পৃথিবীর প্রাণিজগতের ভয়ঙ্কর অথচ বিস্ময়কর সদস্যদের মধ্যে অন্যতম হলো পিট ভাইপার। ইংরেজিতে যাদের বলা হয় Pit Viper, এই সাপের পরিবারে অন্তর্ভুক্ত বহু প্রজাতি এশিয়া, আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়। এদের পরিচয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো অনন্য এক অঙ্গ—”পিট অঙ্গ” (heat-sensing pit organ)। চোখ ও নাকের মাঝখানে অবস্থিত এই সংবেদনশীল অংশের মাধ্যমে তারা আশেপাশের উষ্ণ রক্তের প্রাণীর উপস্থিতি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। ফলে গভীর অন্ধকারেও শিকার ধরা তাদের জন্য সহজ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশে এই সাপের উপস্থিতি রয়েছে, বিশেষত পাহাড়ি ও বনাঞ্চলগুলোতে।
গঠন ও বৈশিষ্ট্য
পিট ভাইপারের শারীরিক গঠন অন্যান্য সাপের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। দেহ সাধারণত মাঝারি থেকে বড় আকৃতির হয়। মাথা ত্রিভুজাকৃতির এবং শরীর মোটা ও মাংসল। দাঁত লম্বা, ভাঁজ করা এবং বিষ প্রবেশ করানোর জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত। এই দাঁত দিয়ে তারা শিকারকে হঠাৎ আক্রমণ করে গভীরভাবে কামড়ায় এবং মুহূর্তের মধ্যে বিষ প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো “পিট অঙ্গ”। এটি কার্যত একটি তাপ-সংবেদনশীল ক্যামেরার মতো কাজ করে। আশেপাশে যে কোনো উষ্ণ দেহ—মানুষ, পাখি কিংবা স্তন্যপায়ী প্রাণী—এর উপস্থিতি তারা সহজেই টের পায়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এ ক্ষমতা বিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে, যাতে অন্ধকার রাতে শিকার ধরা সহজ হয়।
বাসস্থান ও বিস্তার
পিট ভাইপাররা সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র বনাঞ্চল পছন্দ করে। পাহাড়ি জঙ্গল, বাঁশঝাড়, ঝোপঝাড় কিংবা নদীসংলগ্ন এলাকায় তারা বাস করে। গাছে ওঠা ও ডালপালা পেঁচিয়ে থাকতে এরা খুব দক্ষ। একইসঙ্গে মাটিতেও চলাফেরা করে স্বাচ্ছন্দ্যে।
বাংলাদেশে বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেটের বনাঞ্চল এবং সীমান্তবর্তী কিছু পাহাড়ি এলাকায় এদের দেখা যায়। গবেষকদের মতে, বনভূমি ধ্বংসের কারণে তাদের আবাসস্থল ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। একসময় যেখানে সহজে দেখা যেত, এখন সেখানে এরা বিরল হয়ে উঠছে।
খাদ্যাভ্যাস
পিট ভাইপার নিশাচর স্বভাবের। দিনে তারা সাধারণত স্থির থাকে এবং পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে রাখে। রাতে সক্রিয় হয়ে ইঁদুর, ব্যাঙ, ছোট পাখি কিংবা অন্য সরীসৃপ শিকার করে। শিকারকে দাঁত দিয়ে কামড় দিয়ে বিষ ঢুকিয়ে অচল করে ফেলার পর সম্পূর্ণ গিলে ফেলে। কৃষিজমিতে ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এরা বিশেষ ভূমিকা রাখে, যদিও গ্রামীণ মানুষ প্রায়ই সাপটিকে বিপজ্জনক মনে করে হত্যা করে ফেলে।
বিষ ও এর প্রভাব
পিট ভাইপারের বিষ প্রধানত হেমোটক্সিক প্রকৃতির। অর্থাৎ এটি রক্তকোষ ভেঙে দেয় এবং টিস্যুতে ক্ষতি করে। মানুষের শরীরে এর কামড় হলে ফোলা, ব্যথা, রক্তক্ষরণ, শ্বাসকষ্ট এবং কখনও মৃত্যুও ঘটতে পারে। তবে সব প্রজাতি সমান প্রাণঘাতী নয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, সময়মতো চিকিৎসা পেলে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসে। অ্যান্টিভেনম থাকলেও বাংলাদেশে তা যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় না। ফলে পাহাড়ি ও প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ কামড় খেলে প্রায়ই জীবনহানির মুখে পড়ে।
প্রজনন প্রক্রিয়া
পিট ভাইপারের প্রজনন ব্যবস্থা বৈচিত্র্যময়। কিছু প্রজাতি ডিম পাড়ে, আবার কিছু প্রজাতি সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে। সাধারণত বর্ষাকালেই এদের প্রজনন ঋতু। স্ত্রী সাপ শত্রুর হাত থেকে বাচ্চাদের রক্ষা করতে ঘন জঙ্গল বা গাছের ফাঁপা অংশকে আশ্রয়স্থল বানায়। প্রকৃতির এই বুদ্ধিমত্তা প্রমাণ করে, সরীসৃপ হলেও এদের সামাজিক আচরণে কিছুটা সচেতনতা বিদ্যমান।
মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক
দক্ষিণ এশিয়ায় সাপের কামড়জনিত মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো পিট ভাইপার। কৃষিকাজ, বনজীবন বা পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারীরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। যদিও পিট ভাইপার স্বভাবত মানুষকে শিকার করে না, তবে হঠাৎ বিরক্ত করা হলে বা আত্মরক্ষার্থে আক্রমণ করে। বাংলাদেশে গ্রামীণ মানুষ এ সাপকে ভয় পায় এবং দেখলেই মেরে ফেলার চেষ্টা করে। এর ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশে পিট ভাইপারের প্রজাতি
বাংলাদেশের পাহাড়ি ও বনাঞ্চলে একাধিক প্রজাতির পিট ভাইপারের দেখা মেলে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
- ট্রিমেরেসরাস ট্রিগোনোসেফালুস (Trimeresurus trigonocephalus) – সবুজ রঙের এই প্রজাতি পাহাড়ি এলাকায় বেশি দেখা যায়। দেহে হালকা দাগ থাকে এবং গাছে বসবাসে দক্ষ।
- ট্রিমেরেসরাস লেবেটিনুস (Trimeresurus labetinus) – বিরল প্রজাতি, সাধারণত ঘন জঙ্গলের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকে।
- হিমালয়ান পিট ভাইপার (Himalayan Pit Viper, Gloydius himalayanus) – বাংলাদেশে বিরল হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় এর দেখা মেলে।
- হোয়াইট-লিপড পিট ভাইপার (White-lipped Pit Viper, Trimeresurus albolabris) – সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাওয়া যায়। ঠোঁট সাদা হওয়ায় সহজেই শনাক্ত করা যায়।
ইতিহাস ও লোককথা
বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল ও গ্রামীণ সমাজে পিট ভাইপার নিয়ে নানা লোককথা প্রচলিত আছে। অনেকে বিশ্বাস করে, এই সাপ হত্যা করলে বনদেবতা রুষ্ট হন। আবার কোথাও বলা হয়, পিট ভাইপারের চোখে নাকি রহস্যময় আলো থাকে, যা অন্ধকারে পথহারা মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়।
আদিবাসী চিকিৎসা প্রথায় একসময় পিট ভাইপারের বিষ ব্যবহার করা হতো নানা রোগ নিরাময়ে। যদিও আধুনিক বিজ্ঞানে এর প্রমাণ নেই, তবুও লোকবিশ্বাসে এই সাপের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা
পিট ভাইপার নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু গবেষণা হয়েছে। এর বিষ থেকে ওষুধ তৈরি করার চেষ্টা চলছে। রক্ত জমাট বাঁধা নিয়ন্ত্রণ, ব্যথানাশক বা হৃদরোগের ওষুধ তৈরিতে এই বিষের উপাদান কাজে লাগতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এর ওপর গবেষণা ইতোমধ্যেই চলছে।
বাংলাদেশে গবেষণা তুলনামূলক সীমিত। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কয়েকটি প্রকল্পে এই সাপের আচরণ, প্রজনন ও আবাসস্থল নিয়ে কাজ হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে পিট ভাইপার পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
সংরক্ষণ ও গুরুত্ব
পিট ভাইপার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কৃষিজমিতে ইঁদুর ও ক্ষতিকর প্রাণীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এরা অগ্রণী। কিন্তু বনভূমি ধ্বংস, নির্বিচারে হত্যা এবং আবাসস্থল সংকটের কারণে কিছু প্রজাতি হুমকির মুখে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদরা মনে করেন, পিট ভাইপারকে ঘিরে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। গ্রামীণ ও পাহাড়ি এলাকায় মানুষকে বোঝাতে হবে যে, এ সাপ প্রকৃতির জন্য উপকারী। অকারণে এদের হত্যা বন্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে সাপের কামড় প্রতিরোধ ও দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে।
পিট ভাইপার একদিকে ভয়ঙ্কর সরীসৃপ, অন্যদিকে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় অপরিহার্য সহযোগী। মানুষের সঙ্গে এদের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের হলেও বাস্তবে তারা শত্রু নয়। বরং কৃষিজমি রক্ষা থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সম্ভাবনা—সব ক্ষেত্রেই এই সাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, লোককথা ও জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে জড়িত এই রহস্যময় প্রাণী প্রকৃতির এক অমূল্য অংশ। তাই এখনই সময় পিট ভাইপারের সঠিক মূল্যায়ন, সংরক্ষণ ও গবেষণা বাড়ানোর।