মার্কিন প্রশাসনের কড়া আমদানি শুল্কের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও ভারত রাশিয়ার তেল কেনা চালিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন দেশটির অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। শুক্রবার স্থানীয় টিভি চ্যানেল সিএনএন-নিউজ১৮-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রাশিয়ার তেল ভারতীয় অর্থনীতির জন্য লাভজনক এবং সাশ্রয়ী হওয়ায় এর আমদানি অব্যাহত থাকবে।
মার্কিন শুল্ক আরোপ ও তার প্রেক্ষাপট
গত মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। তার অভিযোগ, ভারত রাশিয়া থেকে সস্তায় অপরিশোধিত তেল কিনে সেটি পরিশোধনের পর বেশি দামে রপ্তানি করছে। ট্রাম্প দাবি করেন, ভারতীয় আমদানি রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থ সরবরাহ করছে।
ট্রাম্প বলেন, ভারতকে হয় ডলারের প্রতি আস্থা রাখতে হবে এবং মার্কিন বাজারে বাণিজ্য বাড়াতে হবে, নয়তো উচ্চ শুল্ক দিতে হবে। তিনি আরও মন্তব্য করেন, ভারত শিগগিরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুনরায় বাণিজ্য চুক্তির জন্য এগিয়ে আসবে এবং ক্ষমা চাইবে।

রাশিয়ার তেলের গুরুত্ব
২০২২ সালে ইউক্রেনে আক্রমণের পর ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার তেল আমদানিতে বিরতি দেয়। এই সুযোগে ভারত বড় ছাড়ে রাশিয়ার তেল কিনতে শুরু করে এবং বর্তমানে রাশিয়ার সমুদ্রপথে সরবরাহকৃত অপরিশোধিত তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী সীতারামন বলেন, ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক ও ভোক্তা দেশ। তেল আমদানিই ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় ব্যয়। তাই ভারতকে এমন সরবরাহকারী বেছে নিতে হবে যা মূল্য ও পরিবহন সুবিধার দিক থেকে সবচেয়ে উপযোগী। তিনি স্পষ্ট করে জানান, রাশিয়ার তেল কেনা অব্যাহত থাকবে।
তার ভাষায়, “আমরা এমন জায়গা থেকে তেল কিনব যা আমাদের জন্য খরচ, সরবরাহ ও পরিবহন—সব দিক থেকেই সুবিধাজনক। রাশিয়ার তেল কেনা সম্পূর্ণ আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত।”
যুক্তরাষ্ট্রের চাপ
মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক শুক্রবার ভারতকে সতর্ক করে বলেন, রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করতে হবে এবং ডলারের প্রতি সমর্থন জানাতে হবে। তিনি দাবি করেন, “আমরা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তা দেশ। চীন আমাদের কাছে বিক্রি করে, ভারতও বিক্রি করে। কিন্তু ভারত ও চীন একে অপরের কাছে বিক্রি করতে পারবে না।”

তিনি আরও বলেন, “মার্কিন ভোক্তা ভারতীয় রপ্তানির সবচেয়ে বড় ক্রেতা। যদি ভারত যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি সমর্থন না জানায়, তবে তাদের ৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে।”
মার্কিন-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কের টানাপোড়েন
সম্প্রতি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুল্ক কমানোর আলোচনায় অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য কর্মকর্তাদের নির্ধারিত দিল্লি সফর বাতিল হয় এবং দুই দেশের মধ্যে আর কোনো সরাসরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি।
কূটনৈতিক অঙ্গনে ভারতের অবস্থান
এই সপ্তাহে চীনের তিয়ানজিন শহরে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে অংশ নেন। এই বৈঠকে উত্তর কোরিয়া ও মিয়ানমারের নেতারাও ছিলেন। অনেক পর্যবেক্ষক একে পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে এক ধরনের জোট হিসেবে দেখছেন।
ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশালে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লেখেন, “দেখে মনে হচ্ছে আমরা ভারত ও রাশিয়াকে হারিয়ে ফেলেছি, তারা এখন চীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তাদের জন্য আমরা দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ কামনা করি।”

ভারতের আমদানির পরিসংখ্যান
২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত অর্থবছরে ভারতের মোট আমদানির প্রায় এক-চতুর্থাংশই ছিল তেল ও পরিশোধিত জ্বালানি। এই পরিসংখ্যান ভারতের অর্থনীতিতে জ্বালানির গুরুত্ব স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কড়া শুল্ক আরোপ ও রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও ভারত রাশিয়ার তেল কেনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। ভারতীয় নেতৃত্বের মতে, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য কোন দেশ থেকে তেল কেনা হবে, সেটি সম্পূর্ণভাবে ভারতের নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















