দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পে যখন নায়িকাদের উপস্থিতি প্রায়শই নায়কের ছায়ায় সীমাবদ্ধ থেকেছে, তখনই কিছু নারী শিল্পী তাদের প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের জোরে এক অনন্য অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁদের মধ্যেই অন্যতম নাম অনুষ্কা শেঠি। তাঁকে শুধু একজন অভিনেত্রী হিসেবে চেনা হয় না, বরং এক প্রভাবশালী, শক্তিশালী এবং বহুমাত্রিক শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
নিচে অনুষ্কার জীবন, কর্মজীবন, বিতর্ক, ভক্তদের প্রতিক্রিয়া এবং দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পে তাঁর অবদান নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হলো।
প্রারম্ভিক জীবন ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট
অনুষ্কার জন্ম ১৯৮১ সালের ৭ নভেম্বর কর্ণাটকের মাঙ্গালুরু শহরে। তাঁর আসল নাম সুইটি শেঠি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে তাঁর বেড়ে ওঠা ছিল একেবারেই সাধারণ। পিতা এ.এন. ভিট্টল শেঠি একজন ব্যবসায়ী এবং মা প্রভা শেঠি একজন গৃহিণী ছিলেন। পরিবারে তিন ভাইবোনের মধ্যে অনুষ্কা সবচেয়ে ছোট। শৈশবে তিনি ছিলেন লাজুক ও চুপচাপ প্রকৃতির।
তিনি বেঙ্গালুরুর মাউন্ট কারমেল কলেজে পড়াশোনা করেন এবং কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তবে অভিনয়ের আগে তাঁর জীবন জুড়ে ছিল আরেকটি বড় অধ্যায়—যোগব্যায়াম। অনুষ্কা শেঠি একজন প্রশিক্ষিত যোগ শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে এই দক্ষতাই তাঁকে শারীরিকভাবে দৃঢ় ও মানসিকভাবে শান্ত থাকতে সাহায্য করেছে, যা তাঁর অভিনয়জীবনেও প্রভাব ফেলেছে।
চলচ্চিত্রে প্রবেশ ও প্রথম সাফল্য
অভিনয়ের জগতে প্রবেশ অনুষ্কার জন্য সহজ ছিল না। প্রথমদিকে মডেলিং এবং বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করার প্রস্তাব পেলেও তিনি মূলত সিনেমায় মনোযোগী ছিলেন। ২০০৫ সালে তেলেগু ছবি “সুপার”-এর মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। ছবিটি বিশাল হিট না হলেও তাঁর গ্ল্যামার এবং আত্মবিশ্বাসী অভিনয় দর্শক ও প্রযোজকদের নজরে আসে।
তবে প্রকৃত অর্থে তিনি আলোচনায় আসেন ২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “অরুন্ধতী” ছবির মাধ্যমে। ছবিতে তিনি দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করে দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমায় নারীকেন্দ্রিক গল্প বলার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। শক্তিশালী নারী চরিত্রে তাঁর অভিনয় সমালোচক ও দর্শক উভয়ের কাছেই উচ্চ প্রশংসিত হয়।
ক্যারিয়ারের মাইলফলক
অনুষ্কার অভিনয় ক্যারিয়ারে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি রয়েছে যা তাঁকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
- অরুন্ধতী (২০০৯) – নারীকেন্দ্রিক এ ছবিতে তাঁর অভিনয় তাঁকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন যে একজন অভিনেত্রী একাই একটি ছবি বাণিজ্যিকভাবে সফল করতে পারেন।
- ভেদাম (২০১০) – বহুমাত্রিক গল্পে তিনি এক যৌনকর্মীর ভূমিকায় অভিনয় করে সমাজের অন্ধকার বাস্তবতাকে তুলে ধরেন।
- রুদ্রমাদেবী (২০১৫) – ঐতিহাসিক রানি রুদ্রমাদেবীর চরিত্রে অভিনয় করে তিনি ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলেন।
- সাইজ জিরো (২০১৫) – সমাজের সৌন্দর্য নিয়ে ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শরীর নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করেন।
- বাহুবলী সিরিজ (২০১৫, ২০১৭) – দেবসেনা চরিত্রে অনুষ্কার শক্তিশালী অভিনয় তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। রাজামৌলির এই সিরিজ বিশ্বজুড়ে দক্ষিণ ভারতীয় ছবির মর্যাদা বাড়িয়েছে।
অভিনয়শৈলী ও ব্যক্তিত্ব
অনুষ্কার অভিনয়শৈলী বৈচিত্র্যময়। তিনি একদিকে যেমন গ্ল্যামারাস চরিত্রে মানানসই, তেমনি অন্যদিকে সমাজমুখী ও চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে সমানভাবে সফল। তিনি নারীকেন্দ্রিক ছবিকে জনপ্রিয় করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে নারী চরিত্র শুধুমাত্র সহ-অভিনেতা নয়, বরং গল্পের মূল চালিকাশক্তি হতে পারেন।
ভক্তদের প্রতিক্রিয়া
অনুষ্কা শেঠি দক্ষিণ ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তাঁর ভক্তরা তাঁকে শুধুমাত্র নায়িকা হিসেবে নয়, বরং “লেডি সুপারস্টার” হিসেবে অভিহিত করে। ভক্তরা তাঁর অভিনয় ছাড়াও তাঁর নম্রতা, ব্যক্তিত্ব এবং সাধারণ জীবনযাপনকে ভালোবাসে। সামাজিক মাধ্যমে তাঁর ভক্তকুল সবসময় সক্রিয় থাকে এবং প্রায়শই তাঁর জন্মদিন বা ছবির মুক্তির সময় বিশেষ প্রচারণা চালায়।
বিতর্ক ও ব্যক্তিগত জীবন
অনুষ্কার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বহুবার মিডিয়ায় গুঞ্জন শোনা গেছে। বিশেষ করে সহ-অভিনেতা প্রভাসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে গুজব রটেছিল, বিশেষ করে “বাহুবলী” মুক্তির পর। তবে অনুষ্কা সবসময় ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মুখ খোলেননি এবং বরং কাজে মনোনিবেশ করেছেন।
কখনও তাঁর ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস নিয়েও সমালোচনা উঠেছে, তবে অনুষ্কা সবসময়ই আত্মবিশ্বাসী থেকেছেন এবং “সাইজ জিরো” ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে সমাজের সৌন্দর্য ধারণার বিরুদ্ধে শক্ত বার্তা দিয়েছেন।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
অনুষ্কা শেঠি তাঁর কর্মজীবনে একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছেন, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- • নন্দী অ্যাওয়ার্ড
- • ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড (দক্ষিণ)
- • সিমা অ্যাওয়ার্ডস
- • সানসুই ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডস
এই পুরস্কারগুলো প্রমাণ করে যে তিনি শুধু জনপ্রিয় নন, সমালোচকদের কাছেও সমানভাবে প্রশংসিত।
দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রে অবদান
অনুষ্কা শেঠি দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমাকে নতুন এক ধারা উপহার দিয়েছেন। বিশেষ করে নারীকেন্দ্রিক ছবিকে বাণিজ্যিকভাবে সফল করার ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃৎ। তাঁর উপস্থিতি দক্ষিণ ভারতের চলচ্চিত্র শিল্পে নারীর অবস্থানকে দৃঢ় করেছে।
সামাজিক কর্মকাণ্ড
অনুষ্কা বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশ নেন। তিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা, নারী শিক্ষা ও যোগব্যায়াম প্রচারে সক্রিয়। তাঁর জীবনযাপনের মূল দর্শন হলো সরলতা ও শৃঙ্খলা।
অনুষ্কা শেঠি আজ দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাম। তাঁর অভিনয়, ব্যক্তিত্ব ও সংগ্রামী মানসিকতা তাঁকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে একজন নারীও হতে পারেন সিনেমার কেন্দ্রবিন্দু এবং সমাজে প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি।
তাঁকে নিয়ে যতই বলা হোক, শেষ পর্যন্ত অনুষ্কা শেঠি সেই শিল্পী, যিনি দক্ষিণ ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের এক অমর কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন।