গাজা সিটি থেকে পালানোর নির্দেশ
ইসরাইলি সেনাবাহিনী এই সপ্তাহে গাজা সিটির পুরো জনগণকে দক্ষিণে পালানোর নির্দেশ দিয়েছে। প্রায় এক মিলিয়ন মানুষের জন্য এটি এক অমানবিক সিদ্ধান্তের মতো। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, শহরের মানুষদের আগেই সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু ভারী গোলাবর্ষণ, বিমান হামলা ও ড্রোন আক্রমণের পর বাস্তবে সেখানে কারও থাকা সম্ভব হয়নি।
লিনা আল-মাধুন, গাজার বাসিন্দা, বললেন, প্রতিদিনের বোমাবর্ষণে তিনি কেবল একটাই আশা আঁকড়ে ধরেছিলেন: যদি মারা যান, অন্তত বোমার শব্দ শুনতে পাবেন না। তিনি বলেন, “যখন শব্দ শুনতে পাই, তখন বুঝি আমরা এখনো বেঁচে আছি।”
দোহায় হঠাৎ বিমান হামলা
মঙ্গলবার আরও স্পষ্ট হলো যে এ অভিযান কেবল হামাসকে আলোচনায় চাপ দেওয়ার জন্য নয়। ইসরাইল হঠাৎ করে কাতারের রাজধানী দোহায় বিমান হামলা চালায়, যেখানে হামাসের শীর্ষ নেতৃত্ব আলোচনার ভবিষ্যৎ নিয়ে বৈঠক করছিল।
লক্ষ্যবস্তু ছিলেন হামাসের অন্যতম নেতা খালিল আল-হাইয়া, যিনি ইসরাইলের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তিনি বেঁচে গেলেও তার ছেলে, অফিস প্রধান, তিনজন দেহরক্ষী ও কাতারের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হন।
এই হামলার ফলে আলোচনাগুলো ভেস্তে যায় এবং ইসরাইল গাজা সিটি পুনর্দখল অভিযানে পুরো মনোযোগ দেয়। এর মানে হলো শত সহস্র ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হবে।

নাগরিকদের অসম্ভব সিদ্ধান্ত
গাজাবাসীরা এখন এক ভয়ঙ্কর পছন্দের মুখে: দক্ষিণে গিয়ে দুর্ভিক্ষ ও অনাহারের ঝুঁকি নেওয়া, নাকি নিজ বাড়িতে থেকে মৃত্যুর সম্ভাবনা বরণ করা।
নেতানিয়াহু বলেছেন, গাজা সিটি দখল করাই হামাসকে পরাজিত করার ও জিম্মিদের মুক্ত করার একমাত্র পথ। তবে অধিকাংশ ইসরাইলি সাধারণ মানুষ এখনো শান্তিচুক্তি ও বন্দিমুক্তির জন্য আলোচনাকেই সমর্থন করছে।
২০ বছর বয়সী ওলা কাদাস বলেন, “কে নিহত হলো বা দোহায় কী ঘটল তা জানার সময় নেই। আমি শুধু ভাবছি কিভাবে আমার পরিবারকে বাঁচিয়ে দক্ষিণে পৌঁছাতে পারি।”
উত্তর-পশ্চিম গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরাইলি হামলা বিশেষ করে শেখ রাদওয়ান এলাকায় বেশি হয়েছে। এক বাজারে হামলায় ছয়জন নিহত হয়েছেন, ড্রোন আক্রমণে গাড়ি, তাঁবু ও এমনকি একটি অ্যাম্বুলেন্সও টার্গেট হয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিক মোহাম্মদ আহমেদ জানান, এই হামলাগুলো ছিল স্পষ্ট বার্তা, সবাইকে শহর ছাড়তে হবে। ইসরাইলি বিমান হামলায় একের পর এক বহুতল ভবন ধসে পড়েছে। গাজা সিভিল ডিফেন্স জানায়, শুধু মঙ্গলবারেই অন্তত ৪,১০০ মানুষ গৃহহীন হয়েছেন।

পালানো কঠিন, থাকারও উপায় নেই
জাতিসংঘ জানিয়েছে, ১৪ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৪১,০০০ মানুষ গাজা সিটি থেকে দক্ষিণে গেছেন। নেতানিয়াহুর দাবি, এ সংখ্যা এক লাখ। কিন্তু এখনো লাখ লাখ মানুষ সেখানে রয়ে গেছেন।
লিনা আল-মাধুন প্রথমে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তিনি বলেন, “প্রতিদিন মনে হচ্ছে এটাই জীবনের শেষ দিন। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। পুরো গাজা ধ্বংস হয়ে গেছে।”
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও নিন্দা
আগস্টের শুরুতে নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভা গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা অনুমোদন করে। এর পর থেকে ইসরাইলের ভেতরে প্রতিবাদ, ইউরোপের মিত্রদের সমালোচনা এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার আতঙ্ক বেড়েছে।
জাতিসংঘের ত্রাণ প্রধান টম ফ্লেচার বলেন, “মৃত্যু, ধ্বংস, দুর্ভিক্ষ ও বাস্তুচ্যুতি, এগুলো এমন সিদ্ধান্তের ফল যা আন্তর্জাতিক আইনকে অমান্য করছে। আমরা জোর দিয়ে বলছি, এই ভয়াবহতা থামানো সম্ভব।”
অক্সফাম জানিয়েছে, ইসরাইলের নির্দেশে প্রায় ১০ লাখ মানুষকে, যাদের অর্ধেক দুর্ভিক্ষে ভুগছে, গাজা সিটি ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, “এটি অসম্ভব এবং বেআইনি।”

ভয়াবহ মানবিক সংকট
শেখ রাদওয়ানের বাসিন্দা আহমেদ বললেন, তাদের ঘরবাড়ি জ্বলে গেছে, চারপাশের বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। খাবার জোগাড় করতে লোকজন দল বেঁধে বের হলেও এখন আর তেমন কাউকে দেখা যায় না।
মানবিক সহায়তা সংস্থায় কর্মরত বাসেল আবু রামাদান বলেন, “যে কোনো মুহূর্তে আমাদের ভবনও খালি করার নির্দেশ আসতে পারে। আমরা বিভ্রান্ত।” তার পরিবারকে দক্ষিণে নেওয়ার চিন্তা করলেও বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে যাত্রা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, “আমাদের সামনে কেবল খারাপ, আরও খারাপ আর ভয়ঙ্করতম অবস্থা। অনিশ্চয়তাই আমাদের ভেতর থেকে ছিঁড়ে ফেলছে।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















