০২:৫৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মঙ্গলে জীবনের ইঙ্গিত: ‘স্যাফায়ার ক্যানিয়ন’ শিলায় রহস্যময় জৈব অণু

সিনেমা থেকে বাস্তবতায়

রিডলি স্কটের চলচ্চিত্র দ্য মার্শিয়ান-এ নাসার মহাকাশচারী মার্ক ওয়াটনিকে বাঁচানোর চেষ্টা পুরো পৃথিবীর মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছিল। বাস্তবে নাসার সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনও কিছুটা সেই আবহই তৈরি করেছে। ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মঙ্গলের একটি শিলা নমুনায় পাওয়া গেছে সম্ভাব্য জীবনের চিহ্ন। নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক শন ডাফি বলেছেন, এটি হয়তো এখন পর্যন্ত মঙ্গলে পাওয়া জীবনের সবচেয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত।

সমস্যার জায়গা: শিলা মঙ্গলে রয়ে গেছে

নমুনাটি বিশ্লেষণের পর টাইটানিয়ামের ক্যানিস্টারে সিল করে রাখা হয়েছে ভবিষ্যৎ পরীক্ষার জন্য। কিন্তু উন্নত যন্ত্রপাতি রয়েছে পৃথিবীতে, আর নমুনাটি রয়ে গেছে মঙ্গলে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের এখন কোনো ব্যবস্থা নেই সেটি পৃথিবীতে আনার।
‘পারসিভারেন্স’ নামের রোভার মঙ্গলে পাঠানো হয়েছিল ঠিক এ ধরনের নমুনা সংগ্রহের জন্য। কিন্তু ১১ বিলিয়ন ডলারের ব্যয়সঙ্কটের কারণে সেই নমুনা পৃথিবীতে ফেরানোর মিশন বাতিল করা হয়েছে।

কোথা থেকে সংগৃহীত

পারসিভারেন্স অবতরণের প্রায় চার বছর পর এই নমুনা সংগ্রহ করে। জেজেরো ক্রেটার থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের এক উপত্যকা থেকে আনা হয়েছে শিলাটি। জায়গাটিকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘ব্রাইট ট্রেইল ফরমেশন’। নির্দিষ্ট যে শিলাটি সংগ্রহ করা হয়েছে, সেটির নাম রাখা হয়েছে ‘চিয়াভা ফলস’। এর থেকে সংগৃহীত নমুনার নাম ‘স্যাফায়ার ক্যানিয়ন’। এটি ৩০টি নমুনার মধ্যে ২৫তম।

কী আছে এই শিলায়

শিলাটি মূলত কাদাপাথর। পারসিভারেন্সের যন্ত্রপাতি আলাদা কণাগুলো বোঝার মতো সূক্ষ্ম নয়, তবে রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে এতে রয়েছে জৈব অণু।
জৈব অণু মানেই জীবনের উপস্থিতি নয়। এগুলো শুধু কার্বন ও হাইড্রোজেন বা নাইট্রোজেনযুক্ত অণু। এগুলো ধূমকেতুর ধূলিকণাতেও থাকে এবং মঙ্গলে পড়তে পারে। তবুও মঙ্গলে জৈব অণু বিরল হওয়ায় বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে।

রহস্যময় দাগ

শিলার গায়ে ছোট কালো বিন্দু এবং বড় দাগ পাওয়া গেছে, যেগুলোকে বিজ্ঞানীরা ডাকছেন ‘চিতাবাঘের দাগ’। এগুলো শিলার ভেতরেই গড়ে উঠেছে। এসব দাগে পাওয়া গেছে এমন খনিজ যা ‘রিডাকশন’ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে, অর্থাৎ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ইলেকট্রন যুক্ত হয়েছে। পৃথিবীতে অনেক ব্যাকটেরিয়া এভাবেই বেঁচে থাকে। জৈব অণু থেকে ইলেকট্রন টেনে এনে অজৈব পদার্থে প্রয়োগ করে। পৃথিবীতে এ ধরনের দাগ পেলে বিজ্ঞানীরা সাধারণত জীববৈজ্ঞানিক উৎসের কথাই ভাবেন। তাই মঙ্গলে এ আবিষ্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিকল্প ব্যাখ্যা সম্ভব?

অজৈব প্রক্রিয়াতেও এ ধরনের প্রভাব তৈরি হতে পারে, তবে সাধারণত সেক্ষেত্রে উচ্চ তাপমাত্রা লাগে। এই শিলা কখনো এমন উত্তাপে পোড়েনি বলে ধারণা পাওয়া গেছে। নিউইয়র্ক স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের জোয়েল হুরোভিট্জ বলেছেন, পৃথিবীর পরীক্ষাগারে বিকল্প কোনো প্রক্রিয়া পাওয়া গেলে হয়তো জীবনের প্রমাণ হিসেবে ধরা যাবে না। এ নিয়মকে বলা হয় ‘নাল ক্রাইটেরিয়ন’। তবে বিকল্প ব্যাখ্যা না পাওয়া গেলে চাপ বাড়বে, শিলাটি পৃথিবীতে আনার জন্য।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

রকেট ল্যাব দাবি করছে, তারা চাইলে নাসার তুলনায় অনেক কম খরচে এ ধরনের মিশন সম্পন্ন করতে পারবে, যদি অর্থায়ন মেলে। অন্যদিকে চীনের মহাকাশ সংস্থা নিজস্ব মঙ্গল নমুনা সংগ্রহের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সিনেমায় যেমন চীনা সংস্থা মার্ক ওয়াটনিকে বাঁচাতে সাহায্য করেছিল, বাস্তবে বিজ্ঞানের খাতিরে সহযোগিতা হলে শিলা ফেরানো সম্ভব হতে পারে। তবে বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মহাকাশ দৌড়ে এটি অনেকটাই অবাস্তব কল্পনা বলে মনে করছেন অনেকে।

যদি সত্যিই বিকল্প ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া না যায়, তবে ‘স্যাফায়ার ক্যানিয়ন’ শিলা মানব ইতিহাসের অন্যতম বড় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে পরিণত হতে পারে। কিন্তু আপাতত এটি মঙ্গলের মাটিতেই বন্দি হয়ে রয়েছে, আর পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা অপেক্ষা করছেন একদিন হয়তো সেটি হাতে পাওয়ার জন্য।

মঙ্গলে জীবনের ইঙ্গিত: ‘স্যাফায়ার ক্যানিয়ন’ শিলায় রহস্যময় জৈব অণু

০৬:০০:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সিনেমা থেকে বাস্তবতায়

রিডলি স্কটের চলচ্চিত্র দ্য মার্শিয়ান-এ নাসার মহাকাশচারী মার্ক ওয়াটনিকে বাঁচানোর চেষ্টা পুরো পৃথিবীর মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছিল। বাস্তবে নাসার সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনও কিছুটা সেই আবহই তৈরি করেছে। ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মঙ্গলের একটি শিলা নমুনায় পাওয়া গেছে সম্ভাব্য জীবনের চিহ্ন। নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক শন ডাফি বলেছেন, এটি হয়তো এখন পর্যন্ত মঙ্গলে পাওয়া জীবনের সবচেয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত।

সমস্যার জায়গা: শিলা মঙ্গলে রয়ে গেছে

নমুনাটি বিশ্লেষণের পর টাইটানিয়ামের ক্যানিস্টারে সিল করে রাখা হয়েছে ভবিষ্যৎ পরীক্ষার জন্য। কিন্তু উন্নত যন্ত্রপাতি রয়েছে পৃথিবীতে, আর নমুনাটি রয়ে গেছে মঙ্গলে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের এখন কোনো ব্যবস্থা নেই সেটি পৃথিবীতে আনার।
‘পারসিভারেন্স’ নামের রোভার মঙ্গলে পাঠানো হয়েছিল ঠিক এ ধরনের নমুনা সংগ্রহের জন্য। কিন্তু ১১ বিলিয়ন ডলারের ব্যয়সঙ্কটের কারণে সেই নমুনা পৃথিবীতে ফেরানোর মিশন বাতিল করা হয়েছে।

কোথা থেকে সংগৃহীত

পারসিভারেন্স অবতরণের প্রায় চার বছর পর এই নমুনা সংগ্রহ করে। জেজেরো ক্রেটার থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের এক উপত্যকা থেকে আনা হয়েছে শিলাটি। জায়গাটিকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘ব্রাইট ট্রেইল ফরমেশন’। নির্দিষ্ট যে শিলাটি সংগ্রহ করা হয়েছে, সেটির নাম রাখা হয়েছে ‘চিয়াভা ফলস’। এর থেকে সংগৃহীত নমুনার নাম ‘স্যাফায়ার ক্যানিয়ন’। এটি ৩০টি নমুনার মধ্যে ২৫তম।

কী আছে এই শিলায়

শিলাটি মূলত কাদাপাথর। পারসিভারেন্সের যন্ত্রপাতি আলাদা কণাগুলো বোঝার মতো সূক্ষ্ম নয়, তবে রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে এতে রয়েছে জৈব অণু।
জৈব অণু মানেই জীবনের উপস্থিতি নয়। এগুলো শুধু কার্বন ও হাইড্রোজেন বা নাইট্রোজেনযুক্ত অণু। এগুলো ধূমকেতুর ধূলিকণাতেও থাকে এবং মঙ্গলে পড়তে পারে। তবুও মঙ্গলে জৈব অণু বিরল হওয়ায় বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে।

রহস্যময় দাগ

শিলার গায়ে ছোট কালো বিন্দু এবং বড় দাগ পাওয়া গেছে, যেগুলোকে বিজ্ঞানীরা ডাকছেন ‘চিতাবাঘের দাগ’। এগুলো শিলার ভেতরেই গড়ে উঠেছে। এসব দাগে পাওয়া গেছে এমন খনিজ যা ‘রিডাকশন’ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে, অর্থাৎ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ইলেকট্রন যুক্ত হয়েছে। পৃথিবীতে অনেক ব্যাকটেরিয়া এভাবেই বেঁচে থাকে। জৈব অণু থেকে ইলেকট্রন টেনে এনে অজৈব পদার্থে প্রয়োগ করে। পৃথিবীতে এ ধরনের দাগ পেলে বিজ্ঞানীরা সাধারণত জীববৈজ্ঞানিক উৎসের কথাই ভাবেন। তাই মঙ্গলে এ আবিষ্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিকল্প ব্যাখ্যা সম্ভব?

অজৈব প্রক্রিয়াতেও এ ধরনের প্রভাব তৈরি হতে পারে, তবে সাধারণত সেক্ষেত্রে উচ্চ তাপমাত্রা লাগে। এই শিলা কখনো এমন উত্তাপে পোড়েনি বলে ধারণা পাওয়া গেছে। নিউইয়র্ক স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের জোয়েল হুরোভিট্জ বলেছেন, পৃথিবীর পরীক্ষাগারে বিকল্প কোনো প্রক্রিয়া পাওয়া গেলে হয়তো জীবনের প্রমাণ হিসেবে ধরা যাবে না। এ নিয়মকে বলা হয় ‘নাল ক্রাইটেরিয়ন’। তবে বিকল্প ব্যাখ্যা না পাওয়া গেলে চাপ বাড়বে, শিলাটি পৃথিবীতে আনার জন্য।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

রকেট ল্যাব দাবি করছে, তারা চাইলে নাসার তুলনায় অনেক কম খরচে এ ধরনের মিশন সম্পন্ন করতে পারবে, যদি অর্থায়ন মেলে। অন্যদিকে চীনের মহাকাশ সংস্থা নিজস্ব মঙ্গল নমুনা সংগ্রহের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সিনেমায় যেমন চীনা সংস্থা মার্ক ওয়াটনিকে বাঁচাতে সাহায্য করেছিল, বাস্তবে বিজ্ঞানের খাতিরে সহযোগিতা হলে শিলা ফেরানো সম্ভব হতে পারে। তবে বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মহাকাশ দৌড়ে এটি অনেকটাই অবাস্তব কল্পনা বলে মনে করছেন অনেকে।

যদি সত্যিই বিকল্প ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া না যায়, তবে ‘স্যাফায়ার ক্যানিয়ন’ শিলা মানব ইতিহাসের অন্যতম বড় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে পরিণত হতে পারে। কিন্তু আপাতত এটি মঙ্গলের মাটিতেই বন্দি হয়ে রয়েছে, আর পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা অপেক্ষা করছেন একদিন হয়তো সেটি হাতে পাওয়ার জন্য।