মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফেডারেল রিজার্ভের একজন গভর্নরকে পদচ্যুত করার চেষ্টা করছেন। ঘটনাটি আর্থিক বাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারলেও এখন পর্যন্ত প্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে শান্ত। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি ফেডের স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।
ফেডের স্বাধীনতার সংকট
১৯৫১ সাল থেকে ফেড কার্যত হোয়াইট হাউসের প্রভাব থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করে আসছে। ট্রাম্প যদি গভর্নর লিসা কুককে অপসারণে সফল হন, তবে ফেডের সেই স্বাধীনতা শেষ হতে পারে। এর ফলে ভবিষ্যতে মুদ্রাস্ফীতি দীর্ঘমেয়াদে বেশি এবং অস্থির হতে পারে।
বাজারের প্রতিক্রিয়া কেন দুর্বল
বিনিয়োগকারীরা এখনো ধরে নিচ্ছেন যে ফেড অর্থনৈতিক তথ্য ও পূর্বাভাসের ভিত্তিতেই সুদের হার নির্ধারণ করবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী নয় মাসের মধ্যে ফেড আসলে ট্রাম্পের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নেবে।

গত শুক্রবার ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, শুল্কবৃদ্ধি স্থায়ী মুদ্রাস্ফীতি ঘটাবে না, তাই সেপ্টেম্বরে সুদ কমানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এতে স্বল্পমেয়াদে শেয়ারবাজার শক্তিশালী এবং বন্ডের ফলন কমতে পারে।
ট্রাম্পের কৌশল
ফেডের ১১১ বছরের ইতিহাসে কোনো প্রেসিডেন্ট আগে কখনো গভর্নর অপসারণের চেষ্টা করেননি। ট্রাম্প এবার কুকের বিরুদ্ধে মর্টগেজ জালিয়াতির অভিযোগ তুলে তাকে বরখাস্তের ঘোষণা দিয়েছেন, যদিও কোনো অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়নি। কুক এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন।
ট্রাম্পের কৌশল ধীরে ধীরে চাপ সৃষ্টি করা। যেমন শুল্কনীতিতে তিনি প্রথমে বাজারের প্রতিক্রিয়ার মুখে পিছু হটলেও পরে ধাপে ধাপে আগের সিদ্ধান্তগুলো ফিরিয়ে আনেন। একইভাবে, সরাসরি চেয়ারম্যান পাওয়েলকে অপসারণ না করে বিকল্প উপায়ে বোর্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের চেষ্টা করছেন।

বোর্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠতা
যদি কুক অপসারিত হন, তবে সাত সদস্যের গভর্নর বোর্ডে চারজন ট্রাম্প-নিযুক্ত হবেন। ট্রাম্প বলেছেন, খুব শিগগিরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা তার হাতে আসবে, আর এতে আবাসন বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।
যদিও তাত্ক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্তের নিয়ন্ত্রণ ফেড গভর্নরদের হাতে থাকবে না, কারণ ১২ সদস্যের নীতি-নির্ধারণ কমিটিতে পাঁচজন আঞ্চলিক ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু গভর্নর বোর্ড চাইলে তাদের অপসারণও করতে পারে।
ঝুঁকি ও প্রভাব
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ ফেডে ভিন্নমত ও বিরোধী কণ্ঠস্বর দূর করতে পারে। সুদের হার বিষয়ে যদি কোনো গভর্নর তার পছন্দমতো ভোট না দেন, তবে তাকেও ‘কারণ দেখিয়ে’ অপসারণের চেষ্টা হতে পারে। আদালত যদি প্রেসিডেন্টকে এই ক্ষমতা দেয়, তবে ফেড গভর্নরদের সুরক্ষা কার্যত বাতিল হয়ে যাবে।
ফলশ্রুতিতে গভর্নররা হয়তো ট্রাম্পের নীতি মেনে নেবেন, নয়তো পদত্যাগ করবেন।

বিশ্বস্ত প্রার্থী ও নীতি পরিবর্তন
প্রথম মেয়াদের তুলনায় এবার ট্রাম্প আরও বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন বিশ্বস্ত প্রার্থী বাছাইয়ে। সাধারণত ফেড প্রার্থীরা আগাম তাদের অবস্থান প্রকাশ করেন না, কিন্তু ট্রাম্প-মনোনীতরা প্রায় সবাই বলেছেন যে তারা সুদের হার কমানোকে সমর্থন করেন।
উদাহরণস্বরূপ, স্টিফেন মিরান একসময় সুদ কমানোকে ভুল বললেও এখন ট্রাম্পের নীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলছেন ফেড দেরিতে হার কমাচ্ছে। অপরদিকে ডেভিড মালপাসও সুদ কমানোর পক্ষে মত দিচ্ছেন, যদিও তার যুক্তির সঙ্গে বাজারের বাস্তবতা মেলে না।
মুদ্রাস্ফীতি ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি
স্বল্পমেয়াদে মুদ্রাস্ফীতি মূলত অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করবে। বর্তমানে শুল্কের কারণে আগামী বছরে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা বাড়তে পারে, তবে পরে তা আবার লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি নেমে আসবে।

কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। ইতিহাসে বাজার বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন যেমন ১৯৭০-এর মুদ্রাস্ফীতি, ২০০৭-০৯ সালের আর্থিক সংকট কিংবা মহামারির সময়ের মুদ্রাস্ফীতি সঠিকভাবে অনুমান করতে ব্যর্থ হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বর্তমান নীতি পরিবেশ—বৃহত্তম শুল্কনীতি, উদার রাজস্ব ব্যয়, শ্রমবাজারের স্থবিরতা এবং ফেডের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ—সব মিলিয়ে আগামীতে টার্গেটের ওপরে মুদ্রাস্ফীতি হওয়ার সম্ভাবনা জোরালো।
ফলে বাজার আপাতত নিশ্চুপ থাকলেও, কাঠামোগত পরিবর্তনের ঝুঁকি আসন্ন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















