ব্রিটেন দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামুদ্রিক শক্তি ছিল। এ ইতিহাসকে মহাকাব্যের মতো করে তুলে ধরেছেন ইতিহাসবিদ এন.এ.এম. রডজার তাঁর তিন খণ্ডের গ্রন্থে। সর্বশেষ খণ্ডটির নাম “The Price of Victory”, যেখানে তিনি অ্যাংলো-স্যাক্সন যুগ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ব্রিটিশ নৌ-শক্তির উত্থান-পতনের কাহিনি বিশ্লেষণ করেছেন।
প্রথম খণ্ড “The Safeguard of the Sea” (১৯৯৭) সপ্তম শতাব্দী থেকে ১৬৪৯ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের সাগর-যাত্রা ও প্রথম অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধের আগ পর্যন্ত সময়কে ধারণ করে। দ্বিতীয় খণ্ড “The Command of the Ocean” (২০০৪) আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ও নেপোলিয়নের পরাজয়ের সময় পর্যন্ত নৌ-শক্তির উত্থানকে তুলে ধরে।
তৃতীয় খণ্ডের বৈশিষ্ট্য
তৃতীয় খণ্ড “The Price of Victory” বিশাল পরিসরের একটি কাজ। এতে রয়েছে ৬৪টি নির্বাচিত ছবি, মানচিত্র, ৩০০ পৃষ্ঠার সংযোজনী, গ্রন্থপঞ্জি, বিদেশি পরিভাষার শব্দকোষ এবং নিখুঁত সূচিপত্র। প্রকাশকও যেন সংকেত দিয়েছেন—একটি মহান কাজকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া প্রয়োজন।
গ্রন্থের মূল আলোচনার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ১৮১৫ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত ব্রিটিশ নৌ-ইতিহাস। এরপর মাত্র কয়েক অধ্যায়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং অন্তর্বর্তী সময় (১৯১৯-৩৯) তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আবার বইটি মহাকাব্যিক রূপ নেয়—১৩ অধ্যায়ে বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক সংগ্রাম বর্ণিত হয়েছে।
বিজয়ের মূল্য
“বিজয়ের মূল্য” শিরোনামে দ্বৈত অর্থ রয়েছে। ১৯৪৫ সালে ব্রিটেন সত্যিই বিজয়ী হয়েছিল—আটলান্টিক, ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরে নৌযুদ্ধের পর। কিন্তু সেই বিজয়ের মূল্য ছিল ভয়াবহ। সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ভেঙে পড়ে, এবং আমেরিকার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটেন তার বিশ্বনেতৃত্ব হারায়।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নৌবাহিনীর জাহাজ ও ঘাঁটি ভেঙে ফেলা হয়, ক্লান্ত নাবিকরা দেশে ফেরেন, অনেক বন্দর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। ব্রিটেন যুদ্ধ জিতে গেলেও সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। তাই রডজার তাঁর রচনার সমাপ্তি টেনেছেন এই পর্যায়েই।
সামাজিক ইতিহাসের দিক
রডজারের গবেষণার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ সাতটি অধ্যায়জুড়ে থাকা সামাজিক ইতিহাস। এখানে তিনি সাধারণ নাবিক থেকে শুরু করে নারী অংশগ্রহণ পর্যন্ত বিস্তৃত চিত্র তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় Women’s Royal Naval Service (WRNS) কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তা তিনি বিস্তারিত দেখিয়েছেন। ১৯৪২ সালে নারীরা বোমা-পরীক্ষা, আবহাওয়া পূর্বাভাস, অস্ত্র পরীক্ষক, টর্পেডো বিশ্লেষক, এমনকি ওয়েল্ডার ও ক্রেন চালক হিসেবেও কাজ করছিলেন—যা পুরুষদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাতে সাহায্য করে।
রডজারের কাজের বিশেষত্ব হলো তিনি শুধু যুদ্ধজয়ের বর্ণনা দেননি, বরং দেখিয়েছেন সমাজ, প্রশাসন, প্রযুক্তি ও মানুষের গল্প। এভাবেই গড়ে উঠেছে ২,৬০০ পৃষ্ঠার এক অনন্য ত্রয়ী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ব্রিটিশ নৌ-অবক্ষয়ের কাহিনি তিনি আর বলেননি—কারণ সেটি অন্য কারও কলমের বিষয়।
এই মহাগ্রন্থ শুধু নৌ-ইতিহাস নয়, বরং একটি জাতির গৌরব, সংগ্রাম এবং পতনের কাহিনি। একে আগামী প্রজন্মের জন্য তুলনাহীন অবদান বলা যায়।