নির্মাণ জোয়ারে বাগদাদ
বাগদাদের আকাশরেখায় এখন একের পর এক ক্রেন দাঁড়িয়ে আছে। বৈদ্যুতিক করাতের শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে শহরময়। তপ্ত গ্রীষ্মের রোদে শ্রমিকরা নতুন ফুটপাত বসাচ্ছে অভিজাত দোকানের সামনে। ইরাকের রাজধানী এখন নির্মাণের জোয়ারে ভাসছে। বহু বছরের যুদ্ধ ও অস্থিরতার পর দেশটি এখন স্থিতিশীল মনে হচ্ছে—যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করছে এবং বাগদাদের চেহারা বদলে দিচ্ছে।
সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা
প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ আল-সুদানি দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, তার সরকারের লক্ষ্য হলো “বছরের পর বছর যুদ্ধ ও অস্থিতিশীলতার পর সেবা ও অবকাঠামো উন্নত করা।” ২০২২ সালের অক্টোবরে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বাগদাদে ২০টি নতুন সেতু ও ওভারপাস তৈরি হয়েছে। চারটি নতুন হাসপাতাল চালু হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দেশের প্রথম ক্যান্সার হাসপাতাল ও কোরিয়ান নকশায় তৈরি আইসিইউ হাসপাতাল। ১,৭০০-রও বেশি স্কুল তৈরি বা সংস্কার করা হয়েছে। কয়েকটি বিলাসবহুল হোটেল চালুর অপেক্ষায়। বিপি আবার কাজ শুরু করেছে এবং এক্সনমোবিল ও শেভরনের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন
২০০৩ সালের পর প্রথমবারের মতো ইরাক এত শান্ত। ব্যাংক খাতে সংস্কার ঋণপ্রাপ্তি সহজ করেছে। আগে তেল ও নির্মাণ খাতের আয় বৈরুত বা জেনেভায় চলে যেত, এখন তার বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে ইরাকের ভেতরেই।
প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নজরদারি
সুদানি প্রায়শই রাজনীতিকের বদলে নির্মাণ ফোরম্যানের মতো কাজ করছেন। তিনি নিজে ফোন করে প্রকল্প তদারকি করেন, হঠাৎ করে কাজের স্থলে হাজির হন। তার নেতৃত্বাধীন বিনিয়োগ কমিটিগুলো দ্রুত প্রকল্প অনুমোদন দিতে পারে। এক বড় রিয়েল এস্টেট কোম্পানির চেয়ারম্যান নামির আল-আকাবি বলেন, “আগে যা করতে এক-দুই বছর লাগত, এখন এক বৈঠকেই সম্ভব।”
ডিজিটাল অগ্রগতি ও রাজস্ব বৃদ্ধি
শুধু রাজধানী নয়, গোটা দেশে পরিবর্তন দৃশ্যমান। পাসপোর্ট অফিস এখন মাত্র ৪৫ মিনিটে নতুন পাসপোর্ট দেয়—যা কর্মকর্তাদের দাবি অনুযায়ী বিশ্বের দ্রুততম। ২০২৩ সাল পর্যন্ত বার্ষিক কাস্টমস রাজস্ব ৯০০ বিলিয়ন দিনারের বেশি হয়নি; এ বছর তা ৩ ট্রিলিয়ন দিনার ছাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমদানির জালিয়াতি কমে গেছে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায়।
সরকারি বেতন আর নগদে নয়; সব লেনদেন এখন ব্যাংক কার্ডে। পাঁচ বছর আগেও প্রায় কেউই ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করত না, আজ তা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

মিলিশিয়াদের সঙ্গে সূক্ষ্ম ভারসাম্য
ইরানের সমর্থিত মিলিশিয়াদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে চলছেন সুদানি। তার আশা, তাদের সহিংসতা থেকে সরিয়ে উন্নয়নমুখী করা যাবে। অনেকেই কোম্পানি গড়ে সরকারি চুক্তির জন্য দরপত্র দিচ্ছে। ইসরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক ১২ দিনের যুদ্ধে এসব গোষ্ঠী অংশ নেয়নি, যা সুদানির কৌশলের সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তবে সমালোচকদের মতে, এভাবে তারা আরও ধনী হচ্ছে এবং রাষ্ট্রের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ শক্ত হচ্ছে। গত জুলাইয়ে ইরান-ঘনিষ্ঠ কাতাইব হিজবুল্লাহ কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক দপ্তরে হানা দেয় দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এক কর্মকর্তাকে রক্ষা করতে। সুদানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিচার হবে, কিন্তু এখনো কোনো পদক্ষেপ নেননি।
সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা
কেউই বিশ্বাস করে না যে সুদানি সরাসরি মিলিশিয়াদের মোকাবিলা করতে পারবেন। ২০২৩ সালে রুশ-ইসরায়েলি গবেষক এলিজাবেথ সুরকোভকে বাগদাদে অপহরণের ঘটনায় সরকারের ব্যর্থতা তার ক্ষমতার সীমা প্রমাণ করেছে।
অন্যদিকে, তিনি এখনো বিশালাকার সরকারি আমলাতন্ত্র কমাতে পারেননি—প্রায় এক কোটি মানুষ সরকারি বেতন নিচ্ছে, যা বিশ্বের অন্যতম উচ্চ অনুপাত। জ্বালানি খাত সংস্কারে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, মিলিশিয়া-ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীর প্রতিরোধে। দুর্নীতিও রয়ে গেছে।

ইরাকের সম্ভাবনা ও রাজনীতি
তবুও ইরাকের সম্ভাবনা বিরাট। ২০২৪ সালের জনগণনায় জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৬০ লাখে, প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ করে বাড়ছে। আমেরিকার আগ্রাসনের আগে যা ছিল তার চেয়ে এখন ২ কোটি বেশি মানুষ এখানে বাস করছে।
আগামী নভেম্বরেই নির্বাচন। সুদানি দ্বিতীয় মেয়াদ চান, যাতে শুরু করা কাজ শেষ করতে পারেন। তবে সংস্কারগুলো জনপ্রিয় হলেও, তা জয় নিশ্চিত করবে এমন নয়। ইরান-সমর্থিত শিয়া কোঅর্ডিনেশন ফ্রেমওয়ার্কের অনেক গোষ্ঠী সুদানিকে নিজেদের স্বার্থের জন্য হুমকি মনে করে। তারা এক হলে, তার অগ্রগতি ক্ষণস্থায়ী হতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















