প্রকৃতির জগতে অনেক প্রাণী আছে যারা দেখতে নিরীহ হলেও আসলে নিজেদের বাঁচাতে অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করেছে। সাপের মধ্যে র্যাবডোফিস সাবমিনিয়েটাস, বাংলায় যাকে লাল গলার কিলব্যাক বলা হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা এই সাপের সৌন্দর্য যেমন চোখে পড়ে, তেমনি এর জটিল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিজ্ঞানীদেরও বিস্মিত করেছে। দেখতে সবুজাভ দেহ, গলার কাছে লাল দাগ এবং নীরব চলাফেরা—সব মিলিয়ে এটি সাধারণ মানুষের কাছে নিরীহ মনে হলেও বাস্তবে এটি বিষধর এবং একই সঙ্গে অনন্যভাবে অভিযোজিত।
ঐতিহাসিক নথি ও আবিষ্কার
লাল গলার কিলব্যাক নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ইতিহাস উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু। ইউরোপীয় প্রকৃতিবিদরা যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বনভূমি ও নদীবিধৌত এলাকায় ভ্রমণ করেন, তখন তারা প্রথম এই সাপটিকে সনাক্ত করেন। সেই সময়ে একে নিরীহ মনে করা হতো কারণ এর আচরণ ছিল শান্ত এবং পালানোর প্রবণতা ছিল বেশি। তবে স্থানীয় মানুষেরা জানতো যে এটি হুমকির মুখে পড়লে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
বাংলার গ্রামীণ অঞ্চলে এ সাপকে ‘লালগলা সাপ’ বা কখনো কখনো ‘পানিসাপ’ বলা হয়। লোককথায় বলা হতো, এই সাপ গলার লাল দাগ দেখিয়ে মানুষকে ভয় দেখায় এবং এর লালাভ রঙই নাকি এর শক্তি। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে পরে জানা যায়, লাল দাগ আসলে সতর্ক সংকেত—শিকারি প্রাণী বা মানুষকে দূরে থাকার বার্তা।
শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য
র্যাবডোফিস সাবমিনিয়েটাস একটি মাঝারি দৈর্ঘ্যের সাপ, সাধারণত ৭০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এক মিটার ছাড়িয়েও যায়। এর দেহ সাধারণত উজ্জ্বল সবুজ রঙের, যার উপর কালো বা বাদামি ক্রসবার থাকে। এই রঙ ও নকশা তাকে প্রাকৃতিক পরিবেশে লুকিয়ে থাকতে সহায়তা করে।
সবচেয়ে সহজে চেনার বৈশিষ্ট্য হলো গলার দুই পাশে থাকা উজ্জ্বল কমলা বা লালচে দাগ। এই দাগই এর সবচেয়ে পরিচিত চিহ্ন। এর আঁশগুলো খাঁজকাটা বা কিলযুক্ত, যা ঝোপঝাড় ও ঘাসের ভেতর দিয়ে চলাফেরা করতে সহায়তা করে। মাথা গলা থেকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা, আর চোখ গোলাকার মণিযুক্ত। এ কারণে সাপটিকে দেখতে নিরীহ লাগে। এর সৌন্দর্য অনেক সময় মানুষকে বিভ্রান্ত করে, ফলে অনেকে মনে করে এটি অবিষধর, অথচ বাস্তবে এর হালকা বিষ আছে।
বিস্তৃতি ও আবাসস্থল
লাল গলার কিলব্যাকের বিস্তৃতি দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশে। বাংলাদেশে বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও নদীবিধৌত এলাকায় এদের প্রায়ই দেখা যায়। ভারতে আসাম ও মেঘালয়সহ উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের আর্দ্র বনাঞ্চল এদের প্রিয় আবাস। নেপাল ও ভুটানের পাহাড়ি অঞ্চলের নদী-খাল ও জলাভূমিতেও এদের দেখা মেলে।
মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসের গ্রামীণ এলাকায়, ধানক্ষেত ও ঝোপঝাড়ে এরা সহজেই টিকে থাকে। দক্ষিণ চীনের বনাঞ্চল ও মালয় উপদ্বীপেও এরা স্বাভাবিকভাবে বাস করে। এমনকি ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা ও জাভা দ্বীপেও এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এ সাপ মূলত আর্দ্র পরিবেশে বসবাস করতে পছন্দ করে। ধানক্ষেত, খাল-বিল, জলাশয়, বনাঞ্চলের ধারে কিংবা গ্রামীণ ঝোপঝাড় এদের স্বাভাবিক আবাস। আধা-জলচর স্বভাবের কারণে এটি সহজেই জলে সাঁতার কাটতে পারে এবং স্থলেও সমান দক্ষ।
খাদ্যাভ্যাস
খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকে লাল গলার কিলব্যাক বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এটি মূলত ব্যাঙ, ট্যাডপোল ও ছোট মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে। মাঝে মাঝে ছোট টিকটিকি বা অন্যান্য উভচর প্রাণীকেও খায়।
সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, এ সাপ খাওয়া বিষাক্ত টোডের শরীর থেকে রাসায়নিক বিষ শোষণ করে। সেই বিষ নুচাল গ্রন্থিতে জমা করে রাখে। হুমকির সময় সেই গ্রন্থি থেকে বিষাক্ত তরল বের হয় এবং শিকারিকে প্রতিহত করে। অর্থাৎ এটি নিজের শরীরে উৎপাদিত বিষের পাশাপাশি খাদ্য থেকে সংগ্রহ করা বিষও ব্যবহার করে। এই বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর সাপদের মধ্যে বিরল এবং বিজ্ঞানের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
বিষ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
অনেক বছর ধরে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন এই সাপ নিরীহ। কারণ এরা সাধারণত মানুষকে আক্রমণ করে না এবং কামড় খুব কমই দেয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায় যে এর পেছনের দাঁত বড় এবং সামান্য বিষ নিঃসরণ করতে সক্ষম। কামড়ালে মানুষের ত্বকে ব্যথা, ফোলা, লালচে দাগ ও বিরল ক্ষেত্রে মাথা ঘোরা বা স্নায়বিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যদিও এটি প্রাণঘাতী নয়, অবহেলা করলে চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।
সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা হলো এর নুচাল গ্রন্থি। এই গ্রন্থি সাপটির গলার দুই পাশে থাকে এবং টোড থেকে সংগৃহীত বিষ জমা রাখে। বিপদের সময় সাপটি গলা চ্যাপ্টা করে ফেলে, লাল দাগ উজ্জ্বলভাবে দেখা যায় এবং গ্রন্থি থেকে দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত তরল নিঃসৃত হয়। এই তিনটি একসঙ্গে শিকারিকে সতর্ক করে তোলে। ফলে শিকারি প্রাণী সাপটিকে এড়িয়ে চলে।
আচরণ
লাল গলার কিলব্যাক সাধারণত দিনের বেলা সক্রিয় থাকে। এটি জলে সাঁতার কাটা, গাছে ওঠা এবং ঝোপঝাড়ে চলাফেরায় সমানভাবে দক্ষ। তবে মূলত জমির কাছাকাছি বা জলাশয়ের ধারে থাকে।
মানুষের প্রতি এর আচরণ বেশ ভীতু প্রকৃতির। মানুষ কাছে গেলে সাধারণত পালিয়ে যায়। খুব প্রয়োজনে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে। এজন্য গ্রামীণ এলাকায় মানুষ প্রায়ই এ সাপকে নিরীহ ভেবে অবহেলা করে, আবার কেউ কেউ ভুল ধারণায় ভয়ে মেরে ফেলে।
প্রজনন
প্রজননকালে স্ত্রী সাপ ছয় থেকে পনেরটি ডিম পাড়ে। ডিম সাধারণত ভেজা মাটির নিচে বা শুকনো পাতার নিচে রাখা হয়। ডিম থেকে বাচ্চা বের হতে প্রায় দুই মাস সময় লাগে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাচ্চারা জন্মের পর থেকেই গলার লাল দাগ বহন করে। এই দাগ শিকারিদের জন্য প্রথম থেকেই সতর্ক সংকেত হিসেবে কাজ করে। এভাবে প্রকৃতি বাচ্চাদেরও প্রতিরক্ষার সুযোগ দেয়।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার গুরুত্ব
বিজ্ঞানীরা এই সাপ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন যে এটি বিষ উৎপাদন ও সংগ্রহ—দুই ক্ষমতার অধিকারী। এটি পৃথিবীর সাপদের মধ্যে অন্যতম বিরল বৈশিষ্ট্য। এর নুচাল গ্রন্থি প্রাণিজগতে একটি অনন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
গবেষণা থেকে কেমিক্যাল ইকোলজি এবং অভিযোজনবিদ্যা সম্পর্কে নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এর বিষ ও রাসায়নিক উপাদান ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য বর্তমানে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ সাপ নিয়ে গবেষণা চলছে।
লোককথা ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
বাংলাদেশ ও ভারতের গ্রামীণ অঞ্চলে লাল গলার কিলব্যাককে নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে। অনেকের বিশ্বাস, এর গলার লাল দাগ নাকি মানুষের রক্ত চুষে নেয়ার ক্ষমতার প্রতীক। কেউ কেউ মনে করে, লাল দাগ বের করলে মৃত্যু আসন্ন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অঞ্চলে এটি পানির রক্ষক সাপ হিসেবে পরিচিত। যদিও এসব কুসংস্কার বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক নয়, তবুও স্থানীয় সংস্কৃতিতে এই সাপের বিশেষ স্থান রয়েছে। কুসংস্কারের কারণে মানুষ একে প্রায়ই মেরে ফেলে, ফলে সংরক্ষণ প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়।
সংরক্ষণ অবস্থা
বর্তমানে আইইউসিএন (IUCN) অনুসারে লাল গলার কিলব্যাককে ঝুঁকিমুক্ত তালিকায় রাখা হয়েছে। কারণ এটি এখনও বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। তবে এর কিছু হুমকি রয়েছে। আবাসস্থল ধ্বংস, ধানক্ষেত কমে যাওয়া, বন উজাড় হওয়া এবং জলাভূমি দূষণ এদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ।
মানুষ ভুল ধারণায় প্রায়ই একে মেরে ফেলে। ফলে অনেক এলাকায় এদের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। যদি সচেতনতা না বাড়ে, তবে ভবিষ্যতে এ সাপও বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে।
পরিবেশগত ভূমিকা
লাল গলার কিলব্যাক পরিবেশের জন্য উপকারী। এটি ব্যাঙ ও উভচর প্রাণীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। আবার এটি নিজেও বড় সাপ, পাখি ও স্তন্যপায়ীর খাদ্য হয়। প্রকৃতির খাদ্যচক্রে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ।
এর অনন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গবেষকদের নতুন জ্ঞান দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এর রাসায়নিক প্রতিরক্ষা কৌশল নিয়ে গবেষণা করে অনেক নতুন তথ্য জানতে পেরেছেন। ফলে এটি শুধু একটি সাপ নয়, বরং বৈজ্ঞানিক গবেষণারও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
র্যাবডোফিস সাবমিনিয়েটাস বা লাল গলার কিলব্যাক কেবল একটি সাপ নয়, বরং প্রকৃতির এক বিস্ময়। এর বাহ্যিক সৌন্দর্য, গলার লাল দাগ, হালকা বিষ, শিকার থেকে সংগৃহীত রাসায়নিক প্রতিরক্ষা, আচরণ ও প্রজনন সবই বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের কাছে আকর্ষণীয়।
মানুষ একে ভুলভাবে ভয় পায়, অথচ বাস্তবে এটি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অপরিহার্য। তাই এ প্রজাতি সংরক্ষণ করা শুধু জীববৈচিত্র্য রক্ষা নয়, বরং প্রকৃতির অনন্য অভিযোজন কৌশলগুলোকেও ভবিষ্যতের জন্য টিকিয়ে রাখা।