০৩:৪৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বিশ্ব সঙ্গীতে এআই-এর সৃজনশীল ঢেউ আইএফএ বার্লিন ২০২৫: যে গ্যাজেটগুলো নিয়ে সবার আলোচনা এআই প্রশিক্ষণে আইনি নজির: লেখকদের সাথে Anthropic-এর $১.৫ বিলিয়ন সমঝোতা যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনে সবচেয়ে বড় আকাশ হামলা লন্ডনের ডানপন্থী সমাবেশে সহিংসতা, রেকর্ড সমাগমে উত্তেজনা দোহায় হামাস নেতাদের ওপর হামলা, যুদ্ধবিরতির আলাপ জটিলতায় নতুন গবেষণা: আটলান্টিক প্রবাহ ভাঙার ঝুঁকি এখন অনেক বেশি” ডাকসু ও জাকসুতে বৈষম্যবিরোধীদের বিপর্যয়, চ্যালেঞ্জের মুখে এনসিপি? জাতীয় নির্বাচনকে ডাকসুর সঙ্গে মেলানো যাবে না, মডেল হিসেবে কাজ করবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হার – আকাশ চোপড়া-অশ্বিনকেই ‘সঠিক’ প্রমাণ করছে বাংলাদেশ?

ইঁদুরখেকো সাপ: প্রকৃতির নিঃশব্দ প্রহরী

ভূমিকা

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কিংবা শহরের প্রান্তে গেলে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে লম্বা, চকচকে আর দ্রুতগামী এক সাপ। গ্রামবাসী একে ডাকে ইঁদুরখেকো সাপ, ইংরেজিতে এর নাম Rat Snake। নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এর প্রধান পরিচয়—এটি ইঁদুর খায়, আর সেই কারণেই কৃষকের সবচেয়ে বড় বন্ধুদের একজন। তবে দুঃখজনক হলো, এই সাপটিকে অধিকাংশ মানুষ চিনলেও এর প্রকৃত চরিত্র সম্পর্কে জানে না। লোকজন একে বিষধর ভাবে, ভয় পেয়ে লাঠির আঘাতে মেরে ফেলে, আবার কুসংস্কারে নানা গল্প বানায়। অথচ ইঁদুরখেকো সাপ প্রকৃতির এক নীরব রক্ষক, যাকে ছাড়া কৃষিজমি ও মানুষের বসতি অচিরেই ইঁদুরের দখলে চলে যেত।

বৈজ্ঞানিক পরিচয়

ইঁদুরখেকো সাপের বৈজ্ঞানিক নাম Ptyas mucosa। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম সাপ পরিবারের একটি সদস্য—Colubridae—যেখানে বেশিরভাগ সাপই অবিষাক্ত। দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এমনকি ইন্দোনেশিয়া ও চীনের কিছু অংশ পর্যন্ত এই সাপ বিস্তৃত। বাংলাদেশে এটি প্রচুর দেখা যায়, বিশেষ করে ধানক্ষেত, বাঁশঝাড়, পরিত্যক্ত গর্ত কিংবা গ্রামীণ বাড়ির উঠোনে।

শারীরিক বৈশিষ্ট্য

একটি পূর্ণবয়স্ক ইঁদুরখেকো সাপ সাধারণত ৬ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়, কখনো ১২ ফুটও ছাড়িয়ে যায়। দেহ মসৃণ আঁশে ঢাকা, রঙ বাদামি, ধূসর কিংবা কালচে। অল্পবয়সী সাপের গায়ে গাঢ় দাগ থাকে, যা বয়সের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। মাথা সরু ও চোখ বড়, ফলে এরা দৃষ্টি দিয়ে দূর থেকে শিকার টের পায়। গতি এত দ্রুত যে অনেক সময় মনে হয় মানুষকে ছাপিয়ে দৌড়াচ্ছে। এই বৈশিষ্ট্যই অনেককে ভয় পাইয়ে দেয়, যদিও বাস্তবে এরা মানুষের ক্ষতি করে না।

বাসস্থান ও জীবনযাপন

ইঁদুরখেকো সাপের অভিযোজন ক্ষমতা অসাধারণ। গ্রামীণ পরিবেশে ধানক্ষেত, ফসলের জমি, গবাদি পশুর খোঁয়াড়—সবখানেই দেখা যায়। গাছে চড়তে পারে, পানিতে সাঁতার কাটতে পারে এবং অবিশ্বাস্য গতিতে দৌড়াতে পারে। আশ্রয় নেয় ইঁদুরের পরিত্যক্ত গর্ত, বাঁশঝাড়ের ভেতর কিংবা গাছের গোড়ায়। দিনেই বেশি সক্রিয়, রাতে অপেক্ষাকৃত কম।

খাদ্যাভ্যাস

প্রকৃতিতে এ সাপের প্রধান খাদ্য হলো ইঁদুর। ধানক্ষেতে ইঁদুর ফসলের কত বড় ক্ষতি করে, তা কৃষক সমাজ ভালোভাবেই জানে। কৃষি গবেষণা অনুযায়ী, ইঁদুর প্রতিবছর বাংলাদেশের ৫–৭ শতাংশ ফসল খেয়ে নষ্ট করে। একটি ইঁদুরখেকো সাপ বছরে দুই থেকে তিনশো ইঁদুর খেয়ে ফেলতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, এরা ব্যাঙ, টিকটিকি, ছোট খরগোশ, এমনকি পাখির ডিম বা ছানাও খায়। এর ফলে কৃষিজমি ফসলের ক্ষতি থেকে রক্ষা পায় এবং শহরে রোগবাহী ইঁদুরের আধিক্যও কমে যায়।

বিষাক্ত না হলেও ভয়

ইঁদুরখেকো সাপ সম্পূর্ণ অবিষাক্ত। মানুষের ক্ষতি করার মতো বিষ এর নেই। কিন্তু হুমকি পেলে এটি শরীর ফুলিয়ে ফোঁসফোঁস শব্দ করে, মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়—যা অনেকটা কোবরা সাপের ভঙ্গির মতো মনে হয়। এতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে ভাবে এটি বিষধর। আত্মরক্ষার্থে কামড় দিতে পারে, কিন্তু সেই কামড়ে মানুষের মৃত্যু ঘটে না। তবুও গ্রামে লোকেরা ভুল করে একে প্রাণঘাতী সাপ ভেবে হত্যা করে।

এক দিনের জীবনচক্র

ভোরে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে এবং শরীর গরম করতে সূর্যের তাপে গা সেঁকতে থাকে। দুপুরের দিকে সক্রিয় হয়। ধানক্ষেতের ইঁদুরের গর্ত, গোয়ালের কোণে লুকিয়ে থাকা ইঁদুর কিংবা জলাশয়ের ধারে ব্যাঙ—সবই তার শিকার। বিকেলে গাছে উঠে পাখির বাসায় ডিম বা ছানা খুঁজে নেয়। সন্ধ্যা নামলে আশ্রয়ের দিকে ফিরে যায়—কখনো ইঁদুরের পরিত্যক্ত গর্তে, কখনো বাঁশঝাড়ের ভেতরে। তবে প্রয়োজন হলে রাতেও শিকারে বের হয়।

লোকবিশ্বাস ও কুসংস্কার

বাংলাদেশের গ্রামে এখনও প্রচলিত আছে নানা ভুল ধারণা। অনেকেই বলে, এটি নাকি গরুর দুধ চুষে খায়, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কেউ কেউ বলেন, এ সাপ মানুষের ঘাড়ে লাফ দেয়। বড় আর দ্রুতগামী বলে অনেকে একে কালNagini ভেবে মেরে ফেলে। এসব ভুল ধারণাই সাপটির জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ।

কৃষি অর্থনীতি ও পরিবেশে অবদান

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, ইঁদুর প্রতিবছর ৫–৭% ফসল খেয়ে নষ্ট করে। ইঁদুরখেকো সাপ এই ক্ষতি অনেকাংশে রোধ করে। একেকটি সাপ কয়েক বিঘা জমির ফসল বাঁচাতে সক্ষম। ইঁদুরের কারণে ছড়ানো প্লেগ বা সালমোনেলা মতো রোগও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে এটি কৃষকের অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্য দুটোই রক্ষা করে।

 

কৃষকের অভিজ্ঞতা

ফরিদপুরের এক কৃষক বলছিলেন—“আগে আমাদের ধানক্ষেতে এত ইঁদুর হতো যে অর্ধেক ফসল খেয়ে ফেলত। তখন সাপ দেখলেই মেরে ফেলতাম। পরে বুঝলাম এই লম্বা সাপগুলো ইঁদুর খেয়ে ফসল বাঁচায়। তখন থেকে আর মারি না।” এই বক্তব্যই প্রমাণ করে যে সঠিক জ্ঞান থাকলে মানুষ প্রকৃতির এই সহচরকে রক্ষা করতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে Rat Snake পরিচিত ও সম্মানিত। ভারতের পাঞ্জাবে এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেখানে এ সাপের সংখ্যা বেশি, সেখানে গমক্ষেতের ইঁদুরজনিত ক্ষতি প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। নেপালে স্কুল পাঠ্যপুস্তকে এ সাপের পরিবেশগত গুরুত্ব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই বুঝতে শেখে যে সাপ প্রকৃতির বন্ধু। থাইল্যান্ডে আবার এ সাপ লোককথায় শুভ প্রাণী হিসেবে বিবেচিত, ফলে গ্রামাঞ্চলে মানুষ একে হত্যা করে না। বাংলাদেশে যদি একই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা যায়, তবে ইঁদুরখেকো সাপ সংরক্ষণ অনেক সহজ হবে।

সংরক্ষণ ও ভবিষ্যৎ

নগরায়ণ, বনভূমি ধ্বংস, মানুষের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের কারণে এ সাপের সংখ্যা দিন দিন কমছে। যদিও এটি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে বিপন্ন তালিকায় নেই, তবে যদি এই ধারা চলতে থাকে, অচিরেই এ প্রজাতি বিরল হয়ে যাবে। তাই এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। স্কুল-কলেজে পরিবেশ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত, গণমাধ্যমে প্রচারণা চালানো উচিত, আর কৃষকদের বোঝাতে হবে—এই সাপই তাদের প্রকৃত বন্ধু।

ইঁদুরখেকো সাপ প্রকৃতির নিঃশব্দ প্রহরী। প্রতিদিন শত শত ইঁদুর খেয়ে এটি কৃষকের ফসল বাঁচায়, শহরে রোগবাহী ইঁদুরের সংখ্যা কমায় এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। অথচ আমরা মানুষ অকারণে ভয় পেয়ে বা কুসংস্কারে বিশ্বাস করে এই মূল্যবান প্রাণীটিকে হত্যা করি। সময় এসেছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর। ইঁদুরখেকো সাপকে ভয় নয়, বরং সহচর হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এরা আমাদের বন্ধু, আর বন্ধু রক্ষা করাই আমাদের দায়িত্ব।

বিশ্ব সঙ্গীতে এআই-এর সৃজনশীল ঢেউ

ইঁদুরখেকো সাপ: প্রকৃতির নিঃশব্দ প্রহরী

০৪:০০:৪৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভূমিকা

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কিংবা শহরের প্রান্তে গেলে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে লম্বা, চকচকে আর দ্রুতগামী এক সাপ। গ্রামবাসী একে ডাকে ইঁদুরখেকো সাপ, ইংরেজিতে এর নাম Rat Snake। নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এর প্রধান পরিচয়—এটি ইঁদুর খায়, আর সেই কারণেই কৃষকের সবচেয়ে বড় বন্ধুদের একজন। তবে দুঃখজনক হলো, এই সাপটিকে অধিকাংশ মানুষ চিনলেও এর প্রকৃত চরিত্র সম্পর্কে জানে না। লোকজন একে বিষধর ভাবে, ভয় পেয়ে লাঠির আঘাতে মেরে ফেলে, আবার কুসংস্কারে নানা গল্প বানায়। অথচ ইঁদুরখেকো সাপ প্রকৃতির এক নীরব রক্ষক, যাকে ছাড়া কৃষিজমি ও মানুষের বসতি অচিরেই ইঁদুরের দখলে চলে যেত।

বৈজ্ঞানিক পরিচয়

ইঁদুরখেকো সাপের বৈজ্ঞানিক নাম Ptyas mucosa। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম সাপ পরিবারের একটি সদস্য—Colubridae—যেখানে বেশিরভাগ সাপই অবিষাক্ত। দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এমনকি ইন্দোনেশিয়া ও চীনের কিছু অংশ পর্যন্ত এই সাপ বিস্তৃত। বাংলাদেশে এটি প্রচুর দেখা যায়, বিশেষ করে ধানক্ষেত, বাঁশঝাড়, পরিত্যক্ত গর্ত কিংবা গ্রামীণ বাড়ির উঠোনে।

শারীরিক বৈশিষ্ট্য

একটি পূর্ণবয়স্ক ইঁদুরখেকো সাপ সাধারণত ৬ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়, কখনো ১২ ফুটও ছাড়িয়ে যায়। দেহ মসৃণ আঁশে ঢাকা, রঙ বাদামি, ধূসর কিংবা কালচে। অল্পবয়সী সাপের গায়ে গাঢ় দাগ থাকে, যা বয়সের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। মাথা সরু ও চোখ বড়, ফলে এরা দৃষ্টি দিয়ে দূর থেকে শিকার টের পায়। গতি এত দ্রুত যে অনেক সময় মনে হয় মানুষকে ছাপিয়ে দৌড়াচ্ছে। এই বৈশিষ্ট্যই অনেককে ভয় পাইয়ে দেয়, যদিও বাস্তবে এরা মানুষের ক্ষতি করে না।

বাসস্থান ও জীবনযাপন

ইঁদুরখেকো সাপের অভিযোজন ক্ষমতা অসাধারণ। গ্রামীণ পরিবেশে ধানক্ষেত, ফসলের জমি, গবাদি পশুর খোঁয়াড়—সবখানেই দেখা যায়। গাছে চড়তে পারে, পানিতে সাঁতার কাটতে পারে এবং অবিশ্বাস্য গতিতে দৌড়াতে পারে। আশ্রয় নেয় ইঁদুরের পরিত্যক্ত গর্ত, বাঁশঝাড়ের ভেতর কিংবা গাছের গোড়ায়। দিনেই বেশি সক্রিয়, রাতে অপেক্ষাকৃত কম।

খাদ্যাভ্যাস

প্রকৃতিতে এ সাপের প্রধান খাদ্য হলো ইঁদুর। ধানক্ষেতে ইঁদুর ফসলের কত বড় ক্ষতি করে, তা কৃষক সমাজ ভালোভাবেই জানে। কৃষি গবেষণা অনুযায়ী, ইঁদুর প্রতিবছর বাংলাদেশের ৫–৭ শতাংশ ফসল খেয়ে নষ্ট করে। একটি ইঁদুরখেকো সাপ বছরে দুই থেকে তিনশো ইঁদুর খেয়ে ফেলতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, এরা ব্যাঙ, টিকটিকি, ছোট খরগোশ, এমনকি পাখির ডিম বা ছানাও খায়। এর ফলে কৃষিজমি ফসলের ক্ষতি থেকে রক্ষা পায় এবং শহরে রোগবাহী ইঁদুরের আধিক্যও কমে যায়।

বিষাক্ত না হলেও ভয়

ইঁদুরখেকো সাপ সম্পূর্ণ অবিষাক্ত। মানুষের ক্ষতি করার মতো বিষ এর নেই। কিন্তু হুমকি পেলে এটি শরীর ফুলিয়ে ফোঁসফোঁস শব্দ করে, মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়—যা অনেকটা কোবরা সাপের ভঙ্গির মতো মনে হয়। এতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে ভাবে এটি বিষধর। আত্মরক্ষার্থে কামড় দিতে পারে, কিন্তু সেই কামড়ে মানুষের মৃত্যু ঘটে না। তবুও গ্রামে লোকেরা ভুল করে একে প্রাণঘাতী সাপ ভেবে হত্যা করে।

এক দিনের জীবনচক্র

ভোরে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে এবং শরীর গরম করতে সূর্যের তাপে গা সেঁকতে থাকে। দুপুরের দিকে সক্রিয় হয়। ধানক্ষেতের ইঁদুরের গর্ত, গোয়ালের কোণে লুকিয়ে থাকা ইঁদুর কিংবা জলাশয়ের ধারে ব্যাঙ—সবই তার শিকার। বিকেলে গাছে উঠে পাখির বাসায় ডিম বা ছানা খুঁজে নেয়। সন্ধ্যা নামলে আশ্রয়ের দিকে ফিরে যায়—কখনো ইঁদুরের পরিত্যক্ত গর্তে, কখনো বাঁশঝাড়ের ভেতরে। তবে প্রয়োজন হলে রাতেও শিকারে বের হয়।

লোকবিশ্বাস ও কুসংস্কার

বাংলাদেশের গ্রামে এখনও প্রচলিত আছে নানা ভুল ধারণা। অনেকেই বলে, এটি নাকি গরুর দুধ চুষে খায়, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কেউ কেউ বলেন, এ সাপ মানুষের ঘাড়ে লাফ দেয়। বড় আর দ্রুতগামী বলে অনেকে একে কালNagini ভেবে মেরে ফেলে। এসব ভুল ধারণাই সাপটির জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ।

কৃষি অর্থনীতি ও পরিবেশে অবদান

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, ইঁদুর প্রতিবছর ৫–৭% ফসল খেয়ে নষ্ট করে। ইঁদুরখেকো সাপ এই ক্ষতি অনেকাংশে রোধ করে। একেকটি সাপ কয়েক বিঘা জমির ফসল বাঁচাতে সক্ষম। ইঁদুরের কারণে ছড়ানো প্লেগ বা সালমোনেলা মতো রোগও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে এটি কৃষকের অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্য দুটোই রক্ষা করে।

 

কৃষকের অভিজ্ঞতা

ফরিদপুরের এক কৃষক বলছিলেন—“আগে আমাদের ধানক্ষেতে এত ইঁদুর হতো যে অর্ধেক ফসল খেয়ে ফেলত। তখন সাপ দেখলেই মেরে ফেলতাম। পরে বুঝলাম এই লম্বা সাপগুলো ইঁদুর খেয়ে ফসল বাঁচায়। তখন থেকে আর মারি না।” এই বক্তব্যই প্রমাণ করে যে সঠিক জ্ঞান থাকলে মানুষ প্রকৃতির এই সহচরকে রক্ষা করতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে Rat Snake পরিচিত ও সম্মানিত। ভারতের পাঞ্জাবে এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেখানে এ সাপের সংখ্যা বেশি, সেখানে গমক্ষেতের ইঁদুরজনিত ক্ষতি প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। নেপালে স্কুল পাঠ্যপুস্তকে এ সাপের পরিবেশগত গুরুত্ব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই বুঝতে শেখে যে সাপ প্রকৃতির বন্ধু। থাইল্যান্ডে আবার এ সাপ লোককথায় শুভ প্রাণী হিসেবে বিবেচিত, ফলে গ্রামাঞ্চলে মানুষ একে হত্যা করে না। বাংলাদেশে যদি একই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা যায়, তবে ইঁদুরখেকো সাপ সংরক্ষণ অনেক সহজ হবে।

সংরক্ষণ ও ভবিষ্যৎ

নগরায়ণ, বনভূমি ধ্বংস, মানুষের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের কারণে এ সাপের সংখ্যা দিন দিন কমছে। যদিও এটি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে বিপন্ন তালিকায় নেই, তবে যদি এই ধারা চলতে থাকে, অচিরেই এ প্রজাতি বিরল হয়ে যাবে। তাই এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। স্কুল-কলেজে পরিবেশ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত, গণমাধ্যমে প্রচারণা চালানো উচিত, আর কৃষকদের বোঝাতে হবে—এই সাপই তাদের প্রকৃত বন্ধু।

ইঁদুরখেকো সাপ প্রকৃতির নিঃশব্দ প্রহরী। প্রতিদিন শত শত ইঁদুর খেয়ে এটি কৃষকের ফসল বাঁচায়, শহরে রোগবাহী ইঁদুরের সংখ্যা কমায় এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। অথচ আমরা মানুষ অকারণে ভয় পেয়ে বা কুসংস্কারে বিশ্বাস করে এই মূল্যবান প্রাণীটিকে হত্যা করি। সময় এসেছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর। ইঁদুরখেকো সাপকে ভয় নয়, বরং সহচর হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এরা আমাদের বন্ধু, আর বন্ধু রক্ষা করাই আমাদের দায়িত্ব।