০১:৩২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
ইউটিউবে রেকর্ড ভিউ, তবু ‘বেবি শার্ক’ নির্মাতার আয় সীমিত কেন” চীনের এআই দৌড়ে তীব্র প্রতিযোগিতা, লোকসানে কেঁপে উঠল বাইদু গোপন সসের নিরাপত্তায় নতুন জোর দিচ্ছে রেইজিং কেইন’স  সিডনিতে জমজমাট ২০২৫ এআরআইএ অ্যাওয়ার্ড, এগিয়ে নিনাজারাচি ও ডম ডোলা তাইওয়ানের স্যাটেলাইট যুগের সূচনা: স্পেসএক্স উৎক্ষেপণে বড় অগ্রগতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৫৯) শেয়ারবাজারে টানা উত্থান, বিনিয়োগকারীদের মনোভাব আরও ইতিবাচক সিরাজগঞ্জে ব্র্যাক–ফিলিপস ফাউন্ডেশনের নতুন চার হেলথ সেন্টার প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমলেও আস্থার লড়াইয়ে এগোচ্ছে চীন কাশ্মীরি মানেই সন্ত্রাসী নন- ওমর আব্দুল্লাহ

আধুনিক অনলাইন বাজার আর প্যাকেটজাত খাবারের যুগে এক ভ্রাম্যমাণ বাদামওয়ালার গল্প

শহরের ফুটপাথে এক চেনা ডাক

শহরের ব্যস্ত রাস্তায়, ফুটপাথের মোড়ে কিংবা স্কুলের ফটকে একসময় শোনা যেত এক পরিচিত ডাক—
“বাদাম নিন, গরম বাদাম!”
এই ডাক একসময় ছিল নগরজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু আজকের দিনে অনলাইন শপিংয়ের বাজার, কর্পোরেট প্যাকেজিং আর সুপারশপের চকচকে মোড়কে ঢাকা খাদ্যের ভিড়ে সেই বাদামওয়ালা যেন এক ভিন্ন জগৎ। তবুও শহরের হাজারো মানুষ এখনও তাদের জীবিকার জন্য প্রতিদিন বাদাম বিক্রির ঝুঁকি নিয়ে ফুটপাথে দাঁড়ান।

দিনের শুরু: জীবিকার তাড়নায় সকাল

ভোরবেলা যখন শহরের বেশিরভাগ মানুষ এখনও ঘুমে আচ্ছন্ন, বাদামওয়ালার দিন শুরু হয়ে যায়। নিত্যকার রুটিন হলো—বাজারে যাওয়া, পাইকারি দামে বাদাম, ছোলা আর মুড়ি কেনা, সেগুলো ভেজে বা সেদ্ধ করে প্রস্তুত করা। স্ত্রী বা পরিবারের কারো সাহায্যে কাগজ কেটে ঠোঙা বানানো হয়। ছোট ছোট ঠোঙায় বাদাম গুছিয়ে রাখা যেন দিনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া।

একজন বাদামওয়ালার মাথায় তখন থাকে নির্দিষ্ট হিসাব—আজ কত বিক্রি হলে ভাড়ার টাকা মিটবে, কত হলে চাল-ডাল কেনা যাবে, কত হলে সন্তানকে স্কুলে পাঠানো যাবে। জীবনের প্রতিটি সকালই তার কাছে অর্থনৈতিক সংগ্রামের নতুন সূচনা।

রফিক বাদামওয়ালা এমনই এক মানুষ। ঢাকা শহরের জিগাতলার বাসিন্দা। ভোরে যখন মানুষ ঘুমে, তখনই তিনি বেরিয়ে পড়েন বাদামের বস্তা নিয়ে। তাঁর স্ত্রী সেলিনা ঠোঙা বানাতে সাহায্য করেন, আর স্কুলপড়ুয়া ছেলে শাওন মাঝে মাঝে বাদাম ভাজার কাজে হাত লাগায়। প্রতিদিন সকালে রফিকের মনে একই চিন্তা—আজ অন্তত পাঁচশো টাকা আয় করতে হবে, না হলে ঘরে চাল উঠবে না।

পথের ব্যবসা: শহরের প্রতিটি মোড়ই বাজার

বাদামওয়ালার বাজার নেই নির্দিষ্ট কোনো দোকানে। তার বাজার হলো পুরো শহর। কখনো স্কুলের সামনে, কখনো অফিস পাড়ায়, আবার কখনো পার্কের ভেতর। ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে এক ঝলক বাদামের গন্ধ ভেসে এলে মানুষ হাত বাড়িয়ে নেয় ঠোঙা।

এক কাপ চায়ের সঙ্গে ভাজা বাদাম কিংবা হাঁটার ফাঁকে একটু মুড়ি-বাদাম, মানুষের ক্ষণিকের ক্ষুধা আর আনন্দের সঙ্গী এই বাদাম। দিনে দিনে দুই-তিনশো টাকা আয় করাই একজন বাদামওয়ালার কাছে সাফল্য। উৎসব কিংবা মেলা হলে সেই আয় বেড়ে যায়, তবে বৃষ্টি কিংবা হঠাৎ পুলিশের তাড়ায় পুরো আয় হারিয়ে যায় মুহূর্তেই।

রফিক সাধারণত দুপুরে ধানমন্ডি লেকের পাশে বসেন। বিকেলে স্কুল ছুটির সময় সেখানে জটলা হয়। ছাত্রছাত্রীদের কাছে তাঁর বাদামের ঠোঙা খুব জনপ্রিয়। তবে পুলিশের তাড়া খাওয়াটা তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়। কখনো ফুটপাথে বসা যাবে না বলে তাঁকে সরে যেতে হয়, আবার কখনো লেকের ভেতরে ঢুকে পড়া পথচারীদের ভরসায় বিক্রি চালিয়ে যান।

প্রতিযোগিতা: প্যাকেটজাত খাবারের ভিড়ে পিছিয়ে পড়া

আজকের বাজারে বাদামওয়ালার সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী হলো কর্পোরেট দুনিয়া। সুপারশপের তাক ভর্তি চকচকে প্যাকেটে সিল করা বাদাম, অনলাইনে অর্ডার করলে বাসায় পৌঁছে দেওয়া খাবার—এসবের ভিড়ে ভ্রাম্যমাণ বাদামওয়ালা অনেকটা পিছিয়ে যাচ্ছে।

গ্রাহকরা এখন নিরাপত্তা, মান আর ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে রাস্তার বাদামওয়ালা নির্ভর করছেন তাৎক্ষণিক ক্ষুধা মেটাতে আসা গ্রাহকের ওপর। যে ছাত্র বা শ্রমজীবী মানুষ কয়েক টাকার বিনিময়ে দ্রুত খাবার চায়, সেখানেই টিকে আছে তার ব্যবসা।

রফিকের নিজের অভিজ্ঞতা হলো—যেসব গ্রাহক আগে প্রতিদিন তাঁর কাছে আসতেন, এখন তাঁরা অনেকেই সুপারশপ থেকে প্যাকেট কিনছেন। তবুও দুপুরবেলা কোনো ছাত্র যখন পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করে তাঁর কাছ থেকে ঠোঙা নেয়, সেটাই রফিকের কাছে সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা।

জীবনের সংগ্রাম: প্রতিদিনের ঝুঁকি

একজন বাদামওয়ালার জীবন শুধুই ব্যবসা নয়, বরং এক যুদ্ধ। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ব্যবসা করতে গেলে প্রায়ই তাকে পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হয়। অনেক সময় ফুটপাতের দখলদাররা চাঁদা দাবি করে। আবার প্রকৃতিও তার বড় শত্রু। বৃষ্টি নামলেই ভিজে যায় বাদাম, ঝড় উঠলে উড়ে যায় ঠোঙা।

তবুও বাদামওয়ালা হাল ছাড়েন না। প্রতিদিন নতুন করে আবার সাজিয়ে নেন ঠোঙা, আবার হাঁটেন শহরের পথে। তার এই সংগ্রাম জীবনের প্রতি এক দৃঢ়তার প্রতীক।

রফিক প্রায়ই বলেন, “একদিন বৃষ্টি এলে সব ভিজে যায়, কিছুই থাকে না। কিন্তু পরের দিন আবার নতুন করে বাদাম ভেজে বের হই। পেটের দায়ে থেমে থাকা যায় না।”

পরিবারের গল্প: বাদামের টাকায় সংসার

একজন বাদামওয়ালার সংসার চলে এই ছোট্ট ব্যবসার আয়ে। হয়তো ভাড়াবাড়িতে থাকে, সন্তানকে সরকারি স্কুলে পড়ায়, স্ত্রী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। বাদাম বিক্রির আয় দিয়ে সংসারের ন্যূনতম খরচ মিটলেও বড় কোনো স্বপ্ন পূরণ হয় না।

তবুও সন্তানের মুখে হাসি দেখার জন্যই তিনি ভোরে উঠে বাদাম নিয়ে পথে নামেন। সংসারের প্রতি দায়িত্ববোধ আর বেঁচে থাকার তাগিদ তাকে প্রতিদিন লড়াই করতে শেখায়।

রফিকের স্বপ্ন খুব বড় কিছু নয়—তিনি চান ছেলে শাওন যেন অন্তত কলেজ পর্যন্ত পড়তে পারে। নিজে স্কুলে যেতে না পারলেও ছেলে পড়াশোনা শিখুক, এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় আশা।

মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক: শুধু লেনদেন নয়

বাদামওয়ালার ব্যবসায় শুধু অর্থ লেনদেন নেই, আছে সম্পর্কও। ছোট বাচ্চারা বাদাম কিনতে এসে গল্প করে, অফিস ফেরত মানুষ কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়, রিকশাচালক তার কাছে নিজের দুঃখের গল্প বলে।

বাদামের ঠোঙা দিয়ে তিনি শুধু খাবার দেন না, দেন সান্ত্বনা, দেন মুহূর্তের আনন্দ। এই সম্পর্কই তাকে আলাদা করে তোলে। সে কারণে বাদামওয়ালা শহরের সংস্কৃতির অংশ হয়ে আছে।

রফিক বলেন, “অনেক গ্রাহক তো শুধু গল্প করার জন্য আসে। ঠোঙা কিনে নিল, তারপর নিজের কথা বলতে লাগল। বাদামের সাথে মানুষের হাসিটাই আমার আসল লাভ।”

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: বাদামওয়ালার ডাক

বাংলাদেশে বাদামওয়ালার ইতিহাস খুব পুরোনো। গ্রামবাংলার মেলা থেকে শুরু করে শহরের পার্ক—সবখানেই বাদামওয়ালা ছিল মানুষের সঙ্গী। আগে সন্ধ্যায় টিনের কৌটো বাজিয়ে বাদামওয়ালা যখন ডাক দিতেন, তখন শিশুরা ছুটে আসত।

আজও সেই ডাক অনেকের শৈশবের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। যদিও এখনকার বাজারে প্যাকেটজাত খাবার আধিপত্য করছে, বাদামওয়ালার ডাক এক ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে বেঁচে আছে।

সংগ্রামের প্রতীক

আধুনিক সময় যতই অনলাইন আর সুপারশপের দিকে ঝুঁকুক, বাদামওয়ালার ডাক শহরের কোলাহলে এখনো এক বিশেষ সুর তোলে। তার ব্যবসা হয়তো ছোট, আয় সীমিত, কিন্তু এতে লুকিয়ে আছে বেঁচে থাকার জেদ, জীবিকার লড়াই আর মানুষের সঙ্গে অটুট সম্পর্ক।

বাদামওয়ালার ব্যবসা শুধু খাদ্যের ব্যবসা নয়, বরং জীবনের ব্যবসা—যেখানে প্রতিদিনের সংগ্রাম আর হাসি একসাথে মিশে আছে। এই বাদামওয়ালার ঠোঙা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবন মানে কেবল প্রতিযোগিতা নয়, বরং টিকে থাকার লড়াইও এক বড় ব্যবসা।

জনপ্রিয় সংবাদ

ইউটিউবে রেকর্ড ভিউ, তবু ‘বেবি শার্ক’ নির্মাতার আয় সীমিত কেন”

আধুনিক অনলাইন বাজার আর প্যাকেটজাত খাবারের যুগে এক ভ্রাম্যমাণ বাদামওয়ালার গল্প

১১:০৪:৫১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শহরের ফুটপাথে এক চেনা ডাক

শহরের ব্যস্ত রাস্তায়, ফুটপাথের মোড়ে কিংবা স্কুলের ফটকে একসময় শোনা যেত এক পরিচিত ডাক—
“বাদাম নিন, গরম বাদাম!”
এই ডাক একসময় ছিল নগরজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু আজকের দিনে অনলাইন শপিংয়ের বাজার, কর্পোরেট প্যাকেজিং আর সুপারশপের চকচকে মোড়কে ঢাকা খাদ্যের ভিড়ে সেই বাদামওয়ালা যেন এক ভিন্ন জগৎ। তবুও শহরের হাজারো মানুষ এখনও তাদের জীবিকার জন্য প্রতিদিন বাদাম বিক্রির ঝুঁকি নিয়ে ফুটপাথে দাঁড়ান।

দিনের শুরু: জীবিকার তাড়নায় সকাল

ভোরবেলা যখন শহরের বেশিরভাগ মানুষ এখনও ঘুমে আচ্ছন্ন, বাদামওয়ালার দিন শুরু হয়ে যায়। নিত্যকার রুটিন হলো—বাজারে যাওয়া, পাইকারি দামে বাদাম, ছোলা আর মুড়ি কেনা, সেগুলো ভেজে বা সেদ্ধ করে প্রস্তুত করা। স্ত্রী বা পরিবারের কারো সাহায্যে কাগজ কেটে ঠোঙা বানানো হয়। ছোট ছোট ঠোঙায় বাদাম গুছিয়ে রাখা যেন দিনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া।

একজন বাদামওয়ালার মাথায় তখন থাকে নির্দিষ্ট হিসাব—আজ কত বিক্রি হলে ভাড়ার টাকা মিটবে, কত হলে চাল-ডাল কেনা যাবে, কত হলে সন্তানকে স্কুলে পাঠানো যাবে। জীবনের প্রতিটি সকালই তার কাছে অর্থনৈতিক সংগ্রামের নতুন সূচনা।

রফিক বাদামওয়ালা এমনই এক মানুষ। ঢাকা শহরের জিগাতলার বাসিন্দা। ভোরে যখন মানুষ ঘুমে, তখনই তিনি বেরিয়ে পড়েন বাদামের বস্তা নিয়ে। তাঁর স্ত্রী সেলিনা ঠোঙা বানাতে সাহায্য করেন, আর স্কুলপড়ুয়া ছেলে শাওন মাঝে মাঝে বাদাম ভাজার কাজে হাত লাগায়। প্রতিদিন সকালে রফিকের মনে একই চিন্তা—আজ অন্তত পাঁচশো টাকা আয় করতে হবে, না হলে ঘরে চাল উঠবে না।

পথের ব্যবসা: শহরের প্রতিটি মোড়ই বাজার

বাদামওয়ালার বাজার নেই নির্দিষ্ট কোনো দোকানে। তার বাজার হলো পুরো শহর। কখনো স্কুলের সামনে, কখনো অফিস পাড়ায়, আবার কখনো পার্কের ভেতর। ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে এক ঝলক বাদামের গন্ধ ভেসে এলে মানুষ হাত বাড়িয়ে নেয় ঠোঙা।

এক কাপ চায়ের সঙ্গে ভাজা বাদাম কিংবা হাঁটার ফাঁকে একটু মুড়ি-বাদাম, মানুষের ক্ষণিকের ক্ষুধা আর আনন্দের সঙ্গী এই বাদাম। দিনে দিনে দুই-তিনশো টাকা আয় করাই একজন বাদামওয়ালার কাছে সাফল্য। উৎসব কিংবা মেলা হলে সেই আয় বেড়ে যায়, তবে বৃষ্টি কিংবা হঠাৎ পুলিশের তাড়ায় পুরো আয় হারিয়ে যায় মুহূর্তেই।

রফিক সাধারণত দুপুরে ধানমন্ডি লেকের পাশে বসেন। বিকেলে স্কুল ছুটির সময় সেখানে জটলা হয়। ছাত্রছাত্রীদের কাছে তাঁর বাদামের ঠোঙা খুব জনপ্রিয়। তবে পুলিশের তাড়া খাওয়াটা তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়। কখনো ফুটপাথে বসা যাবে না বলে তাঁকে সরে যেতে হয়, আবার কখনো লেকের ভেতরে ঢুকে পড়া পথচারীদের ভরসায় বিক্রি চালিয়ে যান।

প্রতিযোগিতা: প্যাকেটজাত খাবারের ভিড়ে পিছিয়ে পড়া

আজকের বাজারে বাদামওয়ালার সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী হলো কর্পোরেট দুনিয়া। সুপারশপের তাক ভর্তি চকচকে প্যাকেটে সিল করা বাদাম, অনলাইনে অর্ডার করলে বাসায় পৌঁছে দেওয়া খাবার—এসবের ভিড়ে ভ্রাম্যমাণ বাদামওয়ালা অনেকটা পিছিয়ে যাচ্ছে।

গ্রাহকরা এখন নিরাপত্তা, মান আর ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে রাস্তার বাদামওয়ালা নির্ভর করছেন তাৎক্ষণিক ক্ষুধা মেটাতে আসা গ্রাহকের ওপর। যে ছাত্র বা শ্রমজীবী মানুষ কয়েক টাকার বিনিময়ে দ্রুত খাবার চায়, সেখানেই টিকে আছে তার ব্যবসা।

রফিকের নিজের অভিজ্ঞতা হলো—যেসব গ্রাহক আগে প্রতিদিন তাঁর কাছে আসতেন, এখন তাঁরা অনেকেই সুপারশপ থেকে প্যাকেট কিনছেন। তবুও দুপুরবেলা কোনো ছাত্র যখন পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করে তাঁর কাছ থেকে ঠোঙা নেয়, সেটাই রফিকের কাছে সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা।

জীবনের সংগ্রাম: প্রতিদিনের ঝুঁকি

একজন বাদামওয়ালার জীবন শুধুই ব্যবসা নয়, বরং এক যুদ্ধ। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ব্যবসা করতে গেলে প্রায়ই তাকে পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হয়। অনেক সময় ফুটপাতের দখলদাররা চাঁদা দাবি করে। আবার প্রকৃতিও তার বড় শত্রু। বৃষ্টি নামলেই ভিজে যায় বাদাম, ঝড় উঠলে উড়ে যায় ঠোঙা।

তবুও বাদামওয়ালা হাল ছাড়েন না। প্রতিদিন নতুন করে আবার সাজিয়ে নেন ঠোঙা, আবার হাঁটেন শহরের পথে। তার এই সংগ্রাম জীবনের প্রতি এক দৃঢ়তার প্রতীক।

রফিক প্রায়ই বলেন, “একদিন বৃষ্টি এলে সব ভিজে যায়, কিছুই থাকে না। কিন্তু পরের দিন আবার নতুন করে বাদাম ভেজে বের হই। পেটের দায়ে থেমে থাকা যায় না।”

পরিবারের গল্প: বাদামের টাকায় সংসার

একজন বাদামওয়ালার সংসার চলে এই ছোট্ট ব্যবসার আয়ে। হয়তো ভাড়াবাড়িতে থাকে, সন্তানকে সরকারি স্কুলে পড়ায়, স্ত্রী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। বাদাম বিক্রির আয় দিয়ে সংসারের ন্যূনতম খরচ মিটলেও বড় কোনো স্বপ্ন পূরণ হয় না।

তবুও সন্তানের মুখে হাসি দেখার জন্যই তিনি ভোরে উঠে বাদাম নিয়ে পথে নামেন। সংসারের প্রতি দায়িত্ববোধ আর বেঁচে থাকার তাগিদ তাকে প্রতিদিন লড়াই করতে শেখায়।

রফিকের স্বপ্ন খুব বড় কিছু নয়—তিনি চান ছেলে শাওন যেন অন্তত কলেজ পর্যন্ত পড়তে পারে। নিজে স্কুলে যেতে না পারলেও ছেলে পড়াশোনা শিখুক, এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় আশা।

মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক: শুধু লেনদেন নয়

বাদামওয়ালার ব্যবসায় শুধু অর্থ লেনদেন নেই, আছে সম্পর্কও। ছোট বাচ্চারা বাদাম কিনতে এসে গল্প করে, অফিস ফেরত মানুষ কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়, রিকশাচালক তার কাছে নিজের দুঃখের গল্প বলে।

বাদামের ঠোঙা দিয়ে তিনি শুধু খাবার দেন না, দেন সান্ত্বনা, দেন মুহূর্তের আনন্দ। এই সম্পর্কই তাকে আলাদা করে তোলে। সে কারণে বাদামওয়ালা শহরের সংস্কৃতির অংশ হয়ে আছে।

রফিক বলেন, “অনেক গ্রাহক তো শুধু গল্প করার জন্য আসে। ঠোঙা কিনে নিল, তারপর নিজের কথা বলতে লাগল। বাদামের সাথে মানুষের হাসিটাই আমার আসল লাভ।”

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: বাদামওয়ালার ডাক

বাংলাদেশে বাদামওয়ালার ইতিহাস খুব পুরোনো। গ্রামবাংলার মেলা থেকে শুরু করে শহরের পার্ক—সবখানেই বাদামওয়ালা ছিল মানুষের সঙ্গী। আগে সন্ধ্যায় টিনের কৌটো বাজিয়ে বাদামওয়ালা যখন ডাক দিতেন, তখন শিশুরা ছুটে আসত।

আজও সেই ডাক অনেকের শৈশবের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। যদিও এখনকার বাজারে প্যাকেটজাত খাবার আধিপত্য করছে, বাদামওয়ালার ডাক এক ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে বেঁচে আছে।

সংগ্রামের প্রতীক

আধুনিক সময় যতই অনলাইন আর সুপারশপের দিকে ঝুঁকুক, বাদামওয়ালার ডাক শহরের কোলাহলে এখনো এক বিশেষ সুর তোলে। তার ব্যবসা হয়তো ছোট, আয় সীমিত, কিন্তু এতে লুকিয়ে আছে বেঁচে থাকার জেদ, জীবিকার লড়াই আর মানুষের সঙ্গে অটুট সম্পর্ক।

বাদামওয়ালার ব্যবসা শুধু খাদ্যের ব্যবসা নয়, বরং জীবনের ব্যবসা—যেখানে প্রতিদিনের সংগ্রাম আর হাসি একসাথে মিশে আছে। এই বাদামওয়ালার ঠোঙা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবন মানে কেবল প্রতিযোগিতা নয়, বরং টিকে থাকার লড়াইও এক বড় ব্যবসা।