আফ্রিকান পিগমি হাঁস (African Pygmy Goose) হলো বিশ্বের ক্ষুদ্রতম হাঁসদের অন্যতম। এর বৈজ্ঞানিক নাম Nettapus auritus। হাঁস পরিবারের সদস্য হলেও আকার ও আচরণে এটি অনেকটা ভিন্ন। আফ্রিকার জলাভূমি, হ্রদ ও মাদাগাস্কার দ্বীপের স্বচ্ছ পানিতে এরা বহুদিন ধরে বাস করছে। রঙিন পালক, ক্ষুদ্র আকার এবং অনন্য জীবনধারার কারণে পাখিপ্রেমী ও গবেষকদের কাছে এটি বিশেষভাবে আকর্ষণীয়।
আকার ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য
আকারে এই হাঁস ছোট হলেও দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। পূর্ণবয়স্ক পাখির দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার, ওজন প্রায় ২৬০ থেকে ২৮০ গ্রাম। ডানার বিস্তার সর্বোচ্চ ৪০ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির মাথার ওপর থাকে উজ্জ্বল সবুজ-কালচে ঝিলিক, চোখের চারপাশে থাকে কালো মাস্কের মতো দাগ, বুক ও গলা হয় সাদা, আর ঠোঁটে থাকে কমলা রঙের আভা। স্ত্রী পাখির রঙ তুলনামূলক ম্লান, চোখের চারপাশে কোনো দাগ থাকে না এবং ঠোঁট হয় ধূসরচে। এভাবে সহজেই পুরুষ ও স্ত্রী পাখিকে আলাদা করা যায়।

বিস্তার ও আবাসস্থল
আফ্রিকান পিগমি হাঁস মূলত আফ্রিকার সাহারা-দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তৃত। নাইজেরিয়া, কঙ্গো, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মাদাগাস্কার দ্বীপে এরা বিশেষভাবে দেখা যায়। এরা সাধারণত শান্ত ও স্বচ্ছ পানির হ্রদ, নদী, বিল এবং পুকুরে বসবাস করে। যেখানে শাপলা, পদ্ম ও কচুরিপানার মতো ভাসমান জলজ উদ্ভিদ থাকে, সেখানে এরা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করে। বনভূমির ভেতরে লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট জলাশয়েও এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
খাদ্যাভ্যাস
আফ্রিকান পিগমি হাঁস মূলত উদ্ভিদভোজী। শাপলা ও পদ্মফুলের বীজ এদের প্রিয় খাদ্য। এ ছাড়াও কোমল কাণ্ড ও পাতাও খায়। পানিতে ভেসে থেকে ঠোঁট দিয়ে ধীরে ধীরে খাবার সংগ্রহ করে। প্রয়োজনে ছোট পোকামাকড় ও শৈবালও খেয়ে থাকে। এভাবে এরা জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং জলাশয়ের প্রতিবেশ ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনে।
প্রজনন ও বাসা বাঁধা
এই হাঁসের প্রজনন মৌসুম সাধারণত বর্ষাকালে হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এরা নিজেরা বাসা তৈরি করে না। গাছের ফোঁকরে বা অন্য পাখির পুরোনো বাসা ব্যবহার করে। স্ত্রী হাঁস একসাথে ৬ থেকে ১২টি ডিম পাড়ে এবং প্রায় ২৫ থেকে ২৬ দিন ধরে তা দেয়। পুরুষ হাঁস কাছাকাছি থেকে পাহারা দেয়। সদ্য ফোটা বাচ্চা দ্রুত পানিতে নামতে পারে এবং মায়ের সঙ্গে সাঁতার শিখে খাবার সংগ্রহ শুরু করে।

আচরণ ও সামাজিক জীবন
আচরণগতভাবে আফ্রিকান পিগমি হাঁস অত্যন্ত লাজুক। মানুষের উপস্থিতি টের পেলে সঙ্গে সঙ্গে ডুব দেয় অথবা দ্রুত উড়ে পালায়। সাধারণত ছোট দলে চলাফেরা করে, যেখানে ৫ থেকে ১৫টি পাখি থাকে। শীতকালে বড় দলে একত্রিত হলেও এরা শান্ত স্বভাবের কারণে ঝগড়া বা সংঘর্ষে জড়ায় না। ছোট দূরত্বে উড়তে পারলেও এরা পানিতে সাঁতার কাটতে এবং ভেসে থাকতে খুবই দক্ষ।
ইতিহাস ও লোককথা
আফ্রিকার গ্রামীণ সমাজে পিগমি হাঁসকে নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে। অনেক অঞ্চলে এই হাঁসকে সৌন্দর্য ও শান্তির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। কিছু এলাকায় বিশ্বাস করা হয়, হ্রদে পিগমি হাঁসের উপস্থিতি মানেই জলাশয় উর্বর ও নিরাপদ। আফ্রিকার শিল্পকলা ও লোকসাহিত্যে এই পাখির ছবি ও গল্প বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়। মাদাগাস্কারের লোককথায় পিগমি হাঁসকে দেবতাদের দূত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যারা জল ও জীবনের প্রতীক বহন করে।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা
পাখিবিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে আফ্রিকান পিগমি হাঁস নিয়ে গবেষণা করছেন। এরা ছোট আকারের হলেও পরিবেশগতভাবে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। ভাসমান জলজ উদ্ভিদের বীজ খাওয়ার মাধ্যমে এরা উদ্ভিদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, যেখানে পিগমি হাঁসের সংখ্যা বেশি, সেখানে শাপলা-পদ্মের অযাচিত বিস্তার হয় না, ফলে জলাশয় ভারসাম্যপূর্ণ থাকে। এই পাখির জীবনযাপন পদ্ধতি জলাভূমির স্বাস্থ্য নির্ধারণের সূচক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
সংরক্ষণ অবস্থা
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (IUCN) আফ্রিকান পিগমি হাঁসকে “Least Concern” তালিকায় রেখেছে। অর্থাৎ বর্তমানে এরা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে নেই। তবে জলাভূমি ভরাট, দূষণ, অতিরিক্ত মাছ ধরা ও জলজ উদ্ভিদ ধ্বংসের কারণে এদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হতে পারে। আফ্রিকার অনেক দেশেই জলাভূমি দ্রুত সঙ্কুচিত হচ্ছে, যা এই পাখিদের জন্য বড় হুমকি। গবেষকরা মনে করেন, যদি জলাভূমি রক্ষার কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে এদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















