০৩:৪৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫

কুন্ডান্নুরে ঝিনুক শিকারিদের ভাগ্য ফিরল, ফিরে এল ‘কাক্কাচাকারা’

ভোরের আলোয় ঝিলমিল করছে কুন্ডান্নুরের ব্যাকওয়াটার। চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ছোট ছোট নৌকা। প্রতিটি নৌকা থেকে পুরুষেরা লম্বা বাঁশের জালে পানির তলা থেকে ঝিনুক তুলছে। ঝিনুক ভর্তি ঝুড়িগুলো রোদের আলোয় চকচক করছে। স্থানীয়দের কাছে এটি যেন এক বিস্ময়—ফিরে এসেছে বহু প্রতীক্ষিত ‘কাক্কাচাকারা’, ঝিনুক আহরণের মৌসুম।

পাঁচ বছরের বিরতি

গত পাঁচ বছরে এ পানিতে মাছ ধরা বন্ধ হয়নি। জাল পড়েছে, নৌকা ফিরেছে, ব্যস্ততাও চলেছে। কিন্তু ঝিনুক পাওয়া যায়নি প্রায় কিছুই। এক সময় ভরপুর থাকা ঝিনুকের বিছানাগুলো উধাও হয়ে যায়, শিকারিরা ফিরে আসে খালি হাতে। স্থানীয় জেলেরা এর জন্য দায়ী করেন ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মারাডুর ফ্ল্যাট ভাঙার ঘটনাকে। চারটি বহুতল ভবন বিস্ফোরণে ভেঙে পড়েছিল, যার ধুলো-বালির মেঘ ঝড়ের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। অনেকে মনে করেন, তার কিছু অংশ পানিতে গিয়ে মিশেছিল। এরপর থেকেই ঝিনুকের দেখা মেলে না।

Kochi: Kerala Backwaters - ourglobaltrek

থাইকাট্টুসেরির ঝিনুক শিকারি সুনীল বলেন, “ওই ফ্ল্যাট ভাঙার পর থেকে আর কোনো ‘চাকারা’ হয়নি। পানির গন্ধ, রঙ সবকিছু বদলে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল ব্যাকওয়াটার যেন প্রাণ হারিয়েছে। এখন কীভাবে ফিরল, বলা মুশকিল—হয়তো ধ্বংসস্তূপের প্রভাব সময়ের সঙ্গে কেটে গেছে।”

আশাতীত ফলন

এবারের ঝিনুক আহরণ দেখে বিস্মিত অভিজ্ঞ শিকারিরাও। আলাপ্পুঝা থেকে শুরু করে কোট্টায়ম পর্যন্ত নৌকা ভিড় জমিয়েছে কুন্ডান্নুরে। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ছন্দময় দাঁড়ের শব্দ আর জালের ঘর্ষণে মুখরিত থাকে নদী। দুপুর নাগাদ ঝুড়ি ভরে ওঠে ঝিনুকে। তারপর সেগুলো রওনা হয় বৈকোম, এরামাল্লুর আর চন্দিরুরের প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে।

চেরথলার পাল্লিপুরামের জেলে শশি বলেন, “বছরের পর বছর পর এমন চাকারা দেখছি। ভোরে নামি, রোদ বেশি হলে বিশ্রাম নেই, আবার বিকেলে নামি। রাতে বাজারে পৌঁছে যায় ঝিনুক।”

নতুন পদ্ধতির ব্যবহার

প্রচলিতভাবে ঝিনুক আহরণে ডুব দিয়ে হাতে কুড়িয়ে আনা হত। কিন্তু এবার নতুন কৌশল জনপ্রিয় হয়েছে—‘কল্লি’ বা ‘কুথুভালা’। এটি লম্বা বাঁশের সঙ্গে জাল লাগানো, যা দিয়ে পানির তলায় টেনে একসাথে ঝিনুক তোলা যায়। এতে সময় বাঁচছে, যারা ডুব দিতে জানে না তারাও সহজে আহরণ করতে পারছে।

তবে ঐতিহ্যবাহী শিকারিরা মনে করেন, এই পদ্ধতিতে শুধু ঝিনুকই নয়, বাচ্চা ঝিনুকও উঠে আসে। এতে ভবিষ্যতের ঝিনুক উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ঝিনুকের বিশেষ স্বাদ

কুন্ডান্নুরের ঝিনুক স্বাদ ও গুণের জন্য বিশেষভাবে জনপ্রিয়। তাই দূরদূরান্ত থেকে শিকারিরা ছুটে এসেছে। পানাভল্লির ভিনিশ বলেন, “এই ঝিনুক অন্য জায়গার মতো নয়। খোলসের ভেতরে মাংস বেশি, ওজনে ভারী। এবারের চাকারা আমাদের জন্য ওণামের উপহার।”

Collecting Clams at Vembanad Lake - The Kerala Museum

বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ

বিজ্ঞানীরাও নজর রাখছেন এই ঘটনায়। কোচির সেন্ট্রাল মেরিন অ্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিএমএফআরআই) গবেষণা শুরু করতে যাচ্ছে, যাতে জানা যায় আসলেই কী মারাডু ফ্ল্যাট ভাঙার কারণে ঝিনুক হারিয়ে গিয়েছিল এবং এখন আবার ফিরেছে।

প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ড. বিদ্যা আর বলেন, “এখনই কিছু বলা যাবে না। পানির মান ও তলদেশের স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা করতে হবে। তবে ঝিনুকের বাচ্চা সাধারণত নানা জায়গায় জন্মায়, সবসময় একই জায়গায় নয়।”

ভাগ্য ফেরার মুহূর্ত

বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা ও ভবিষ্যতের আশঙ্কা থাকলেও আপাতত সেসব নিয়ে চিন্তা করছে না স্থানীয়রা। তাদের কাছে আজকের গুরুত্ব একটাই—বিরল এক সুযোগে ফিরেছে প্রাচুর্য। তাই ঝিনুক শিকারিরা সময় নষ্ট না করে প্রাণপণে আহরণে ব্যস্ত, যতক্ষণ না এই ‘চাকারা’ আবার হারিয়ে যায়।

জনপ্রিয় সংবাদ

কুন্ডান্নুরে ঝিনুক শিকারিদের ভাগ্য ফিরল, ফিরে এল ‘কাক্কাচাকারা’

০৫:০০:০৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভোরের আলোয় ঝিলমিল করছে কুন্ডান্নুরের ব্যাকওয়াটার। চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ছোট ছোট নৌকা। প্রতিটি নৌকা থেকে পুরুষেরা লম্বা বাঁশের জালে পানির তলা থেকে ঝিনুক তুলছে। ঝিনুক ভর্তি ঝুড়িগুলো রোদের আলোয় চকচক করছে। স্থানীয়দের কাছে এটি যেন এক বিস্ময়—ফিরে এসেছে বহু প্রতীক্ষিত ‘কাক্কাচাকারা’, ঝিনুক আহরণের মৌসুম।

পাঁচ বছরের বিরতি

গত পাঁচ বছরে এ পানিতে মাছ ধরা বন্ধ হয়নি। জাল পড়েছে, নৌকা ফিরেছে, ব্যস্ততাও চলেছে। কিন্তু ঝিনুক পাওয়া যায়নি প্রায় কিছুই। এক সময় ভরপুর থাকা ঝিনুকের বিছানাগুলো উধাও হয়ে যায়, শিকারিরা ফিরে আসে খালি হাতে। স্থানীয় জেলেরা এর জন্য দায়ী করেন ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মারাডুর ফ্ল্যাট ভাঙার ঘটনাকে। চারটি বহুতল ভবন বিস্ফোরণে ভেঙে পড়েছিল, যার ধুলো-বালির মেঘ ঝড়ের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। অনেকে মনে করেন, তার কিছু অংশ পানিতে গিয়ে মিশেছিল। এরপর থেকেই ঝিনুকের দেখা মেলে না।

Kochi: Kerala Backwaters - ourglobaltrek

থাইকাট্টুসেরির ঝিনুক শিকারি সুনীল বলেন, “ওই ফ্ল্যাট ভাঙার পর থেকে আর কোনো ‘চাকারা’ হয়নি। পানির গন্ধ, রঙ সবকিছু বদলে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল ব্যাকওয়াটার যেন প্রাণ হারিয়েছে। এখন কীভাবে ফিরল, বলা মুশকিল—হয়তো ধ্বংসস্তূপের প্রভাব সময়ের সঙ্গে কেটে গেছে।”

আশাতীত ফলন

এবারের ঝিনুক আহরণ দেখে বিস্মিত অভিজ্ঞ শিকারিরাও। আলাপ্পুঝা থেকে শুরু করে কোট্টায়ম পর্যন্ত নৌকা ভিড় জমিয়েছে কুন্ডান্নুরে। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ছন্দময় দাঁড়ের শব্দ আর জালের ঘর্ষণে মুখরিত থাকে নদী। দুপুর নাগাদ ঝুড়ি ভরে ওঠে ঝিনুকে। তারপর সেগুলো রওনা হয় বৈকোম, এরামাল্লুর আর চন্দিরুরের প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে।

চেরথলার পাল্লিপুরামের জেলে শশি বলেন, “বছরের পর বছর পর এমন চাকারা দেখছি। ভোরে নামি, রোদ বেশি হলে বিশ্রাম নেই, আবার বিকেলে নামি। রাতে বাজারে পৌঁছে যায় ঝিনুক।”

নতুন পদ্ধতির ব্যবহার

প্রচলিতভাবে ঝিনুক আহরণে ডুব দিয়ে হাতে কুড়িয়ে আনা হত। কিন্তু এবার নতুন কৌশল জনপ্রিয় হয়েছে—‘কল্লি’ বা ‘কুথুভালা’। এটি লম্বা বাঁশের সঙ্গে জাল লাগানো, যা দিয়ে পানির তলায় টেনে একসাথে ঝিনুক তোলা যায়। এতে সময় বাঁচছে, যারা ডুব দিতে জানে না তারাও সহজে আহরণ করতে পারছে।

তবে ঐতিহ্যবাহী শিকারিরা মনে করেন, এই পদ্ধতিতে শুধু ঝিনুকই নয়, বাচ্চা ঝিনুকও উঠে আসে। এতে ভবিষ্যতের ঝিনুক উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ঝিনুকের বিশেষ স্বাদ

কুন্ডান্নুরের ঝিনুক স্বাদ ও গুণের জন্য বিশেষভাবে জনপ্রিয়। তাই দূরদূরান্ত থেকে শিকারিরা ছুটে এসেছে। পানাভল্লির ভিনিশ বলেন, “এই ঝিনুক অন্য জায়গার মতো নয়। খোলসের ভেতরে মাংস বেশি, ওজনে ভারী। এবারের চাকারা আমাদের জন্য ওণামের উপহার।”

Collecting Clams at Vembanad Lake - The Kerala Museum

বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ

বিজ্ঞানীরাও নজর রাখছেন এই ঘটনায়। কোচির সেন্ট্রাল মেরিন অ্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিএমএফআরআই) গবেষণা শুরু করতে যাচ্ছে, যাতে জানা যায় আসলেই কী মারাডু ফ্ল্যাট ভাঙার কারণে ঝিনুক হারিয়ে গিয়েছিল এবং এখন আবার ফিরেছে।

প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ড. বিদ্যা আর বলেন, “এখনই কিছু বলা যাবে না। পানির মান ও তলদেশের স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা করতে হবে। তবে ঝিনুকের বাচ্চা সাধারণত নানা জায়গায় জন্মায়, সবসময় একই জায়গায় নয়।”

ভাগ্য ফেরার মুহূর্ত

বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা ও ভবিষ্যতের আশঙ্কা থাকলেও আপাতত সেসব নিয়ে চিন্তা করছে না স্থানীয়রা। তাদের কাছে আজকের গুরুত্ব একটাই—বিরল এক সুযোগে ফিরেছে প্রাচুর্য। তাই ঝিনুক শিকারিরা সময় নষ্ট না করে প্রাণপণে আহরণে ব্যস্ত, যতক্ষণ না এই ‘চাকারা’ আবার হারিয়ে যায়।