সাবালকত্বের আচার
৬ সেপ্টেম্বর টোকিওর ইম্পেরিয়াল প্যালেসে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে জাপানের প্রিন্স হিশাহিতো সাবালক হলেন। সম্রাট নারুহিতোর ভাতিজা ও তাঁর বাবার পর সম্রাট হওয়ার দ্বিতীয় উত্তরাধিকারী ১৯ বছর বয়সী হিশাহিতো এদিন কালো সিল্ক ও ল্যাকার মুকুট গ্রহণ করেন। এটি রাজকীয় জীবনে তাঁর প্রাপ্তবয়স্কতার সূচক হিসেবে গণ্য।
অনুষ্ঠানে তিনি প্রথাগত হলুদ পোশাক পরে সম্রাট নারুহিতো ও সম্রাজ্ঞী মাসাকোর সামনে মাথা নত করে বলেন, “আজ সাবালকত্ব অনুষ্ঠানে মুকুট দেওয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।” এরপর তিনি যোগ করেন, “একজন প্রাপ্তবয়স্ক রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে আমি দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকব এবং কর্তব্য পালন করব।”

পরবর্তীতে তিনি প্রাপ্তবয়স্কদের কালো রঙের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে রথে চড়ে অন্য আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দেন।
নারী উত্তরাধিকারের প্রশ্ন
যদিও সম্রাট নারুহিতোর একটি কন্যা আছে—প্রিন্সেস আইকো, বয়স ২৩—তাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারের বাইরে রাখা হয়েছে। কারণ জাপানের প্রথা অনুযায়ী কেবল পুরুষ উত্তরসূরিই রাজপরিবারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারে, যা কিংবদন্তি অনুসারে ২,৬০০ বছর ধরে চলে আসছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ নারী সম্রাজ্ঞী হওয়ার ব্যাপারে সমর্থন জানাচ্ছেন। টোকিওর এক বারের কর্মী ইউতা হিনাগো (৩৩) বলেন, “আমার কাছে তফাৎ নেই, নারী সম্রাজ্ঞী হোক বা পুরুষ সম্রাট।” আংশিক সময়ের দোকানকর্মী মিনোরি ইচিনোসে (২৮) জানান, “লিঙ্গ কোনো ব্যাপার না, নারী সম্রাজ্ঞী হওয়ার পক্ষে আমি।”

রাজনৈতিক দ্বিধা ও বিলম্ব
জাপানে কয়েক দশক ধরে সিংহাসন উত্তরাধিকার নিয়ে বিতর্ক চলছে। ২০০৫ সালে সরকারি এক বিশেষ প্যানেল সুপারিশ করেছিল যে, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে বড় সন্তানই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবেন। এতে সম্রাট নারুহিতোর কন্যার সিংহাসনে ওঠার পথ সুগম হচ্ছিল।
কিন্তু ২০০৬ সালে প্রিন্স হিশাহিতোর জন্মের পর এ বিতর্ক থেমে যায়। রাজনীতিবিদরা তখন থেকে সমস্যাটি এড়িয়ে গেছেন। পোর্টল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটির জাপানি স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক কেনেথ রুফ বলেন, তরুণ হিশাহিতোর উপস্থিতি রাজনীতিবিদদের ‘সমাধান পিছিয়ে দেওয়ার’ অজুহাত দিয়েছে।
অন্যদিকে রক্ষণশীলরা দাবি করছেন, পুরুষ উত্তরাধিকারীর এই ‘অভিন্ন রাজবংশীয় ধারা’ জাপানের ভিত্তি। পরিবর্তন আনলে জাতি বিভক্ত হতে পারে।
আধুনিক প্রস্তাব ও রক্ষণশীল মত
যুদ্ধোত্তর সংবিধান অনুযায়ী রাজপরিবারের রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। তবে রাজকন্যারা বিয়ের পর পরিবার ছেড়ে যেতে বাধ্য হওয়ায় একটি আধুনিক প্রস্তাব উঠেছে—তারা বিয়ের পরও রাজকীয় দায়িত্ব পালন করবেন।
রক্ষণশীলদের প্রস্তাব হলো দূর সম্পর্কের পুরুষ আত্মীয়দের ফিরিয়ে আনা। কিন্তু তারা নিজেদের পেশা ও স্বাধীনতা ছেড়ে রাজবংশ রক্ষায় আগ্রহী হবেন কিনা তা অনিশ্চিত।

রাজপুত্রের ব্যক্তিগত জীবন ও চ্যালেঞ্জ
২০২৫ সালে প্রিন্স হিশাহিতো জানিয়েছিলেন, তিনি এখনো বিয়ের ব্যাপারে গভীরভাবে ভাবেননি। ইতিহাসে দেখা গেছে, রাজপরিবারে বিবাহিত নারীরা পুত্র সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রচণ্ড চাপে পড়েন এবং সব সময় মিডিয়ার নজরদারিতে থাকেন।
সম্রাজ্ঞী মাসাকো রাজপরিবারে যোগ দেওয়ার পর বছরের পর বছর মানসিক চাপে ভুগেছেন, যা অনেকেই ছেলে সন্তানের প্রত্যাশার সঙ্গে যুক্ত করেন। সাবেক সম্রাজ্ঞী মিচিকোও একই ধরনের অসুস্থতায় ভুগেছিলেন।
হিশাহিতোর বোন প্রিন্সেস মাকো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী কেই কোমুরোকে বিয়ে করেছিলেন। কোমুরোর পরিবারের আর্থিক সমস্যার খবরে জাপানি ট্যাবলয়েডগুলো তাঁকে নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালায়। ফলে মাকো জটিল পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হন। পরে দম্পতি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং সম্প্রতি সন্তান জন্ম দেন।

সাধারণ মানুষের অগ্রাধিকার
যদিও নারী সম্রাজ্ঞীর পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে, বাস্তবে মানুষের দৃষ্টি এখন অর্থনৈতিক সমস্যা, বিশেষত মূল্যস্ফীতির দিকে বেশি। নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও রাজপরিবার ইতিহাসবিদ হিদেয়া কাওয়ানিশি বলেন, “যদি নারী সম্রাজ্ঞী সমর্থনকারীরা আরও জোরালো হন, তবে রাজনীতিবিদরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হলে সমাজ শান্ত হয়ে যায়, মিডিয়াও অন্যদিকে চলে যায়।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















