লাখ চাকরি ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তবে তিনি আরও বলেছেন, ভারতের রপ্তানি বাজার বৈচিত্র্যময়, করপোরেট আয় ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং দেশীয় চাহিদা যথেষ্ট শক্তিশালী—যা এ আঘাত মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে।
নিরাপত্তা সম্পর্ক ও ভবিষ্যৎ
শুল্ক নিয়ে বিরোধ বাড়লেও দুই দেশ এখনো নিরাপত্তা সহযোগিতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সোমবার উভয় দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা ভার্চুয়ালি বৈঠক করে সম্পর্ক আরও গভীর করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তারা কোয়াড জোটেও (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান) অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















