সিঙ্গাপুরের রাজনৈতিক অঙ্গন বহুদিন ধরেই নিয়ন্ত্রিত এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পডকাস্টের উত্থান সেই পরিবেশে এনেছে অনিশ্চয়তা ও অনানুষ্ঠানিকতা। রাজনৈতিক নেতারা এখন শুধু প্রচলিত গণমাধ্যম নয়, বরং দীর্ঘ আলাপচারিতার মাধ্যমে জনগণের কাছে নিজেদের তুলে ধরছেন।
বিরোধীদলীয় নেতা প্রিতাম সিংহের উপস্থিতি
বিরোধী দল ওয়ার্কার্স পার্টির প্রধান প্রিতাম সিংহ ফেব্রুয়ারিতে শপথভঙ্গের অভিযোগে নির্বাচন থেকে অযোগ্য ঘোষণার মুখে পড়েছিলেন। এতদিন সাবধানী অবস্থানে থাকা সিংহ সম্প্রতি স্থানীয় জনপ্রিয় পডকাস্ট “ইয়া লা বাট”-এ প্রায় দুই ঘণ্টা রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করেন। তিনি বলেন, অতিরিক্ত সাবধান হলে কিছু বলার বা ভাগ করার মতো কিছুই থাকে না।

রাজনীতিতে পডকাস্টের প্রভাব
পডকাস্ট এখন বিরোধীদের জন্য সুযোগ এনে দিয়েছে দীর্ঘভাবে নিজেদের ভাবনা প্রকাশ করার। একই সঙ্গে শাসক পিপলস অ্যাকশন পার্টি (PAP) এই মাধ্যম ব্যবহার করছে নেতাদের মানবিক দিক তুলে ধরতে। যদিও মে মাসের নির্বাচনে বিরোধীরা তেমন অগ্রগতি করতে পারেনি, তবুও পডকাস্ট নিয়ে আলোচনা অব্যাহত ছিল।
জনপ্রিয়তা ও সীমাবদ্ধতা
“ইয়া লা বাট” বা “প্ল্যান বি”-এর মতো অনুষ্ঠানগুলো তরুণ প্রজন্মের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। তবে সরকার অনলাইন ভুয়া তথ্য নিয়ন্ত্রণ আইন (POFMA)-এর মাধ্যমে একাধিক পর্বে সংশোধন নোটিশ জারি করেছে। ফলে অনেকেই মনে করেন, এই স্বাধীনতা দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে।
জনগণের আগ্রহ
ইউগভ-এর তথ্য অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো দেশে পডকাস্ট শোনার হার অনেক বেশি। সিঙ্গাপুরে নিয়মিত শ্রোতা কম হলেও যারা শোনেন, তারা গড়ে সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় দেন। এটি ২০২৩ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
নির্বাচনী প্রচারে পডকাস্ট
এপ্রিলের নির্বাচনী প্রচারে “ইয়া লা বাট” প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে অনুষ্ঠান করেছে। অনেক তরুণ ভোটার জানিয়েছেন, দীর্ঘ আলাপচারিতার মাধ্যমে তারা রাজনীতিবিদদের বক্তব্য ও নীতির ব্যাখ্যা বোঝার সুযোগ পেয়েছেন। মূলধারার গণমাধ্যমে যে ঘাটতি ছিল, তা পডকাস্ট পূরণ করেছে।

স্পনসর ও শ্রোতার বৃদ্ধি
“ইয়া লা বাট” মাসে প্রায় ৩ লাখ দর্শক ও শ্রোতা পাচ্ছে। এই জনপ্রিয়তা স্পনসর ও এমনকি প্রধানমন্ত্রী লরেন্স ওয়ংয়ের নজর কেড়েছে। নির্বাচনী প্রচারে ওয়ং কেবল এই পডকাস্টেই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন। যদিও অনেকে মনে করেন, তিনি কিছু প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন।
সমালোচনা ও গ্রহণযোগ্যতা
সহ-সঞ্চালক হরেশ তিলানি ও টেরেন্স চিয়া স্বীকার করেছেন, কখনও কখনও তারা সমালোচিত হন প্রশ্নে কঠোর না হওয়ার কারণে। তবে তাদের লক্ষ্য কঠিন বিষয়কে হাস্যরসাত্মক ও সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করা। এর ফলে রাজনীতি সাধারণ আলাপের অংশ হয়ে উঠছে।
অন্য পডকাস্টের ভূমিকা
GRVTY মিডিয়ার তৈরি “দ্য ডেইলি কেচআপ”ও নির্বাচনের আগে জনপ্রিয়তা পায়। তবে তাদেরও সমালোচনা মোকাবিলা করতে হয়—কখনও সরকারপন্থী, আবার কখনও বিরোধীপন্থী বলে অভিযুক্ত হতে হয়।
বিরোধী ও শাসক দলের ব্যবহারে পার্থক্য
বিশ্লেষকদের মতে, PAP পডকাস্টকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ও আকর্ষণীয় প্রার্থীদের সামনে এনেছে। অন্যদিকে বিরোধীরা সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পডকাস্ট PAP-এর টেকনোক্র্যাটিক ভাবমূর্তি কিছুটা নরম করেছে। তবে এই স্বাধীনতা শর্তসাপেক্ষ। অনলাইন সমালোচনামূলক মিডিয়া আগেও সরকারি চাপের মুখে পড়েছে। যদি পডকাস্ট বিরোধী কণ্ঠকে শক্তিশালী করে তোলে, তবে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে।
নতুন উদ্যোগ
মে নির্বাচনে আপেক্ষিকভাবে ভালো ফল করা ওয়ার্কার্স পার্টির দুই সদস্য সম্প্রতি নতুন পডকাস্ট শুরু করেছেন। তারা ক্যান্ডিডভাবে নিজেদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও ত্যাগের কথা শেয়ার করছেন। তবে প্রিতাম সিংহ মনে করিয়ে দিয়েছেন, তরুণ নেতাদের সুরক্ষা দেওয়াও তার দায়িত্ব।
সিঙ্গাপুরের রাজনৈতিক পরিসরে পডকাস্ট এখন আর কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং এক নতুন প্ল্যাটফর্ম যেখানে রাজনীতিবিদরা মানবিক ও অনানুষ্ঠানিক ভঙ্গিতে জনগণের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছেন। যদিও এর ভবিষ্যৎ কতটা মুক্ত থাকবে, তা এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















