ভারতীয় নীল গোখরা বা Indian Blue Cobra সাধারণ গোখরা প্রজাতির এক বিরল রঙের বৈচিত্র্য। প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো স্বতন্ত্র প্রজাতি নয়, বরং ইন্ডিয়ান কোবরা (Naja naja)-র জেনেটিক পরিবর্তনের ফল। এর দেহে একধরনের নীলচে-ধূসর আভা থাকে, যা আলোয় আরও গাঢ় ও উজ্জ্বল দেখা যায়। বিরল রঙের জন্য এটি সরীসৃপপ্রেমী ও গবেষকদের মধ্যে বিশেষ আকর্ষণীয়।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কিছু গ্রামে মাঝেমধ্যেই “নীল গোখরা”র দেখা মেলে বলে খবর পাওয়া যায়। গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করেন, এটি সৌভাগ্যের প্রতীক। তবে অন্যদিকে আতঙ্কও প্রবল — কারণ গোখরা মানেই মৃত্যু-ভয়। ফলে এ বিরল সরীসৃপকে নিয়ে গ্রামবাংলার সমাজে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস
- বর্গ:Squamata
- পরিবার:Elapidae
- গণ:Naja
- প্রজাতি:Naja naja (Indian Cobra)
বিস্তার ও আবাসস্থল
সাধারণ ভারতীয় গোখরা দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সর্বত্র পাওয়া যায় — ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়। তবে নীলচে রঙের এই ভিন্নতা অত্যন্ত বিরল, এবং সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় বা নির্দিষ্ট পরিবেশগত প্রভাবে এদের দেখা মেলে। এরা সাধারণত মাঠ, ঝোপঝাড়, কৃষিজমি, গৃহস্থালি এলাকার কাছাকাছি বসবাস করে।
রংপুর জেলার বদরগঞ্জে এক কৃষক আবদুল মালেক জানান — “গত বর্ষায় আমাদের ধানক্ষেতে এমন এক নীলচে সাপ দেখতে পাই। প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম, পরে গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বললেন এটি নীল গোখরা। তারপর থেকে ইঁদুরের উপদ্রব যেন কমে গেছে।”
শারীরিক বৈশিষ্ট্য
নীল গোখরার দৈর্ঘ্য সাধারণত ১.৫ থেকে ২ মিটার পর্যন্ত হয়। এদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো দেহের গাঢ় নীল বা নীলচে-কালো আভা। অন্যান্য গোখরার মতোই এদের ফণায় বিখ্যাত “চশমা আকৃতি” থাকে। সূর্যালোকে এদের আঁশে নীল আভা চকচক করে, যা দর্শকের চোখে অত্যন্ত আকর্ষণীয় মনে হয়।
স্থানীয় কিশোররা অনেক সময় এ সাপকে “নীল রত্ন” বলে ডাকেন। কারণ সূর্যের আলোয় এর আঁশে নীল আভা ঝলমল করে, যা যেন মূল্যবান রত্নের মতো মনে হয়।
বিষ ও আক্রমণ ক্ষমতা
ইন্ডিয়ান ব্লু কোবরা অন্যান্য গোখরার মতোই নিউরোটক্সিক বিষ উৎপন্ন করে। এর কামড় মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে এবং দ্রুত চিকিৎসা না করলে শ্বাসকষ্ট ও মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হয়। তবে এরা সহজে মানুষকে আক্রমণ করে না; হুমকির মুখে পড়লেই ফণা তোলে ও সতর্ক সংকেত দেয়।
রাজশাহীর চারঘাট এলাকায় গত বছর এমন একটি সাপ ধরেছিলেন সাপুড়ে রহিম উদ্দিন। তিনি বলেন, “ফণা তোলার পর এমন এক নীলচে আলো ঝলমল করছিল যে মনে হচ্ছিল দেবতার দূত এসে দাঁড়িয়েছে। আমি জীবনে একবারই এমন দৃশ্য দেখেছি।”
আচরণ
এরা মূলত নিশাচর প্রাণী। রাতে ইঁদুর, ব্যাঙ, ছোট সরীসৃপ, এমনকি অন্য সাপও শিকার করে। গ্রামে ইঁদুর দমনে এদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই সাধারণত পালিয়ে যায়, কিন্তু কোণঠাসা হলে ভয়ঙ্করভাবে ফণা তুলে দাঁড়ায়।
গবেষকরা বলছেন, নীল গোখরা আসলে মানুষের চেয়ে বেশি উপকারী। ধানক্ষেতের ইঁদুর দমন করে কৃষি উৎপাদনে সাহায্য করে। কিন্তু ভয় ও কুসংস্কারের কারণে গ্রামবাসীরা প্রায়ই এদের মেরে ফেলেন।
সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
ভারতীয় গোখরা হিন্দু পুরাণ ও সংস্কৃতিতে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। দেবতা শিবের গলায় সাপ হিসেবে গোখরাকেই প্রতীকায়িত করা হয়। অনেক জায়গায় নীল গোখরা পবিত্রতা ও শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে অজ্ঞতা ও ভয় থেকে এদের হত্যা করা হয়, যা প্রজাতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে হুমকি।
লোককথায় বলা হয়, “নীল গোখরার দেখা মানে ঘরে সুখ আসবে।” আবার অন্যদিকে বলা হয়, “যদি নীল গোখরা উঠোন পেরোয়, সেখানে অশুভ শক্তির ছায়া নামে।” এই দুই বিপরীত ধারণাই সমাজে এক সাথে টিকে আছে।
সংরক্ষণ অবস্থা
আইইউসিএন (IUCN) তালিকায় ভারতীয় গোখরা “Least Concern” বা স্বল্প বিপন্ন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। তবে বিরল নীলচে বৈচিত্র্য শিকার, পাচার ও আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে ঝুঁকির মধ্যে আছে। সরীসৃপ পাচারকারীরা এদের আন্তর্জাতিক বাজারে অত্যন্ত উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে থাকে।
ঢাকার পরিবেশবাদী সংস্থা এক রিপোর্টে জানিয়েছে, নীল গোখরার চামড়া ও বিরল রঙ আন্তর্জাতিক বাজারে লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। পাচারকারীরা গ্রাম থেকে ধরে শহরে নিয়ে আসে এবং গোপনে সীমান্ত পার করে। ফলে এই সরীসৃপ আজ মারাত্মক বিপদের মুখে।
মানুষের সাথে সম্পর্ক
গ্রামবাংলায় নীল গোখরা নিয়ে নানা কুসংস্কার প্রচলিত আছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, নীল গোখরার উপস্থিতি সৌভাগ্যের লক্ষণ। আবার কেউ কেউ ভয়ে অযথা এদের হত্যা করেন। বাস্তবে এরা ইঁদুর দমন করে কৃষকের সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
দিনাজপুরের এক নারী কৃষক জহুরা বেগম বলেন, “নীল গোখরা দেখলে আমরা ভয় পাই। কিন্তু আবার ভাবি, এরা ইঁদুর খায় — আমাদের ধানক্ষেতের জন্য ভালো।”
ভারতীয় নীল গোখরা প্রকৃতির এক বিরল বিস্ময়। এটি সাধারণ গোখরারই এক বিশেষ রঙিন বৈচিত্র্য, যা বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক উভয় ক্ষেত্র থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এদের সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করলে ভবিষ্যতে এই অনন্য বৈচিত্র্য হারিয়ে যেতে পারে। তাই মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা এখন জরুরি।
এখন সময় এসেছে গ্রামীণ কুসংস্কার ভেঙে এই বিরল সরীসৃপকে প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে রক্ষা করার। বিজ্ঞানীরা বলছেন, “নীল গোখরা কেবল ভয় নয়, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার প্রতীকও।”