অপর্ণা সেন: নারীকণ্ঠের চলচ্চিত্রভাষা
অপর্ণা সেন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ২৫ অক্টোবর কলকাতায়। তাঁর বাবা চিদানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক এবং মা ইন্দিরা দাশগুপ্ত সাহিত্যচর্চায় যুক্ত ছিলেন। শৈশব থেকেই তিনি শিল্প ও সাহিত্যের পরিবেশে বড় হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়লেও অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ তাঁকে কিশোরী বয়সেই সিনেমায় নিয়ে আসে। মাত্র ষোলো বছর বয়সে সত্যজিৎ রায়ের সমাপ্তি ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর আকাশ কুসুম, কাপুরুষ এবং প্রথম প্রতিশ্রুতি ছবিতে তিনি অভিনয় করে সমাদৃত হন। তাঁর অভিনয়ে সবসময়ই ফুটে উঠত সংবেদনশীলতা, আধুনিক চিন্তাভাবনা এবং নারীর স্বপ্ন-সংগ্রাম।
অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর তিনি ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকেও মনোযোগী হন। ১৯৮১ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি ৩৬ চৌরঙ্গী লেন, যা কলকাতার প্রেক্ষাপটে এক নিঃসঙ্গ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নারীর গল্প। ছবিটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয় এবং অপর্ণা সেনকে একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে অনন্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। পরবর্তী সময়ে তিনি নির্মাণ করেন যুগান্ত, পারমিতার একদিন, গয়নার বাক্স এবং দ্য জাপানিজ ওয়াইফ—যেখানে নারীর দৃষ্টিভঙ্গি, প্রজন্মের টানাপোড়েন এবং স্বাধীনতার প্রশ্ন উঠে এসেছে।
তাঁর অভিনীত প্রথম প্রতিশ্রুতি চলচ্চিত্রে এক বিধবা নারীর চরিত্রের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক ভারতের নারীর দুঃখ-সংগ্রামকে শক্তিশালীভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। ৩৬ চৌরঙ্গী লেন ছবিতে নিঃসঙ্গতার ভেতর মানবিক বন্ধনের ভাঙন এবং আঘাতকে তিনি হৃদয়গ্রাহীভাবে উপস্থাপন করেন। পারমিতার একদিন ছবিতে তিনি নারীর বন্ধুত্ব, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং প্রজন্মভেদে জীবনদর্শনের পার্থক্যকে তুলে ধরেন। অপরদিকে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র সমাপ্তিতে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সমাজে আলোড়ন তুলেছিল। এইসব চলচ্চিত্র প্রমাণ করে যে অপর্ণা সেন শুধু একজন শিল্পী নন, বরং সমাজচিন্তক, যিনি নারীর অভিজ্ঞতাকে সিনেমার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন।
ববিতা: ঢালিউড থেকে বিশ্বপর্দা
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ববিতা এমন এক নাম, যিনি কয়েক দশক ধরে দর্শকপ্রিয় নায়িকা ছিলেন। তাঁর আসল নাম ফরিদা আক্তার, জন্ম ১৯৫৩ সালের ৩০ জুলাই যশোরে। অভিনয় পরিবারে জন্ম নেওয়ায় তাঁর শৈশব থেকেই সিনেমার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তাঁর দুই বোন সুচন্দা ও চম্পাও চলচ্চিত্রে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। কৈশোরে তিনি জহির রায়হানের সংসার ছবির মাধ্যমে বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেন। তবে প্রকৃত খ্যাতি আসে ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া জহির রায়হানের জীবন থেকে নেওয়া চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এই ছবিতে তিনি ছিলেন এমন এক তরুণী, যে সংসারের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ছবির সংলাপ ও চরিত্র মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, আর ববিতা রাতারাতি জাতীয় আইকনে পরিণত হন।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ববিতা হয়ে ওঠেন প্রধান মুখ। তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল বিস্ময়কর। তবে দেশীয় চলচ্চিত্রে সাফল্যের পাশাপাশি তিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনেও স্থান করে নেন। ১৯৭৩ সালে সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত ছবিতে অভিনয় করে তিনি বিশ্বমঞ্চে পরিচিতি পান। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই ছবিতে ববিতার অভিনয় দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার নারীর জীবনসংগ্রামকে জীবন্ত করে তোলে। ছবিটি কানে পুরস্কার জেতে এবং বাংলা সিনেমাকে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত করে।
ববিতা অভিনয় করেছেন রূপবান, নয়নমণি, অশিক্ষিতসহ বহু চলচ্চিত্রে। রূপবান ছবিতে তিনি ছিলেন লোককাহিনীর সাহসী নায়িকা, যিনি নিজের পরিচয় নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেন। নয়নমণি ছবিতে তিনি দরিদ্র পরিবারের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করে দেখিয়েছিলেন যে ভালোবাসা শ্রেণি-অর্থনীতির দেয়াল ভেঙে দিতে পারে। এভাবে তিনি বারবার গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতা, নারীর দুঃখ এবং সমাজের বৈষম্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
ঢালিউডের ইতিহাসে ববিতা শুধুমাত্র একজন নায়িকা নন, বরং ছিলেন এক প্রজন্মের স্বপ্ন-প্রতীক। তাঁর সংলাপ, অভিনয় এবং চরিত্রগুলো আজও দর্শকের মনে গেঁথে আছে। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে একজন অভিনেত্রী দেশের ভেতর জাতীয় চেতনায় প্রভাব ফেলতে পারে এবং একই সঙ্গে বিশ্বচলচ্চিত্রেও ছাপ রাখতে পারে।
স্মিতা পাটিল: সমান্তরাল সিনেমার বিপ্লবী মুখ
স্মিতা পাটিল জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৫ সালের ১৭ অক্টোবর মহারাষ্ট্রে। তিনি পুণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় সংবাদপাঠক হিসেবে কাজ করতেন। তবে ভাগ্য তাঁকে নিয়ে যায় হিন্দি সমান্তরাল চলচ্চিত্র আন্দোলনের কেন্দ্রে। শ্যাম বেনেগালের চরণদাস চোর (১৯৭৫) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেন। সত্তর ও আশির দশকে সমান্তরাল সিনেমা ছিল ভারতের সামাজিক প্রতিবাদী চলচ্চিত্র আন্দোলনের মেরুদণ্ড, আর স্মিতা পাটিল দ্রুত এই আন্দোলনের প্রতীকী মুখ হয়ে ওঠেন।
তিনি অভিনয় করেন ভূমিকা, মন্ত্র, আরথ এবং মির্চ মসালার মতো চলচ্চিত্রে, যেগুলো আজও ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে মাইলফলক। ভূমিকা ছবিতে তিনি এক অভিনেত্রীর জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সংগ্রাম ও ব্যথা ফুটিয়ে তোলেন। সেখানে তাঁর সংলাপ “আমাদের জীবন রুপোলি পর্দার মতো নয়” সমাজে নারীশিল্পীর ভেতরের দুঃখকে সামনে আনে। মন্ত্র ছবিতে তিনি ছিলেন গ্রামীণ দারিদ্রপীড়িত নারী, যিনি কেবল বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করেন। এই ছবির সংলাপ “আমরা তো শুধু বাঁচতে চাই” দরিদ্র মানুষের আর্তি হয়ে ওঠে।
আরথ ছবিতে স্মিতা পাটিল ছিলেন এমন এক নারী, যিনি বিবাহ ও সম্পর্কের ভাঙনের মধ্য দিয়ে নিজের আত্মমর্যাদা খুঁজে পান। তাঁর সংলাপ “নারীকে করুণা নয়, মর্যাদা দিন” ভারতীয় নারীবাদী আন্দোলনের চিরকালীন ধ্বনি হয়ে ওঠে। মির্চ মসালা চলচ্চিত্রে তিনি একদল নিপীড়িত নারীর সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখ ছিলেন। ছবির ক্লাইম্যাক্সে তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত “আমরা আর নীরব থাকব না” নারী স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।
কিন্তু মাত্র ৩১ বছর বয়সে সন্তান প্রসবের কিছুদিন পর ১৯৮৬ সালে তাঁর মৃত্যু ঘটে। এই অকালমৃত্যু ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। অল্প বয়সেই তিনি প্রমাণ করেছিলেন, সিনেমা কেবল বিনোদন নয়—এটি সমাজ বদলের অস্ত্র। আজও তাঁর সংলাপ, চরিত্র এবং চোখের ভাষা দর্শককে নতুন করে ভাবতে শেখায়।
অপর্ণা সেন, ববিতা ও স্মিতা পাটিল—এই তিন অভিনেত্রী ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে জন্মালেও তাঁদের মধ্যে একটি সাধারণ সূত্র রয়েছে। তাঁরা সবাই তাঁদের সময়ে নারীর জীবন, সংগ্রাম এবং মর্যাদাকে সিনেমার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। অপর্ণা সেন তাঁর চলচ্চিত্রে নারীর দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করেছেন, ববিতা মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব ও পরবর্তী বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে জাতীয় চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছেন, আর স্মিতা পাটিল হিন্দি সমান্তরাল সিনেমার মাধ্যমে নারীবাদী সংগ্রামের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন। তাঁদের প্রতিটি কাজ আজও প্রাসঙ্গিক এবং আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সিনেমা কেবল বিনোদনের শিল্প নয়, এটি সমাজ ও সময়ের প্রতিচ্ছবি।