চীনে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO) সম্মেলনের পর চীন, রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্র। তাদের উপরে এর সম্ভাব্য প্রভাব একাধিক মাত্রায় বিস্তৃত হতে পারে—রাজনীতি, অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক কূটনীতিতে। নিচে ধাপে ধাপে বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা হলো।
আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যে পরিবর্তন
চীন, রাশিয়া ও ভারতের একত্রিত হওয়া দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্যকে আরও জটিল করে তুলবে। ভারত ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক রাখলেও, চীন এখানে সুদৃঢ় উপস্থিতি বজায় রেখেছে। SCO’র মাধ্যমে এই তিন পরাশক্তির সমন্বয় হলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে কূটনৈতিকভাবে আরও সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
মিয়ানমারের প্রেক্ষাপট
মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সামরিক শাসনের কারণে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রয়েছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা বাড়ার সাথে সাথে দেশটি চীনের দিকে আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। SCO কাঠামোয় চীন-রাশিয়া-ভারত সহযোগিতা মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে বিকল্প কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার পথ দেখাতে পারে। এতে দেশটির উপরে পশ্চিমা চাপ কিছুটা লাঘব হবে এবং আঞ্চলিকভাবে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর (CMEC) প্রকল্প আরও গতি পেতে পারে।

বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান
বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে সমন্বয়বাদী কূটনীতি অনুসরণ করে—ভারত ও চীনের সাথে সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি পশ্চিমাদের সঙ্গেও ভারসাম্য বজায় রাখে। SCO-তে ভারত ও চীনের সহযোগিতা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশকে তার কৌশল নতুন করে সাজাতে হবে। কারণ, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) প্রকল্পে চীনের অংশীদার হওয়ার পাশাপাশি ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগও বিবেচনায় রাখতে হবে। এই পরিস্থিতি ঢাকার জন্য একদিকে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করবে, অন্যদিকে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও বাড়াবে।
নিরাপত্তা ও সীমান্ত ইস্যু
বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশের মধ্যে রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। SCO সহযোগিতা কাঠামোতে চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের প্রতি কিছুটা নরম মনোভাব দেখালে বাংলাদেশের উদ্বেগ বাড়তে পারে। বাংলাদেশ চায় চীন-ভারতের সহযোগিতা মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চাপ দিতে। কিন্তু চীন ও রাশিয়ার প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান মিয়ানমারকে আরও শক্তিশালী করতে পারে, যা নিরাপত্তা পরিস্থিতি জটিল করবে।
অর্থনৈতিক সুযোগ ও প্রতিযোগিতা
SCO সহযোগিতা আঞ্চলিক বাণিজ্য, জ্বালানি ও অবকাঠামো প্রকল্পে গতি আনতে পারে। মিয়ানমার তার ভৌগোলিক অবস্থান ব্যবহার করে চীন ও ভারতের সাথে বন্দর ও গ্যাস প্রকল্প সম্প্রসারণ করতে পারবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ ও আঞ্চলিক ট্রানজিট রুটের মাধ্যমে লাভবান হতে চায়। তবে উভয় দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে যে কে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত প্রকল্প আকর্ষণ করতে পারে।

আঞ্চলিক কূটনৈতিক চাপে নতুন বাস্তবতা
চীন-রাশিয়া-ভারতের নতুন সহযোগিতা কাঠামো বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জন্য এক ধরনের ‘ব্যালান্সিং গেম’ তৈরি করবে। বাংলাদেশকে পশ্চিমা জোট, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক রেখে চলতে হবে। একই সঙ্গে, SCO ব্লকের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া ছাড়া তার বিকল্পও নেই। মিয়ানমারের জন্য এটি পশ্চিমা চাপ এড়িয়ে নতুন কূটনৈতিক পথ খুলে দেবে।
SCO সম্মেলনের পর চীন, রাশিয়া ও ভারতের সহযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে নতুন রূপ দিচ্ছে। বাংলাদেশকে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখে এগোতে হবে, যাতে সে অর্থনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করতে পারে এবং নিরাপত্তা উদ্বেগ সামলাতে পারে। অন্যদিকে, মিয়ানমার পশ্চিমাদের বিকল্প খুঁজে পেতে এই সহযোগিতা থেকে সরাসরি লাভবান হতে পারে।
বিশেষ প্রতিনিধি 



















