দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঘন বনভূমি ঘুরে দেখলে মাঝে মাঝে এমন কিছু দৃশ্য চোখে পড়ে, যা কেবল প্রকৃতির শিল্পকর্ম বলেই মনে হয়। পাতার ফাঁক গলে হঠাৎ যদি আপনার দৃষ্টি পড়ে নীলাভ-সবুজ ঝলকানিতে, বুঝতে হবে সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক বিরল পাখি—জার্মেইন’স পিকক ফিজেন্ট। লাজুক হলেও সৌন্দর্যে অনন্য এই পাখি যেন নিঃশব্দে বনভূমির আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক রঙিন রহস্য।
নামের পেছনের ইতিহাস
জার্মেইন’স পিকক ফিজেন্টের বৈজ্ঞানিক নাম Polyplectron germaini। নামটি এসেছে ফরাসি প্রকৃতিবিদ লুই জার্মেইনের নামানুসারে, যিনি উনবিংশ শতকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করেছিলেন। তাঁর গবেষণার অবদানকে স্মরণ করেই এ পাখির নামকরণ করা হয়। সেই থেকে আজও এই পাখিটি শুধু প্রকৃতিবিদদের কাছে নয়, বরং পাখিপ্রেমীদের চোখে এক অমূল্য আবিষ্কার হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
শারীরিক সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য
জার্মেইন’স পিকক ফিজেন্ট মাঝারি আকারের হলেও তার পালকের জৌলুস অসাধারণ। সাধারণত ধূসর-বাদামী রঙের শরীর, কিন্তু ডানা ও লেজে অসংখ্য চোখের মতো নকশা—যেন রঙিন রত্নখচিত শিল্পকর্ম। পুরুষ পাখির লেজে নীলাভ-সবুজ গোলাকার নকশা থাকে, যা সূর্যের আলো পড়লে ঝলমল করে ওঠে। স্ত্রী পাখি তুলনায় কম রঙিন, তবে তার ধূসর-বাদামী পালক তাকে বনভূমির সঙ্গে এমনভাবে মিশিয়ে দেয় যে সহজে চোখে পড়ে না। এই বৈশিষ্ট্য তাকে শিকারির হাত থেকে রক্ষা করে।
আবাসস্থল ও বিস্তৃতি
এই বিরল পাখির প্রধান আবাসস্থল ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার ঘন চিরসবুজ বন। তারা সাধারণত নিচু ঝোপঝাড়ে, স্যাঁতসেঁতে মাটির কাছে এবং পুরু পাতার আস্তরণে চলাফেরা করে। অনেকেই ভাবে, ময়ূরের মতো এই পাখি নিশ্চয়ই উড়তে ভালোবাসে, কিন্তু আসলে জার্মেইন’স পিকক ফিজেন্ট খুব কমই উড়ে। প্রয়োজনে স্বল্প দূরত্বে ডানা ঝাপটে নিরাপদ স্থানে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। প্রকৃতির সঙ্গে এমন অভিযোজনই তাদের টিকে থাকার অন্যতম কৌশল।
খাদ্যাভ্যাস: মাটির নিচে লুকানো ভোজ
এরা মাটির খাদ্য সংগ্রহকারী পাখি। ছোট পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, শামুক, ফল, বীজ—সবকিছুই এদের খাদ্যতালিকায় থাকে। ঠোঁট দিয়ে খুঁটে খুঁটে মাটির নিচ থেকে খাবার বের করা তাদের দৈনন্দিন অভ্যাস। এক অর্থে এরা বনভূমির পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মতো কাজ করে, কারণ ছোট কীটপতঙ্গ খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
প্রজননের রহস্যময় নৃত্য
প্রজননকালে পুরুষ পাখির আচরণ সত্যিই বিস্ময়কর। স্ত্রীকে আকর্ষণ করার জন্য সে লেজ মেলে ধরে এক বিশেষ নৃত্য শুরু করে। সূর্যের আলোয় লেজের চোখের মতো নকশাগুলো ঝলমল করে ওঠে, যা যেন এক রঙিন আলোকশিল্পের প্রদর্শনী। স্ত্রী পাখি এই প্রদর্শনীতে মুগ্ধ হলে বাসা তৈরি শুরু হয়—সাধারণত ঝোপঝাড় বা পাতার আস্তরণে। একটি স্ত্রী বছরে ২ থেকে ৪টি ডিম পাড়ে, আর তা থেকেই জন্ম নেয় নতুন প্রজন্মের এই রঙিন বিস্ময়।
বিলুপ্তির হুমকি
তবে এই সৌন্দর্য আজ ঝুঁকির মুখে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা (IUCN) জার্মেইন’স পিকক ফিজেন্টকে ‘Near Threatened’ শ্রেণিতে রেখেছে। কারণ স্পষ্ট—বন উজাড় হচ্ছে দ্রুত, মানুষের বসতি বাড়ছে অব্যাহতভাবে, আর অবৈধ শিকার এখনো থামানো যায়নি। এসব কারণে এদের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। অনেক গবেষক আশঙ্কা করছেন, যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে কয়েক দশকের মধ্যে এই রঙিন পাখিটি শুধু বইয়ের পাতায় বা জাদুঘরের ছবি হিসেবেই দেখা যাবে।
সংরক্ষণের উদ্যোগ
প্রকৃতিবিদ ও পরিবেশকর্মীরা তাই এখনই এগিয়ে এসেছেন। ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় ইতিমধ্যেই কিছু প্রজনন কর্মসূচি শুরু হয়েছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংরক্ষণ, বনভূমি ধ্বংস বন্ধ এবং স্থানীয় জনগণকে সচেতন করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। কারণ কেবল আইন নয়, মানুষকেই বুঝতে হবে এই পাখি হারিয়ে গেলে কেবল এক প্রজাতি নয়, বরং পুরো পরিবেশ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভবিষ্যতের জন্য এক উত্তরাধিকার
জার্মেইন’স পিকক ফিজেন্ট কেবল একটি রঙিন পাখি নয়, বরং আমাদের পৃথিবীর প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। এর সৌন্দর্য, লাজুক স্বভাব আর সীমিত বিস্তৃতি একে বিশ্বজুড়ে অনন্য করেছে। তাই এই প্রজাতিকে রক্ষা করা শুধু জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কাজ নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এক মূল্যবান উপহার পৌঁছে দেওয়া। প্রকৃতিকে বাঁচাতে হলে আমাদের চোখ খুলে দেখতে হবে—বনভূমির ভেতরে লুকিয়ে থাকা এমন সৌন্দর্যও আমাদেরই অংশ, আমাদের পৃথিবীর গল্পের অংশ।