বৈশ্বিক সংঘাত ও অর্থনৈতিক প্রতিধ্বনি
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়া ও ন্যাটোর মুখোমুখি অবস্থান ক্রমশ তীব্র হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, অনেক বিশেষজ্ঞ একে ‘সরাসরি যুদ্ধ’ হিসেবেই আখ্যা দিচ্ছেন। এই ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত শুধু ইউরোপ বা উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলের জন্য নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্যও বিরাট ধাক্কা। জ্বালানি, খাদ্যশস্য, কাঁচামাল এবং আর্থিক বাজারে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতিতেও।

জ্বালানি খাতে ধাক্কা
রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল ও গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানি আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় বৈশ্বিক বাজারে তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। বাংলাদেশ, যেটি আমদানি-নির্ভর জ্বালানি অর্থনীতি, সেখানে এই মূল্যবৃদ্ধি বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কয়েকগুণ বাড়িয়েছে। ফলে সরকারকে ভর্তুকি বাড়াতে হয়েছে, আবার সাধারণ ভোক্তাদের জন্য বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যয় বেড়ে প্রতিযোগিতা কমেছে। এই ধারা আরো বাড়বে। যদি ন্যাটো ও রাশিয়া সরাসরি যুদ্ধ আরো প্রসারিত হয়।
খাদ্য আমদানির ঝুঁকি
রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বে গম, ভুট্টা ও সূর্যমুখী তেলের প্রধান রপ্তানিকারক। যুদ্ধের কারণে রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু গমের বড় অংশ আমদানি করে, তাই দেশে ময়দা ও রুটি ও খাবারের দামে স্থায়ী চাপ তৈরি হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা জনগোষ্ঠীর ওপর সবচেয়ে বেশি।

বৈদেশিক মুদ্রা ও রেমিট্যান্সে চাপ
যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য সংকুচিত হওয়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার মান দ্রুত কমতে শুরু করেছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে পড়েছে। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে অস্থিতিশীলতা এবং বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কায় রেমিট্যান্স প্রবাহে ওঠানামা হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের ডলার সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতি ও জনগণের জীবনযাত্রা
জ্বালানি ও খাদ্যের দাম একসাথে বেড়ে যাওয়ায় দেশে মুদ্রাস্ফীতি দীর্ঘমেয়াদে উচ্চমাত্রায় অবস্থান করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন চাল, ডাল, তেল ও শাকসবজির দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়ছে, কারণ কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়লেও কৃষকরা ন্যায্য-মূল্য পাচ্ছেন না।
রপ্তানি খাতের অনিশ্চয়তা
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক (RMG)। ইউরোপ ও আমেরিকা এই খাতের সবচেয়ে বড় বাজার। যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সেসব অঞ্চলে চাহিদা কমে যাচ্ছে। এর ফলে অর্ডার কমছে, নতুন বিনিয়োগ আসছে না, এবং শিল্পে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

সম্ভাব্য পথ খোঁজা
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশকে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।
- জ্বালানিতে বিকল্প উৎস খোঁজা:নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও আঞ্চলিক জ্বালানি সহযোগিতা জোরদার করা।
- খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা:গম, ভুট্টা ও তেলের বিকল্প হিসেবে স্থানীয় কৃষিকে প্রণোদনা দেওয়া।
- রপ্তানি বাজার বৈচিত্র্যকরণ:শুধু ইউরোপ-আমেরিকার ওপর নির্ভর না থেকে এশিয়া ও আফ্রিকার বাজার খুঁজে বের করা।
- রেমিট্যান্স প্রবাহ সুরক্ষা:অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন ও নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশ নিশ্চিত করা।

রাশিয়া-ন্যাটো সংঘাত শুধু ভূ-রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের খেলা নয়; এর প্রতিধ্বনি পৌঁছেছে বাংলাদেশ পর্যন্ত। জ্বালানি সংকট, খাদ্য মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা ঘাটতি এবং রপ্তানি খাতের অনিশ্চয়তা মিলিয়ে অর্থনীতির ওপর বহুমাত্রিক চাপ তৈরি হয়েছে। তবে যথাযথ কৌশল ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশ যদি বিকল্প পথ খুঁজে নিতে পারে, তাহলে এই বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও টিকে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















