বাংলার গ্রামীণ জীবনে ডাহুক (সাদা বক্ষের পানকৌড়ি) শুধু একটি পাখি নয়, বরং এক আবেগের নাম। ভোরের প্রথম আলো কিংবা সন্ধ্যার নিস্তব্ধ সময়ে এদের ডাক ভেসে আসে চারদিক থেকে। “ক্রা-ক্রা” ধ্বনির এই ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামীণ মানুষের মনে জেগে ওঠে প্রকৃতির প্রতি গভীর টান, কখনো-বা হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের স্মৃতি। তাই ডাহুককে আমরা কেবল জলচর পাখি হিসেবে দেখি না, বরং লোকজ সংস্কৃতির প্রতীক, গ্রামীণ জীবনের চিত্র এবং পরিবেশের অংশ হিসেবে বিবেচনা করি।
শারীরিক গঠন ও স্বভাব
ডাহুকের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ থেকে ৩৩ সেন্টিমিটার। মাথা, গলা ও বক্ষ সাদা, আর পিঠ ও ডানা ধূসর-কালো। এর ঠোঁট সবুজাভ হলুদ আর লম্বা পা হলুদাভ। হাঁটার সময় মাথা দোলানোর অভ্যাস এটিকে সহজেই চিনিয়ে দেয়।
এরা লাজুক হলেও চঞ্চল। বিপদের সময় মুহূর্তে ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। আবার ভোর ও গোধূলি বেলায় এদের ডাকাডাকি চারপাশকে মুখরিত করে তোলে।
আবাস ও বিস্তার
ডাহুক বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে দেখা যায়। ধানক্ষেত, বিল-ঝিল, খাল, পুকুরপাড়— যেখানেই জলাশয়ের পাশে ঝোপঝাড় আছে, সেখানেই এদের বসতি। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশে এদের বিস্তার রয়েছে।
তবে শহরের ভরাট হওয়া জলাশয়ে এদের দেখা এখন দুর্লভ। ঢাকার মতো বড় শহরে একসময় পুকুরঘাট বা ধানক্ষেতে ডাহুকের ডাক শোনা যেত, এখন তা কেবল স্মৃতির অংশ।

খাদ্যাভ্যাস
ডাহুক সর্বভুক। এরা পোকামাকড়, কেঁচো, শামুক, ছোট মাছ, ব্যাঙ খায়। পাশাপাশি ধান, ঘাসের বীজ, কোমল উদ্ভিদও খেয়ে নেয়। এভাবে কৃষককে সাহায্য করে ফসলের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে।
স্থানীয় কৃষক রফিকুল ইসলাম জানালেন,
“আমাদের ধানক্ষেতে ডাহুক সবসময় ঘোরাঘুরি করে। ওরা ক্ষেতে কীটপতঙ্গ খেয়ে ফেলে, এতে ধানের খুব উপকার হয়।”
প্রজনন ও বাসা বাঁধা
বর্ষাকাল ডাহুকের প্রজননের মৌসুম। এরা পানির ধারের ঘাসঝোপ বা ঝোপঝাড়ের আড়ালে বাসা বানায়। শুকনো ঘাস, ডালপালা দিয়ে গোলাকৃতি বাসা বানিয়ে স্ত্রী পাখি ৪-৭টি ডিম পাড়ে। ডিমে তা দেওয়া ও ছানাদের বড় করার কাজে পুরুষ ও স্ত্রী উভয় পাখি অংশ নেয়।
স্থানীয় স্কুলছাত্রী মারিয়া বলল,
“বর্ষায় আমরা পুকুরপাড়ে গিয়ে অনেকবার ডাহুকের বাসা দেখেছি। ছোট ছোট ছানাগুলো পানিতে সাঁতার কাটে—দেখতে খুব সুন্দর লাগে।”

লোকজ বিশ্বাস ও সাহিত্যিক তাৎপর্য
বাংলার লোকসংগীতে ডাহুকের ডাককে বিচ্ছেদ ও বিরহের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। গ্রামীণ সমাজে বিশ্বাস আছে—ডাহুকের ডাক শোনা মানেই দূরে থাকা প্রিয়জনকে স্মরণ করা।
প্রখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশও তার কবিতায় গ্রামীণ জলচর পাখিদের উল্লেখ করেছেন। যদিও সরাসরি ডাহুকের নাম উল্লেখ নেই, তবু এর প্রতীকী উপস্থিতি স্পষ্ট। আর বাউল গানে বহুবার ডাহুককে প্রেম ও প্রকৃতির প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রবীণ লোকগায়ক আব্দুল করিম জানালেন,
“আমাদের বাউলগান বা পালাগানে ডাহুকের ডাক প্রায়ই আসে। কারণ এই ডাক মানুষকে মনে করিয়ে দেয় জীবনের টানাপড়েন, প্রেম আর বিচ্ছেদ।”
পরিবেশগত সংকট
যদিও ডাহুক এখনো বিপন্ন প্রজাতি নয়, তবে এর আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে দ্রুত। গ্রামীণ খাল-বিল ভরাট, কৃষিজমিতে কীটনাশকের ব্যবহার, কৃত্রিম মাছ চাষে রাসায়নিকের প্রয়োগ এদের জীবনকে কঠিন করে তুলছে।
একটি গবেষণা (বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, ২০২২) দেখিয়েছে, গত দুই দশকে দেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক গ্রামে ডাহুকের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে শহরতলির জলাশয় হারিয়ে যাওয়ায় এদের দেখা পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় পরিবেশকর্মী নাসরিন আক্তার বললেন,
“ডাহুক শুধু পাখি নয়, বরং জলাশয়ের সুস্থতার প্রতীক। যখন ডাহুক কমে যায়, বুঝতে হবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।”

পরিবেশে ভূমিকা
ডাহুক ফসলের পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের উপকার করে, আবার জলাশয়ের খাদ্যশৃঙ্খল রক্ষা করে। এরা ছোট প্রাণী খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। কোনো গ্রামীণ জলাশয়ে ডাহুকের উপস্থিতি মানে সেটি জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ।
সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
ডাহুককে রক্ষা করতে হলে জলাশয় সংরক্ষণ সবচেয়ে জরুরি। গ্রামীণ খাল-বিল ভরাট বন্ধ করা, কীটনাশকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করা এবং জনগণকে সচেতন করা দরকার।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্কুলে পরিবেশ শিক্ষা বাড়ানো এবং স্থানীয় পর্যায়ে প্রচারণা চালানো জরুরি। যাতে মানুষ বুঝতে পারে ডাহুক আমাদের বন্ধু, শিকার করার মতো পাখি নয়।
ডাহুক পাখি বাংলার লোকজ সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের প্রতীক। এর ডাক আমাদের মনে করিয়ে দেয় গ্রামীণ জীবন, ভালোবাসা ও বিচ্ছেদের গল্প। কিন্তু দ্রুত পরিবেশ ধ্বংস ও জলাশয় ভরাটের কারণে এদের টিকে থাকা আজ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
ডাহুককে রক্ষা করা মানে শুধু একটি পাখিকে নয়, বরং বাংলার প্রকৃতি ও ঐতিহ্যকেও রক্ষা করা। তাই এখনই সময়—গ্রামীণ জলাশয় সংরক্ষণে এগিয়ে আসা, ডাহুকের জন্য নিরাপদ আবাস তৈরি করা এবং জীববৈচিত্র্যের এই অমূল্য সম্পদকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















