ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ – ডাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নারী প্রার্থীদের সামাজিক মাধ্যমে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। তাদের নির্বাচনি প্রচারের উদ্দেশ্যে দেওয়া পোস্টের নিচে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য থেকে শুরু করে ইনবক্সে অশ্লীল বার্তা পাঠানো, এমনকি ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাই এসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া এবং প্রতিপক্ষকে হেয় করার জন্য উদ্দ্যশ্যপ্রণোদিতভাবে তারা এই কাজগুলো করছে।
সেক্ষেত্রে, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের একপক্ষ অন্যপক্ষের দিকে আঙুল তুলছেন।
একইসাথে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নারীবিদ্বেষী রাজনীতির উত্থান হয়েছে বলে কেউ কেউ অভিযোগ করছেন এবং তারা এই আক্রমণকে তারই অংশ হিসেবে দেখছেন।
দীর্ঘদিন রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক নারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, সবশেষ ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনের তুলনায় এবারের নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের ব্যক্তিগত আক্রমণ ও সামাজিক পরিসরে হেনস্তার ঘটনা বেড়েছে।
আর এর কারণ হিসেবে সামনে আসছে গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে নারীদের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণের দিকটি। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গা থেকেই নারীর প্রতি প্রতিহিংসামূলক এসব কর্মকাণ্ড বাড়ছে।
বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের মতে, আগেও নারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা চালানো হতো। তবে এবার ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণা সামাজিক পরিসরকেন্দ্রিক হওয়ায় এই ধরনের ঘটনাগুলো অনেক বেশি চোখে পড়ছে।
এছাড়াও রাজনৈতিক পরিসরে নারীরা যখনই এগিয়ে যেতে চেয়েছে, তখনই এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
এদিকে নারী প্রার্থীদের হেনস্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি করছে কর্তৃপক্ষ।

ডাকসুতে ২৮টি পদের নির্বাচনে ৪৭১ প্রার্থীর মধ্যে ৬২ পদে প্রার্থী হয়েছেন ছাত্রীরা
পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগের
কয়েকদিন আগে ইসলামি ছাত্র শিবিরের প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের’ জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদের মনোনয়ন চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন বাম জোটের প্যানেল থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনবিষয়ক সম্পাদক প্রার্থী বি এম ফাহমিদা আলম।
এই ঘটনায় ফাহমিদাকে ‘গণধর্ষণের’ ডাক দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট করেন আলী হুসেন নামের এক শিক্ষার্থী, পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছয় মাসের জন্য তাকে বহিষ্কার করা হয়।
এটা কেবল একটি ঘটনা। প্রচার-প্রচারণা করতে গিয়ে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হবার কথা জানিয়েছেন ডাকসুর প্রায় সব নারী প্রার্থী। তারা বলছেন, যারা চায় না নারীরা রাজনীতিতে আসুক, তারাই এই ধরনের কর্মকান্ডের সাথে জড়িত।
আর “প্রসঙ্গ যখন নারীবিদ্বেষের, তখন আসলে কতিপয় ডানপন্থি ও মধ্যপন্থি দল একাকার হয়ে যায়, তখন আর তাদের মতভেদ থাকে না”, বলছিলেন শেখ তাসনিম আফরোজ (ইমি)।
বামপন্থী কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধ পর্ষদ থেকে সহসভাপতি বা ভিপি পদে দাঁড়ানো এই প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ২০১৯ সালেও ডাকসু নির্বাচনেও।
তার দাবি, আগেরবারও নারী প্রার্থীদের সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হলেও “এবারের ব্যাপারগুলো অনেক বেশি নোংরা”।
২০১৮ সালের সড়ক আন্দোলন বা কোটা আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকায় সেসময়কার ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন তিনি। কিন্তু কেবল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে চরিত্র হননের ঘটনা স্মরণ করতে পারেননি।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাই এসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত।
ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেওয়া নারী প্রার্থীদের দাবি, ছাত্র সংসদ নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক হলেও, সামাজিক মাধ্যমের হয়রানি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তার বাইরেও নানা রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকজন এর সাথে যুক্ত।
ছাত্র সংসদে অংশ নেওয়া কয়েকটি প্যানেলের নারী প্রার্থীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় একে অন্যের বিরুদ্ধে হেনস্তার অভিযোগ তুলতে দেখা গেছে।
‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ পর্ষদ থেকে সহসভাপতি পদে দাঁড়ানো উমামা ফাতেমা বলছেন, ‘প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অস্ত্র’ হিসেবে সাইবার পরিসরকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পোস্টের কমেন্টে এবং ইনবক্সে ‘ট্যাগিং’ করে ‘জেন্ডারবেসড স্ল্যাং ও থ্রেট’ বা লিঙ্গভিত্তিক গালি ও হুমকি-ধামকি পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ডাকসুর কেন্দ্রীয় সমাজসেবা পদপ্রার্থী সীমা আক্তার। তার দাবি, ‘গুপ্ত রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নারীবিদ্বেষী শক্তি” এসব কর্মকান্ডের সাথে জড়িত।
সরাসরি শিবিরের দিকে আঙুল তুলেছেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান। বলছেন, কেবল নারী প্রার্থীরাই নয়, শিবির-পরিচালিত ফেসবুক থেকে ভুয়া এবং অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে পুরুষ প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও।
অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করছেন শিবির নেতা সাদিক কাইয়ুম। একে “ফ্রেমিং করে দায় দিয়ে দেওয়ার অপরাজনীতি” বলেও দাবি করেন তিনি।
উল্টো অভিযোগ শোনা যাচ্ছে শিবির সমর্থিত প্যানেলের দিক থেকেও। তাদের নারী প্রার্থী ফাতিমা তাসনিম জুমা বলছেন, পোস্টের কমেন্টে নোংরা শব্দচয়ন ছাড়াও এআই দিয়ে তার অশ্লীল ভিডিও বানানো হয়েছে, হুমকি দেওয়া হয়েছে তার পরিবারকে।
আর এরসঙ্গে “ছাত্রদলের বেশিরভাগ, তাছাড়াও কয়েকজন বামপন্থি, যাদের বন্ধুবান্ধব আমার অপনেন্ট (প্রতিপক্ষ) এই কাজটা করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে একেবারে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মী প্রত্যেকেই করেছে”, দাবি করেন তিনি।

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের একপক্ষ অন্যপক্ষের দিকে আঙুল তুলছেন
তবে নারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে যেকোনো হেনস্তার ঘটনা রুখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন “বদ্ধ পরিকর” বলে দাবি করেছেন ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।
অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং তাদের ক্ষেত্রে আচরণবিধি আইন প্রযোজ্য হবে বলেও জানান তিনি।
“বিটিআরসি থেকে আরম্ভ করে ডিএমপি কমিশনারের সাইবার সেল – সব জায়গায় অভিযোগ করা হচ্ছে। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা গেলে তাদের ডেকে, ফোন ও চিঠি দিয়ে বিভিন্নভাবে কমানোর চেষ্টা করছি”, বলেন তিনি।
এই কর্মকর্তার দাবি, প্রথমদিকে অভিযোগ অনেক বেশি থাকলেও এখন তা সহনীয় মাত্রায় আসছে। “এটা আশা করি থাকবে না”।
‘নারীকে দমিয়ে রাখার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সাইবার বুলিং’
রাজনীতিতে আগ্রহী বা সংশ্লিষ্ট নারীদের চরিত্র নিয়ে হেনস্তার শিকার হবার বিষয়টি অবশ্য নতুন নয় বলেই মত রাজনীতি বিশ্লেষক এবং পর্যবেক্ষকদের অনেকের।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের বড় দলগুলোর নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত নারীদের ‘চারিত্রিকভাবে কলঙ্কিত করার প্রয়াস এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সবসময়ই ছিল”।
নারীকে দমানোর বড় অস্ত্র হিসেবে এটিকে ব্যবহার করা হয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক রাশেদা রওনক খান।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু হচ্ছে না। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়টি হলো, এবারের ডাকসু নির্বাচনে নারী প্রার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।
ডাকসুতে ২৮টি পদের নির্বাচনে ৪৭১ প্রার্থীর মধ্যে ৬২ পদে প্রার্থী হয়েছেন ছাত্রীরা, ২০১৯ সালের সাথে তুলনা করলে যার সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি।
দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সাবেক নারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে নারীদের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। যা কোথাও না কোথাও পুরুষদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে আতঙ্ক তৈরি করছে।
আর সে কারণেই নারীর সম্পর্কে অবদমিত যে চিন্তা সমাজে আগে থেকেই ছিল, সেই জায়গা থেকেই সাইবার বুলিংকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তাদের ওপর আক্রমণ বেড়েছে।

নারীকে দমানোর বড় অস্ত্র হিসেবে সাইবার বুলিংকে ব্যবহার করা হচ্ছে
এনিয়ে রাশেদা রওনক খান বলেন, “যখনই চেয়ারের বিষয় আসে তখন আর নারী-পুরুষ থাকে না। তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে দমানোর জন্য যত রকমের অস্ত্র আছে, বিরোধী পক্ষ সবগুলো কাজে লাগায়”।
“বিরোধী পক্ষ যদি নারী হয়ে যায়, অপর পক্ষের জন্য সুবিধা হয়ে যায় ওই নারী প্রতিদ্বন্দ্বীর চরিত্র সামনে নিয়ে এসে তাকে ঘায়েল করা। সেটাই হচ্ছে”, বলেন তিনি।
কিন্তু বর্তমানে নতুন যে দিকটি যুক্ত হয়েছে, তা হলো সাইবার পরিসরে তা সহজেই প্রকাশ করা যায়।
“বুলিংতো মেইনলি হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। এখন বেশি নজরে পড়ে ওগুলো, আগে পড়তো না। কিন্তু স্লোগানে, মিছিলে, আড্ডায় আগেও হতো”, বলেন রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।
কেউ কেউ বলছেন, একসময় ক্যাম্পাসে দখলদারিত্বের রাজনীতি থাকায় অনেক নারী রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করতেন।
কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে নারীদের আগ্রহ বাড়লেও দেশের সামগ্রিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নারীদের এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার বেশি হতে হচ্ছে, তা যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে, তেমনি বাইরেও।
২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক বা জিএস পদে লড়েছিলেন উম্মে হাবিবা বেনজির। তার মতে, বিচার না হবার কারণেই এই ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আর নতুন করে এআই ক্রিয়েটেড বা বট আইডি আক্রমণের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রগতি বর্মণ তমা বলেন, “পুরো অভ্যুত্থানে সারা বাংলাদেশে নারীদের যে অংশগ্রহণ ছিল, এটাকে ঠেকাতে সুনির্দিষ্টভাবে একটা গোষ্ঠী সংঘটিতভাবে এই কাজগুলো করছে”।
বিশেষ করে যে মেয়েগুলো ফেসবুকে ভোকাল ছিল বা সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের কথাগুলো বলতে দ্বিধা বোধ করতো না, এটাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে তারা আওয়াজ তোলার কাজ করছিল তাদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দীর্ঘ ইতিহাসে মাত্র দুইবার নারী ভিপি পেয়েছে ডাকসু। কিন্তু সাইবার পরিসরে হেনস্তার বাধাগুলো পেরিয়ে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারী প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়টিকে “ইতিবাচক” হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিবিসি নিউজ বাংলা
তানহা তাসনিম 


















