অরুন্ধতী রায়ের নতুন আত্মকথা
প্রায় তিন দশক আগে অরুন্ধতী রায় তাঁর প্রথম উপন্যাস দ্য গড অব স্মল থিংস দিয়ে বুকার পুরস্কার জিতে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৯৭ সালে শীতল যুদ্ধের অবসান এবং ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার আগে পশ্চিমা দুনিয়া আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ছিল, আর ভারতকে মূলত দেখা হতো এক্সোটিক এক দেশ হিসেবে। সেই সময়ে একটি সাহিত্যিক সাফল্য লেখককে সরাসরি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে দিতে পারত।
বিশ্ব এরপর অনেক বদলেছে, কিন্তু অরুন্ধতী রায়ের অবস্থান বদলায়নি। লাভজনক সাহিত্যজীবনকে প্রত্যাখ্যান করে তিনি পরিণত হয়েছেন একুশ শতকের অন্যতম রাজনৈতিক লেখক ও কর্মীতে। ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষা, কাশ্মীরের স্বাধীনতার প্রশ্ন, বড় বাঁধের বিরোধিতা, আমেরিকার আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের নিন্দা এবং হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে তিনি বরাবর সোচ্চার ছিলেন। বর্তমানে ৬৩ বছর বয়সেও তিনি নিজের স্বাধীন অবস্থান বজায় রেখেছেন।
মা মেরি রায়ের প্রভাব
অরুন্ধতী রায় তাঁর স্বাধীনচেতা মনোভাবের বড় কৃতিত্ব দেন তাঁর মা মেরি রায়কে। তাঁর প্রথম আত্মকথার নামও তাই— মাদার মেরি কামস টু মি। সমাধিফলকে লেখা আছে, মেরি রায় ছিলেন এক স্বপ্নদ্রষ্টা, যোদ্ধা ও শিক্ষক।
তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন নারীরা পুরুষের সমান অধিকার পাবে। নিজের সম্প্রদায়ের নারীদের সমান উত্তরাধিকার পাওয়ার অধিকার আদায়ে তিনি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত লড়েছিলেন এবং জয়লাভ করেছিলেন। কেরালায় তিনি একটি সফল স্কুল গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ন্যায়বোধ ও সমতার শিক্ষা দিয়েছেন।
আলো-অন্ধকারের দ্বৈত চরিত্র
তবে মেরি রায়ের আরেক দিকও ছিল—কঠোর ও নির্মম। তিনি কর্মচারী, আত্মীয়স্বজন এমনকি নিজের সন্তানদের প্রতিও অনেক সময় অমানবিক আচরণ করতেন। অরুন্ধতী রায় নিজেই স্বীকার করেছেন, সন্তানদের মায়ের অন্ধকার দিকটা বহন করতে হতো।
১৮ বছর বয়সে, দিল্লিতে আর্কিটেকচার পড়ার সময় তিনি বাড়ি ফেরা বন্ধ করেন। টানা সাত বছর মা-মেয়ের দেখা হয়নি। পরবর্তীতে সম্পর্ক পুনরায় শুরু হলেও তা কখনোই পুরোপুরি সহজ হয়নি।
তবে এই দূরত্বই হয়তো অরুন্ধতী রায়কে শক্তি জুগিয়েছিল নিজের স্বাধীন অবস্থান খুঁজে পেতে। তিনি লিখেছেন—“আমি সেই অন্ধকারের জন্য কৃতজ্ঞ। সেটাই আমাকে স্বাধীনতার পথ দেখিয়েছিল।”
দারিদ্র্য থেকে সাহিত্যজীবন
স্বাধীনতার জন্য তাঁকে দীর্ঘ সময় অস্থির জীবনযাপন করতে হয়েছে। পরে স্বামীকে পান, যাঁর সঙ্গে চলচ্চিত্র বানিয়েছেন এবং সংসার গড়েছেন। ব্রিটিশ প্রযোজকদের জন্য চিত্রনাট্য লিখে তিনি চার বছর কাটিয়েছেন, যার মধ্যে শেষ হয়েছে দ্য গড অব স্মল থিংস লেখার কাজ।
৩৬ বছর বয়সে উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পরই আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আসে। তবে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা তাঁকে মানসিক অস্বস্তিতে ফেলে—দারিদ্র্য ও অবিচারে ভরা দেশে তিনি ধনী ও বিশেষ সুবিধাভোগী হয়ে উঠছেন, যাদের নিয়ে তিনি আগে বিদ্রূপ করতেন।
রাজনৈতিক প্রতিরোধ ও সাহস
আর্থিক সাফল্যের পরও তিনি স্বাধীনচেতা থেকে গেছেন এবং মায়ের কাছ থেকে পাওয়া দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে নিজের বিশ্বাসের পক্ষে লড়াই চালিয়ে গেছেন। এ জন্য বহু প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে।
২০০২ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে। গত বছর মোদি সরকার কাশ্মীর প্রসঙ্গে ১৫ বছর আগের মন্তব্যের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করার অনুমোদন দেয় (যদিও তা এখনও কার্যকর হয়নি)।
স্মৃতিকথার শক্তি
অরুন্ধতী রায়ের ভাষার দক্ষতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। এই আত্মকথায় তিনি নিজের জীবন, মা এবং সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে পাশাপাশি তুলে ধরেছেন। শিশু নির্যাতন ও যৌন হয়রানির মতো গুরুতর বিষয়েও তিনি সূক্ষ্মতার সঙ্গে আলো ফেলেছেন।
বইয়ের অনেক জায়গায় স্মৃতিকথা যেন জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া পায়। তিনি লিখেছেন—“কিন্তু না, এটাই ছিল একমাত্র বাস্তবতা যা আমি চিনতাম।” পাঠকের জন্য মূল জাদু হলো দুই অসাধারণ নারীর জটিল সম্পর্ক আবিষ্কার করা—যা শেষ পর্যন্ত গড়ে তুলেছে আমাদের সময়ের সেরা লেখকদের একজনকে।