ব্রিটেনে রিফর্ম ইউকে এখন ক্ষমতায় যাওয়ার পথে। দলটির লক্ষ্য হলো সংবিধান ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনা, যেটি অনেকটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকান প্রশাসনিক ধাক্কার মতো। তবে যুক্তরাজ্যের দুর্বল ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ কাঠামো এই পরিবর্তনের জন্য আরও বেশি অনুকূল হতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রকল্প আর ব্রিটিশ বাস্তবতা
আমেরিকায় ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যুরোক্রেসি-কমানো প্রকল্প মাত্র ১৩০ দিনের মধ্যেই থেমে যায়। এর অন্যতম কারণ ছিল এলন মাস্কের অস্থিরতা। রিফর্ম ইউকের কৌশলবিদ জিয়া ইউসুফ মনে করেন, আসল বাধা ছিল মার্কিন সংবিধানের কাঠামো, যেখানে কংগ্রেস বাজেট নিয়ন্ত্রণ করে। আর এখানেই ব্রিটেনের ভিন্নতা: সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া প্রধানমন্ত্রী চাইলে অনেক দ্রুত নীতি বাস্তবায়ন করতে পারেন।

রিফর্ম ইউকের লক্ষ্য
রিফর্ম ইউকে ঠিক করেছে, ক্ষমতায় এলে তারা এক ধাক্কায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করবে। ৫–৬ সেপ্টেম্বর বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত দলীয় সম্মেলনে নাইজেল ফারাজ এই পরিকল্পনা প্রকাশ করবেন। জরিপে দেখা যাচ্ছে, দলের জনপ্রিয়তা এখন ৩১ শতাংশ এবং নির্বাচনের সম্ভাবনা শক্তিশালী। অভিবাসন ইস্যু ও পুলিশি পক্ষপাতের অভিযোগ তাদের সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে।
জিয়া ইউসুফের মতে, সমস্যার মূল হলো ব্রিটিশ জনগণ আর প্রতিষ্ঠানগুলোতে আস্থা রাখছে না। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করে না, বরং পরিবর্তনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই রিফর্ম ইউকের পরিকল্পনা হলো ‘পুরনো স্বাভাবিক অবস্থায়’ ফিরে যাওয়া—যেখানে আন্তর্জাতিক চুক্তি কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং মন্ত্রীরাই সিদ্ধান্ত নিতেন, দূরবর্তী সংস্থা নয়।

সংসদীয় সার্বভৌমত্বকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার
দলটি সংসদীয় সার্বভৌমত্বকে মূল অস্ত্র বানাতে চায়। ফারাজের প্রথম বড় লড়াই ছিল ব্রেক্সিট, যেখানে নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা ফেরানোর কথা বলা হয়েছিল। এবার ক্ষমতায় গেলে তিনি সেটি পূর্ণাঙ্গভাবে করতে চান।
যদিও তিনি সংসদকে শক্তিশালী করার কথা বলেন, তার নেতৃত্ব আসলে অনেকটা প্রেসিডেন্ট শাসিত ধারার মতো হবে। ফারাজ বলেছেন, মন্ত্রিসভায় কেবল এমপিদের রাখা হবে না, ব্যবসায়ী ও বাইরের বিশেষজ্ঞদেরও নিয়োগ দেওয়া হবে, অনেকটা আমেরিকার মতো।
প্রধান লক্ষ্য: অভিবাসনবিরোধী পদক্ষেপ
রিফর্ম ইউকের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হলো পাঁচ বছরে প্রায় ৬ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে বহিষ্কার করা। এর জন্য তারা “অপারেশন রিস্টোরিং জাস্টিস” নামের একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। প্রথম ধাপেই দলটি শরণার্থী কনভেনশন ও ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশনসহ আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে।
এছাড়া বিচার বিভাগের ক্ষমতা সীমিত করারও চেষ্টা থাকবে। বহিষ্কার আইন এমনভাবে তৈরি করা হবে যাতে আদালত সেটি চ্যালেঞ্জ করতে না পারে। ঊর্ধ্বতন আমলাতন্ত্র ভেঙে রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ নিয়োগ দেওয়া হবে। হাউস অব লর্ডসের সঙ্গে বড় সংঘর্ষ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সংবিধান নিয়ে বিতর্ক
রিফর্ম ইউকের অবস্থান নতুন নয়। কনজারভেটিভ সরকারও আন্তর্জাতিক চুক্তি উপেক্ষা করে অভিবাসন কমানোর চেষ্টা করেছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারও মনে করেন সরকারের কেন্দ্রীয় কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে।
তবে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ মার্ক এলিয়ট মনে করেন, রাজনীতিবিদদের কখনো পুরোপুরি আদালত ও আন্তর্জাতিক আইনের বাইরে কাজ করার ‘সোনালী যুগ’ ছিল না। ব্রিটেন সব সময়ই তার চুক্তিগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছে।
রিফর্ম ইউকের সীমাবদ্ধতা
সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা আসবে দলটির ভেতর থেকেই। নাইজেল ফারাজ দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক ও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন, যা ক্ষমতায় গিয়ে অচলাবস্থার কারণ হতে পারে। দলের সংসদ সদস্য এখন মাত্র চারজন।
তবে দলের অন্যতম মুখ জিয়া ইউসুফ নিজেকে আলাদা করে তুলেছেন। তিনি ৩৮ বছর বয়সী মুসলিম, আগে গোল্ডম্যান স্যাক্সে কাজ করেছেন এবং একটি বিলাসবহুল ভ্রমণ অ্যাপ চালু করে অর্থ উপার্জন করেছেন।

রিফর্ম ইউকের নীতিগুলো এখনো অস্পষ্ট ও খরচের হিসেবে দুর্বল। তবুও তারা নিজেদের অভিজ্ঞতাহীনতাকে গুণ হিসেবে প্রচার করছে। ফারাজের ডেপুটি রিচার্ড টিসে বলেন, “আমরা সবসময় শুনি—তোমরা জানো না কীভাবে করতে হয়, তোমরা পেশাদার নও। কিন্তু যারা ২০ বছর ধরে দেশ চালাচ্ছে, তাদের হাতে ফল কী হলো?”
, রিফর্ম ইউকে ব্রিটেনের সাংবিধানিক কাঠামোকে উল্টে-পাল্টে নতুনভাবে সাজাতে চাইছে। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা যেমন বড়সড়, তেমনি অনিশ্চয়তাও বিশাল।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















