এক কথায় সমস্ত উত্তরবঙ্গ জনমানবহীন হইয়া শ্মশান অপেক্ষাও ভয়াবহ হইয়া উঠিল। দেবীসিংহ এক কপর্দকও কর না পাওয়ায় কোম্পানীর রাজস্ব প্রদান করিতে পারিলেন না। যখন কর্তৃপক্ষগণ দেখিলেন যে, দেবীসিংহের রাজস্ব অনেকদিন হইতে পাওয়া যাইতেছে না এবং সেই সকল অত্যাচারের কথা অবিরত শ্রবণ করিয়া যখন তাঁহাদের কর্ণ বধির হইবার উপক্রম হইল, তখন তাঁহারা লজ্জার ভয়ে সেই ভীষণ অত্যাচারের অনুসন্ধান করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। তাঁহারা প্যাটারসন নামক একজন ন্যায়পর ইংরেজকে কমিশনার নিযুক্ত করিয়া রঙ্গপুরে পাঠাইলেন।
প্যাটারশন্ অত্যন্ত নির্ভীক ও সাধুপ্রকৃতির লোক ছিলেন; তিনি কদাচ আপনাকে ন্যায়পথ হইতে বিচলিত করিতে ইচ্ছা করিতেন না। রঙ্গপুর প্রদেশে উপস্থিত হইয়া, প্যাটারসন প্রজাদিগের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখিয়া এইরূপ লিখিয়া পাঠাইলেন,-“রঙ্গপুর ও দিনাজপুর প্রদেশের প্রজাগণের উপর রাজস্ব অনাদায়ের জন্য যেরূপ কঠোর শাস্তি প্রদান করা হইয়াছে, সেই সকল দৃষ্টান্ত দ্বারা আপনাদিগের মনশ্চাঞ্চল্য উপস্থিত না করিয়া, তাহাদিগকে চিরযবনিকাবৃত করিয়া রাখিবার ইচ্ছা করি।
কিন্তু আমার নিকট যতই অপ্রীতিকর হউক না কেন, ন্যায়, মনুষ্যত্ব এবং গবর্ণমেন্টের সম্মানের জন্য যাহাতে ভবিষ্যতে এরূপ অত্যাচার স্রোতঃ পুনঃ প্রবাহিত না হয়, তজ্জন্য আমাকে সমস্তই অবগত করাইতে হইবে।” তাহার পর প্যাটারসন সাহেব ক্রমাগত দেশের চতুদ্দিকের অবস্থা দেখিতে লাগিলেন; প্রতিদিন শত শত ভগ্নাবশেষ কুটীর তাঁহার চক্ষের সম্মুখে পড়িতে লাগিল, শত শত আহত ব্যক্তি আপনাদিগের দুঃখকাহিনী বিবৃত করিতে প্রবৃত্ত হইল।
কাহারও পুত্র যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া প্রাণ-ত্যাগ করিয়াছে, কাহারও ভ্রাতা কারাগারে অনাহারে দিন যাপন করিয়াছে, কাহারও কন্যার পবিত্রতা অপহৃত হইয়াছে, কাহারও ভগিনী পিশাচদিগের বেত্রদ্বারা ক্ষত বিক্ষত হইয়াছে, এই সমস্ত শুনিয়া এবং নিজে প্রত্যক্ষগোচর করিয়া, সেই ন্যায়বান ব্রিটনসন্তানের হৃদয় বিচলিত হইল। তিনি বিলক্ষণরূপে বুঝিতে পারিলেন যে, পৃথিবীর কোন স্থানে কোন যুগে এইরূপ পাশবিক অত্যাচার হয় নাই। ক্রমশঃ। তাঁহার অনুসন্ধানের ফলে অনেক নূতন নূতন ব্যাপার জনসাধারণের গোচরীভূত হইতে লাগিল।