০৪:২১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ভারতে স্টিল পাইপ নির্মাতায় হানা—বিড রিগিং তদন্তে তল্লাশি” পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ নিষেধাজ্ঞার আদেশ স্থগিত করেননি চেম্বার আদালত জাতিসংঘের উদ্ভাবন সূচকে শীর্ষ-১০—জার্মানিকে সরিয়ে চীন ইইউর ১৯তম রাশিয়া নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ স্থগিত—পরিধি নিয়ে মতভেদ অ্যামাজনের হার্ডওয়্যার ইভেন্ট ৩০ সেপ্টেম্বর—ইকো, ফায়ার টিভি, কিন্ডলে চমক টিকটক সমাধানে ‘ফ্রেমওয়ার্ক’—যুক্তরাষ্ট্রে চালু রাখতে অরাকলসহ কনসোর্টিয়াম স্কারবরো শোলে ফিলিপাইনি জাহাজে চীনের ওয়াটার ক্যানন রুশ হামলায় জাপোরিঝিয়ায় একজন নিহত, বহু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত ফেড সুদ কমাতে পারে—এশিয়া শেয়ারে নতুন উত্থান চীনের বৈশ্বিক বন্দর প্রভাব কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের বড়সড় সামুদ্রিক উদ্যোগ

যে জেনারেশানের শৈশব নেই

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা দিন দিন তীব্র হচ্ছে। বাবা-মা চান তাঁদের সন্তান যেন পরীক্ষায় ভালো ফল করে, অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকে এবং ভবিষ্যতে একটি সুরক্ষিত জীবন গড়ে তোলে। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য তারা সন্তানকে অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপে ঠেলে দেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে চাপ সৃষ্টি করা শিশুর প্রাকৃতিক মস্তিষ্ক বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং তাদের শৈশবকে ধ্বংস করে দেয়।

শৈশবের স্বাধীনতা হরণ

শৈশব হলো খেলাধুলা, গল্পকথা, প্রকৃতির সঙ্গে মেলামেশা ও কৌতূহলী হয়ে শেখার সময়। কিন্তু অনেক বাবা-মা এই বয়সটিকে পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় হিসেবে ধরে নেন। পাঁচ-ছয় বছর বয়সেই শিশুদের হাতে বই তুলে দেওয়া হয়, কোচিং সেন্টারে পাঠানো হয় এবং সময়ের বড় অংশ বইয়ের পেছনে ব্যয় করতে হয়। ফলে শিশুরা খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজ থেকে বঞ্চিত হয়।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শৈশবের এই স্বাধীনতা হারানো মানে এক ধরনের মানসিক সহিংসতা। শিশুদের খেলার সুযোগ না দিলে তারা সহজে আনন্দ পায় না, মানসিকভাবে চাপে থাকে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বিষণ্নতার ঝুঁকি তৈরি হয়।

 ইউনিসেফের ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শহুরে শিশুদের ৬৮ শতাংশ দৈনিক এক ঘণ্টার কম খেলাধুলা করে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নির্দেশিকা অনুযায়ী, প্রতিটি শিশুর প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা সক্রিয় খেলাধুলা প্রয়োজন।

প্রাকৃতিক মস্তিষ্ক বিকাশে বাধা

শিশুর মস্তিষ্ক খুব দ্রুত বিকাশ লাভ করে। এই সময়ে খেলা, কল্পনা ও সৃজনশীল কার্যকলাপ মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশকে সক্রিয় রাখে। অথচ শুধু ক্লাসের বই মুখস্থ করার চাপ দিলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশু কেবল পরীক্ষার নম্বরকে লক্ষ্য করে শেখে, কিন্তু জীবন দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বা সৃজনশীলতা বিকশিত হয় না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব শিশু শুধু বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তারা পরে বাস্তব জীবনের সমস্যার মুখোমুখি হলে অস্বস্তি বোধ করে এবং সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কারণ, তাদের চিন্তাশক্তি চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে বিকাশের সুযোগ পায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় বলা হয়, শিশুদের অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ দিলে তাদের স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।

মানসিক ও আবেগগত ক্ষতি

অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ শিশুদের মধ্যে ভয়, উদ্বেগ এবং আত্মবিশ্বাসহীনতা সৃষ্টি করে। অনেক শিশু ক্লাসে ভালো না করলে বাবা-মায়ের রাগ ও শাস্তির শিকার হয়। এতে তাদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ কমে যায়। ধীরে ধীরে তারা মনে করে, বাবা-মায়ের ভালোবাসা কেবল ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল।

এভাবে বড় হওয়া শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে সম্পর্ক গড়তে সমস্যা অনুভব করে। তারা নিজের আবেগ প্রকাশ করতে পারে না, ছোটখাটো ব্যর্থতায় ভেঙে পড়ে এবং মানসিক সমস্যায় ভুগে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের এক জরিপে (২০২২) বলা হয়, রাজধানীর স্কুলপড়ুয়া শিশুদের প্রায় ৪৫ শতাংশ পরীক্ষার সময় চরম উদ্বেগ ও মানসিক চাপ অনুভব করে।

সৃজনশীলতার ক্ষয়

শিশুরা স্বভাবতই কৌতূহলী। তারা প্রশ্ন করে, নতুন কিছু জানতে চায়, গল্প বানায়, ছবি আঁকে। কিন্তু বাবা-মায়ের লক্ষ্য যদি হয় শুধু পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া, তবে এসব সৃজনশীল কাজকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়।

ফলাফল হলো শিশুরা ধীরে ধীরে সৃজনশীলতা হারায়। তারা নতুন কিছু উদ্ভাবন করার সাহস পায় না। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অথচ এই সৃজনশীলতাই ভবিষ্যতে তাদের চিন্তাশক্তি ও কর্মদক্ষতাকে সমৃদ্ধ করতে পারত।

গবেষণার তথ্য: ইউনেস্কোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে সৃজনশীল শিক্ষা পাওয়া শিশুরা ভবিষ্যতে পেশাগত জীবনে ৪০ শতাংশ বেশি উদ্ভাবনী হয়ে ওঠে।

শারীরিক সমস্যার আশঙ্কা

দিনভর বইয়ের সামনে বসে থাকতে বাধ্য হওয়া শিশুর শরীরের জন্যও ক্ষতিকর। চোখের সমস্যা, মাথাব্যথা, ঘাড় ও কোমরে ব্যথা, এমনকি স্থূলতার ঝুঁকিও তৈরি হয়। খেলার অভাবের কারণে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে।

চিকিৎসকদের মতে, প্রতিদিন শিশুদের কমপক্ষে এক ঘণ্টা খোলা জায়গায় দৌড়ঝাঁপ বা খেলাধুলা প্রয়োজন। কিন্তু পড়াশোনার চাপে সেই সুযোগ তারা পাচ্ছে না। এর ফল দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী শারীরিক জটিলতা।

সংখ্যাগত প্রমাণ: বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের এক জরিপে (২০২১) উল্লেখ করা হয়, অতিরিক্ত পড়াশোনায় ব্যস্ত শহরের ৩৫ শতাংশ শিশু স্থূলতা ও চোখের সমস্যায় ভুগছে।

পরিবারের ভূমিকা

পরিবারে বাবা-মা যদি সন্তানের ওপর সবসময় চাপ তৈরি করেন, তবে শিশুর মনে পরিবার হয়ে ওঠে ভয়ের জায়গা। অনেক শিশু বাবা-মায়ের সামনে খোলামেলা হতে চায় না, নিজের ইচ্ছা-অভিলাষ প্রকাশ করতে সাহস পায় না।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিবারের উচিত শিশুদের পড়াশোনায় উৎসাহ দেওয়া, তবে তা যেন বন্ধুত্বপূর্ণ হয়। জোর করে বই ধরিয়ে দেওয়ার বদলে তাদের শেখার আনন্দ তৈরি করতে হবে।

বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন

শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বাবা-মা যে চাপ সৃষ্টি করেন, তা আসলে উল্টো ফল বয়ে আনে। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া জীবনের সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি নয়। শিশুদের শেখাতে হবে কিভাবে আনন্দ নিয়ে পড়তে হয়, কিভাবে জ্ঞান ব্যবহার করতে হয় এবং কিভাবে সৃজনশীলভাবে সমস্যার সমাধান করতে হয়।

শিক্ষাবিদদের মতে, সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলা, শিল্প, সংগীত, বই পড়া, প্রকৃতির সঙ্গে মেলামেশা—এসবের মধ্য দিয়েই একটি শিশু পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারে।

তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কিডস-এর ২০২২ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়, যেসব শিশু প্রতিদিন নিয়মিত খেলাধুলা করে, তাদের পড়াশোনার ফল গড়ে ২০ শতাংশ ভালো হয় তাদের তুলনায় যারা শুধু বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

শিক্ষাব্যবস্থার দায়

শুধু বাবা-মা নয়, শিক্ষাব্যবস্থাও শিশুদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। অল্প বয়সেই পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো, টিউশন ও কোচিংয়ের প্রবণতা, এবং ভালো ফলাফলকে একমাত্র লক্ষ্য করে তোলা শিশুর শৈশব ধ্বংস করছে।

এ কারণে অনেক বিশেষজ্ঞ প্রাথমিক স্তরে পরীক্ষার চাপ কমানোর এবং পাঠ্যক্রমে খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (ADB)-এর একটি রিপোর্টে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার ৫২ শতাংশ শিশু প্রাথমিক পর্যায়ে অতিরিক্ত পড়াশোনার কারণে মানসিক চাপ অনুভব করে।

শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের ওপর অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ দিয়ে আমরা হয়তো সাময়িকভাবে ভালো নম্বর পেতে পারি, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি তাদের মানসিক, শারীরিক ও সৃজনশীল বিকাশ ধ্বংস করে দেয়। শৈশব একবারই আসে। তাই বাবা-মা ও সমাজের দায়িত্ব শিশুরা যেন আনন্দ, খেলা ও স্বাধীনতার সঙ্গে বড় হতে পারে—সেই পরিবেশ তৈরি করা।

ভারতে স্টিল পাইপ নির্মাতায় হানা—বিড রিগিং তদন্তে তল্লাশি”

যে জেনারেশানের শৈশব নেই

১০:০০:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা দিন দিন তীব্র হচ্ছে। বাবা-মা চান তাঁদের সন্তান যেন পরীক্ষায় ভালো ফল করে, অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকে এবং ভবিষ্যতে একটি সুরক্ষিত জীবন গড়ে তোলে। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য তারা সন্তানকে অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপে ঠেলে দেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে চাপ সৃষ্টি করা শিশুর প্রাকৃতিক মস্তিষ্ক বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং তাদের শৈশবকে ধ্বংস করে দেয়।

শৈশবের স্বাধীনতা হরণ

শৈশব হলো খেলাধুলা, গল্পকথা, প্রকৃতির সঙ্গে মেলামেশা ও কৌতূহলী হয়ে শেখার সময়। কিন্তু অনেক বাবা-মা এই বয়সটিকে পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় হিসেবে ধরে নেন। পাঁচ-ছয় বছর বয়সেই শিশুদের হাতে বই তুলে দেওয়া হয়, কোচিং সেন্টারে পাঠানো হয় এবং সময়ের বড় অংশ বইয়ের পেছনে ব্যয় করতে হয়। ফলে শিশুরা খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজ থেকে বঞ্চিত হয়।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শৈশবের এই স্বাধীনতা হারানো মানে এক ধরনের মানসিক সহিংসতা। শিশুদের খেলার সুযোগ না দিলে তারা সহজে আনন্দ পায় না, মানসিকভাবে চাপে থাকে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বিষণ্নতার ঝুঁকি তৈরি হয়।

 ইউনিসেফের ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শহুরে শিশুদের ৬৮ শতাংশ দৈনিক এক ঘণ্টার কম খেলাধুলা করে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নির্দেশিকা অনুযায়ী, প্রতিটি শিশুর প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা সক্রিয় খেলাধুলা প্রয়োজন।

প্রাকৃতিক মস্তিষ্ক বিকাশে বাধা

শিশুর মস্তিষ্ক খুব দ্রুত বিকাশ লাভ করে। এই সময়ে খেলা, কল্পনা ও সৃজনশীল কার্যকলাপ মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশকে সক্রিয় রাখে। অথচ শুধু ক্লাসের বই মুখস্থ করার চাপ দিলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশু কেবল পরীক্ষার নম্বরকে লক্ষ্য করে শেখে, কিন্তু জীবন দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বা সৃজনশীলতা বিকশিত হয় না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব শিশু শুধু বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তারা পরে বাস্তব জীবনের সমস্যার মুখোমুখি হলে অস্বস্তি বোধ করে এবং সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কারণ, তাদের চিন্তাশক্তি চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে বিকাশের সুযোগ পায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় বলা হয়, শিশুদের অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ দিলে তাদের স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।

মানসিক ও আবেগগত ক্ষতি

অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ শিশুদের মধ্যে ভয়, উদ্বেগ এবং আত্মবিশ্বাসহীনতা সৃষ্টি করে। অনেক শিশু ক্লাসে ভালো না করলে বাবা-মায়ের রাগ ও শাস্তির শিকার হয়। এতে তাদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ কমে যায়। ধীরে ধীরে তারা মনে করে, বাবা-মায়ের ভালোবাসা কেবল ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল।

এভাবে বড় হওয়া শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে সম্পর্ক গড়তে সমস্যা অনুভব করে। তারা নিজের আবেগ প্রকাশ করতে পারে না, ছোটখাটো ব্যর্থতায় ভেঙে পড়ে এবং মানসিক সমস্যায় ভুগে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের এক জরিপে (২০২২) বলা হয়, রাজধানীর স্কুলপড়ুয়া শিশুদের প্রায় ৪৫ শতাংশ পরীক্ষার সময় চরম উদ্বেগ ও মানসিক চাপ অনুভব করে।

সৃজনশীলতার ক্ষয়

শিশুরা স্বভাবতই কৌতূহলী। তারা প্রশ্ন করে, নতুন কিছু জানতে চায়, গল্প বানায়, ছবি আঁকে। কিন্তু বাবা-মায়ের লক্ষ্য যদি হয় শুধু পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া, তবে এসব সৃজনশীল কাজকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়।

ফলাফল হলো শিশুরা ধীরে ধীরে সৃজনশীলতা হারায়। তারা নতুন কিছু উদ্ভাবন করার সাহস পায় না। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অথচ এই সৃজনশীলতাই ভবিষ্যতে তাদের চিন্তাশক্তি ও কর্মদক্ষতাকে সমৃদ্ধ করতে পারত।

গবেষণার তথ্য: ইউনেস্কোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে সৃজনশীল শিক্ষা পাওয়া শিশুরা ভবিষ্যতে পেশাগত জীবনে ৪০ শতাংশ বেশি উদ্ভাবনী হয়ে ওঠে।

শারীরিক সমস্যার আশঙ্কা

দিনভর বইয়ের সামনে বসে থাকতে বাধ্য হওয়া শিশুর শরীরের জন্যও ক্ষতিকর। চোখের সমস্যা, মাথাব্যথা, ঘাড় ও কোমরে ব্যথা, এমনকি স্থূলতার ঝুঁকিও তৈরি হয়। খেলার অভাবের কারণে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে।

চিকিৎসকদের মতে, প্রতিদিন শিশুদের কমপক্ষে এক ঘণ্টা খোলা জায়গায় দৌড়ঝাঁপ বা খেলাধুলা প্রয়োজন। কিন্তু পড়াশোনার চাপে সেই সুযোগ তারা পাচ্ছে না। এর ফল দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী শারীরিক জটিলতা।

সংখ্যাগত প্রমাণ: বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের এক জরিপে (২০২১) উল্লেখ করা হয়, অতিরিক্ত পড়াশোনায় ব্যস্ত শহরের ৩৫ শতাংশ শিশু স্থূলতা ও চোখের সমস্যায় ভুগছে।

পরিবারের ভূমিকা

পরিবারে বাবা-মা যদি সন্তানের ওপর সবসময় চাপ তৈরি করেন, তবে শিশুর মনে পরিবার হয়ে ওঠে ভয়ের জায়গা। অনেক শিশু বাবা-মায়ের সামনে খোলামেলা হতে চায় না, নিজের ইচ্ছা-অভিলাষ প্রকাশ করতে সাহস পায় না।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিবারের উচিত শিশুদের পড়াশোনায় উৎসাহ দেওয়া, তবে তা যেন বন্ধুত্বপূর্ণ হয়। জোর করে বই ধরিয়ে দেওয়ার বদলে তাদের শেখার আনন্দ তৈরি করতে হবে।

বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন

শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বাবা-মা যে চাপ সৃষ্টি করেন, তা আসলে উল্টো ফল বয়ে আনে। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া জীবনের সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি নয়। শিশুদের শেখাতে হবে কিভাবে আনন্দ নিয়ে পড়তে হয়, কিভাবে জ্ঞান ব্যবহার করতে হয় এবং কিভাবে সৃজনশীলভাবে সমস্যার সমাধান করতে হয়।

শিক্ষাবিদদের মতে, সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলা, শিল্প, সংগীত, বই পড়া, প্রকৃতির সঙ্গে মেলামেশা—এসবের মধ্য দিয়েই একটি শিশু পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারে।

তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কিডস-এর ২০২২ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়, যেসব শিশু প্রতিদিন নিয়মিত খেলাধুলা করে, তাদের পড়াশোনার ফল গড়ে ২০ শতাংশ ভালো হয় তাদের তুলনায় যারা শুধু বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

শিক্ষাব্যবস্থার দায়

শুধু বাবা-মা নয়, শিক্ষাব্যবস্থাও শিশুদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। অল্প বয়সেই পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো, টিউশন ও কোচিংয়ের প্রবণতা, এবং ভালো ফলাফলকে একমাত্র লক্ষ্য করে তোলা শিশুর শৈশব ধ্বংস করছে।

এ কারণে অনেক বিশেষজ্ঞ প্রাথমিক স্তরে পরীক্ষার চাপ কমানোর এবং পাঠ্যক্রমে খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (ADB)-এর একটি রিপোর্টে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার ৫২ শতাংশ শিশু প্রাথমিক পর্যায়ে অতিরিক্ত পড়াশোনার কারণে মানসিক চাপ অনুভব করে।

শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের ওপর অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ দিয়ে আমরা হয়তো সাময়িকভাবে ভালো নম্বর পেতে পারি, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি তাদের মানসিক, শারীরিক ও সৃজনশীল বিকাশ ধ্বংস করে দেয়। শৈশব একবারই আসে। তাই বাবা-মা ও সমাজের দায়িত্ব শিশুরা যেন আনন্দ, খেলা ও স্বাধীনতার সঙ্গে বড় হতে পারে—সেই পরিবেশ তৈরি করা।