মিতসুবিশির সিদ্ধান্ত এবং প্রেক্ষাপট
জাপানের বৃহত্তম ট্রেডিং কোম্পানি মিতসুবিশি করপোরেশন সম্প্রতি তিনটি সমুদ্রবায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত এমন সময়ে এলো যখন জাপান নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে, আর একই সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য জায়গায়ও একই ধরনের প্রকল্প নানা সমস্যায় পড়ছে।
মিতসুবিশি জানিয়েছে, হঠাৎ বেড়ে যাওয়া অতিরিক্ত ব্যয় ও অর্থনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে এই প্রকল্প চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়। কোম্পানি বলেছে, বৈশ্বিকভাবে সরবরাহ শৃঙ্খল সংকট, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রা বিনিময় হার এবং সুদের হার বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো ব্যবসার পরিবেশকে কঠিন করে তুলেছে। এ কারণে ২০২৪ অর্থবছরে তারা ৫২.৪ বিলিয়ন ইয়েন লোকসান গুনেছে।
সরকারের পরিকল্পনা ও প্রকল্পের গুরুত্ব
২০২০ সাল থেকে জাপান সরকার ১০টি সমুদ্র অঞ্চলে বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প চালুর উদ্যোগ নেয় এবং দরপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন অপারেটর নির্বাচন করে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মিতসুবিশি আকিতা প্রিফেকচারের নোশিরো, মিতানে, ওগা ও ইউরিহোনজো এবং চিবা প্রিফেকচারের চোশি শহরের কাছাকাছি তিনটি এলাকায় প্রকল্প উন্নয়নের দায়িত্ব পায়।
কিন্তু এখন এই প্রকল্প থেকে সরে আসায় মিতসুবিশিকে ২০ বিলিয়ন ইয়েন নিরাপত্তা জামানত হারাতে হবে এবং তারা ভবিষ্যতের দরপত্রে অংশগ্রহণের যোগ্যতাও হারাবে।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি
গবেষকদের মতে, মিতসুবিশির এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত নয়। কোম্পানি যে দরপত্রে অংশ নিয়েছিল, সেটি ছিল খুব কম দামে, আর তখনো বৈশ্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি শুরু হয়নি। জাপান তখনো মুদ্রাস্ফীতি নয়, বরং মুদ্রাস্ফীতিহীনতার (ডিফ্লেশন) মধ্যে ছিল। ফলে ব্যয়ের হঠাৎ বৃদ্ধির বিষয়টি আগাম আঁচ করা যায়নি।
ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিক্সের গবেষক ইয়াসুশি নিনোমিয়া বলেন, “অন্য কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও খারাপ প্রভাব পড়েছে, তবে মিতসুবিশির মতো চমকপ্রদ পরিস্থিতি হয়নি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাউন্ডে যারা অংশ নিয়েছে, তারা পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেকটাই জানত। এটাই মূল পার্থক্য।”
জাপানের জ্বালানি কৌশল
জাপান সরকার ফেব্রুয়ারিতে অনুমোদিত জ্বালানি কৌশল অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ ১৫.২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০-৫০ শতাংশে নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে সমুদ্রবায়ু বিদ্যুৎকে প্রধান ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে।
সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ গিগাওয়াট এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০ থেকে ৪৫ গিগাওয়াট সমুদ্রবায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে। এতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের মধ্যে এর অংশ বাড়বে বর্তমান ১.১ শতাংশ থেকে ৪-৮ শতাংশে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া
মিতসুবিশির সরে যাওয়ার খবর প্রকাশের পর শিল্পমন্ত্রী ইয়োজি মুতো বলেন, তিনি “বিস্মিত হয়েছেন”। তিনি মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত স্থানীয় জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং সামগ্রিকভাবে সমুদ্রবায়ু বিদ্যুতের প্রতি জনআস্থা দুর্বল করতে পারে।
বিকল্প পথের আলোচনা
নবায়নযোগ্য জ্বালানি ইনস্টিটিউটের নীতিনির্ধারণী পরিচালক মিকা ওহবায়াশি বলেন, মিতসুবিশির দরপত্র জেতা থেকে শুরু করে সরে যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেত। যেমন, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, জাহাজ এবং বন্দর উন্নয়নের খরচ কমানো।
তার মতে, “সঠিক নীতি ও বিধি সংস্কারের মাধ্যমে প্রকল্পগুলো লাভজনক করা সম্ভব। কিন্তু সেই সংস্কারগুলো করা হয়নি। কেবল দরপত্র বা অর্থায়নের কাঠামো নয়, আশপাশের শর্তগুলোও উন্নত করা দরকার। আর এই দায়িত্ব সরকারেরই।”
মিতসুবিশির এই সরে দাঁড়ানো জাপানের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্যে একটি বড় আঘাত। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি অন্যান্য অপারেটরদের ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযোজ্য হবে না। এখন সরকারের দায়িত্ব হলো খরচ নিয়ন্ত্রণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে প্রকল্পগুলোকে টেকসই করে তোলা।
মিতসুবিশির সমুদ্রবায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে আসা জাপানের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্যকে ধাক্কা দিল
-
সারাক্ষণ রিপোর্ট - ০৩:৩২:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ অগাস্ট ২০২৫
- 33
জনপ্রিয় সংবাদ



















