জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি ‘ইসলামী’ রাজনৈতিক দল বৃহস্পতিবার থেকে পাঁচ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে নামছে। নির্বাচনের সম্ভাব্য দিন যখন এগিয়ে আসছে, তখনই কেন দাবিদাওয়া, আন্দোলন?
জামায়তে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও খেলাফত মজলিস গত সোমবার আলাদাভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করলেও তাদের দাবিগুলো একই। সবার পাঁচ দফা দাবিতে রয়েছে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি চালু, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, ফ্যাসিস্ট সরকারের জুলুম-নির্যাতন ও দুর্নীতির বিচার এবং জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা।
এই তিনটি দলের বাইরেও যারা যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে তারা হলো: নেজামে ইসলাভেমী পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পাটি(জাগপা)। এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা এই যুগপৎ আন্দোলনের সাথে নেই। তবে অধিকাংশ দাবির সাথে তারা একমত। এবি পার্টি এবং গণঅধিকার পরিষদও সেই পাঁচ দফা দাবির সাথে মোটামুটি একমত এবং এনসিপির মতো তারাও যুগপৎ কর্মসূচিতে থাকছে না।
বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনেপিআর পদ্ধতি চালুর বিপক্ষে । জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দল নিষিদ্ধের বিষয়টি আদালতের বিচারের ওপর ছেড়ে দেয়ার কথা বলেছে তারা।
বিএনপি মনে করে, জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল যেভাবে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার মতো জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ চাইছে তা ঠিক নয়।
হঠাৎ আন্দোলন
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।এদিকে জাতীয় সংস্কার কমিশনের মেয়াদ আরো একমাস বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যুগপৎ আন্দোলনে যারা নামছেন, তারা মনে করে, সরকার ইচ্ছা করলে এই দাবি পুরণ করে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন করতে পারবে। তবে বিএনপি পুরো বিষয়টিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে৷ তারা মনে করে, এই দাবির নেপথ্যে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন পেছানোর উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এসব আন্দোলনকে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ভণ্ডুল করার পাঁয়তারা হিসেবে দেখার যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করে দলটি।
যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা আসার আগের দিনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন-শৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে, “জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে। রাজধানীর সড়কে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে।”
উচ্চ কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের প্রস্তাবে সব দলই মোটামুটি একমত। তবে দুই কক্ষেই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্য নেই। যারা আন্দোলনে যাচ্ছেন, তারা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন করে তার ভিত্তিতে নির্বাচন ও জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে চাচ্ছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ এরই মধ্যে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “পাঁচ দফা দাবিতে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচির জবাব বিএনপি রাজপথেই দেবে।”
তার কথা, “যে-কোনো রাজনৈতিক দল তার গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে মাঠে যেতে পারে, রাজপথে যেতে পারে, জনগণের সামনে যেতে পারে। আমাদের যে বক্তব্য আমরাও সেটা মাঠে দেবো, জনগণের সামনে দেবো৷ মাঠের জবাব আমরা মাঠেই দেবো-জনগণ যেটা গ্রহণ করবে সেটা দেখা যাবে।”
আর বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়স সহ-সম্পাদক এবং সাবেক এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, “তিনটি কারণে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল যুগপৎ আন্দোলন শুরু করছে। প্রথমত, তারা ফেব্রুয়ারির নির্বাচন পেছাতে চায়৷ দ্বিতীয়ত, বিএনপি যাতে ক্ষমতায় না যেতে পারে তা ঠেকানো এবং তৃতীয়ত, মানুষের কাছে প্রমাণের চেষ্টা যে বিএনপি একঘরে।”
তার কথা, ” তারা মনে করে, এখন নির্বাচন হলে তারা যদি ২০টি সিট পায়, নির্বাচন পিছিয়ে গেলে তাদের আরো কিছু সিট বাড়বে।”
“আসলে এখনো তো ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা চলছে। আরো একমাস চলবে। তার আগেই এই ধরনের মাঠের কর্মসূচি তারা কার বিরুদ্ধে দিয়েছে, সেটাই তো আমরা বুঝতে পারছি না। তারা নিজেরাই তো স্ববিরোধিতার মধ্যে আছে। তারা তাদের কথা বলতেই পারে। তবে এটা নিয়ে যদি দেশে কোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার দায় জামায়াতে ইসলামী এবং তার সহযোগীদেরই নিতে হবে,” বলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। তার কথা, “অন্তর্বর্তী সরকারকেই বিষয়গুলো দেখতে হবে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে কেউ যদি বাধার সৃষ্টি করে, তাহলে আমরা জনগণের কাছে যাবো। জনগণই জবাব দেবে।”
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ” কোনো দলের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান নয়। আমরা সরকারের কাছে আমাদের দাবি দিয়েছি। ফেব্রুয়ারিতে যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেটা সুন্দর এবং শান্তিপূর্ণ করার জন্যই আমাদের পাঁচ দফা দাবি। আরো অনেক রাজনৈতিক দল আমাদের সাথে একমত। সামনে যেন ফ্যাসিবাদমুক্ত সরকার হয়, সেজন্যই নির্বাচনের আগে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা মনে করি, সরকার এবং যারা সংশ্লিষ্ট, তারা আন্তরিক হলে দাবিগুলো বাস্তবায়ন করে ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন সম্ভব। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করবো।”
তার কথা, “কোনো সংঘাত হবে কেন? আমরা তো কোনো সংঘাতের কর্মসূচি দেইনি। আমরা তো আমাদের দাবি আদায়ের কর্মসূচি দিয়েছি। আর বিএনপি এক সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিও মানতে চায়নি। বলেছিল, নিরপেক্ষ বলতে কেউ নাই। পরে কিন্তু তারাই দাবির মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনেছে।”
জামায়াতের সাথে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ ইফতেখার তারিক বলেন, “আমরা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন করে এখনই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের এজেন্ডাতে সেটা নাই৷ এই কারণে আমরা শঙ্কিত। ফলে আমরা সরকার, বিএনপি, সবার নজরে আনার জন্য, জনগণকে জানাতে আন্দোলনে যাচ্ছি। বিএনপি আমাদের দাবির বিরোধী। কিন্তু আমরা চাই বিএনপি যেন আওয়ামী লীগের মতো কোনো দলে পরিণত না হয়, বিএনপির পরিণতি যেন আওয়ামী লীগের মতো না হয় আমরা সেটাই চেষ্টা করছি। আমরা বিএনপিকে সহযোগিতা করছি। তবে তারা যদি আমাদের দাবির সাথে একমত না হয়, তাহলে আশঙ্কা করছি- বিএনপির পরিণতিও আওয়ামী লীগের মতো হবে।”
এই যুগপৎ আন্দোলনের আরেক শরিক নেজামে ইসলামী পার্টির মহাসচিব মুসা বিন এজহার বলের, “ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা চলবে। আলোচনা আলোচনার জায়গায় থাকবে। আন্দোলনও চলবে। আমাদের দাবি যদি পুরণ হয়, তাহলে আমরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করবো।”
তার কথা, “জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করে নির্বাচন করতে হবে। আর জাতীয় পার্টির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন হবে। তাই জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনের আগে নিষিদ্ধ করতে হবে।”
গণ অধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসান বলেন, “তাদের দাবির সাথে আমরা মোটামুটি একমত হলেও আমরা যুগপৎ আন্দোলনে থাকছি না। আমরা চাই, আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হোক। এটা নিয়ে রাজপথে কোনো খারাপ পরিস্থিতি হোক তা আমরা চাই না।”

আর এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন বলেন, “এখনো তো ঐকমত্য কমিশনে আলোচনার জন্য আরো একমাস সময় আছে। কমিশনের সময় তো বাড়ানো হয়েছে। ফলে, আমরা মাঠের কোনো আন্দোলনে আপাতত যাচ্ছি না। আমাদের দাবি নিয়ে আমরা কথা বলছি। আমরা তো গণপরিষদ নির্বাচন চাই আগে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, সংবিধান সংস্কার এগুলো গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমেই করা সহজ। আর আমরা তো উভয় কক্ষে পিআর চাই না, আমরা চাই উচ্চ কক্ষে।”
তার কথা, “এইসব বিষয় নিয়ে মাঠের রাজনীতি উত্তপ্ত করে কোনো বিশৃঙ্খল পরিবেশ হোক তা আমরা চাই না। আর শেষ পর্যন্ত যদি আমাদের দাবি পুরণ না হয়, তাহলে তখন আমরা আন্দোলনের কথা চিন্তা করবো।”
এদিকে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, “এই সময়ে যেগুলা ইস্যু না কোনো রাজনৈতিক দল যদি সেগুলোকে সামনে আনে, সেটা তাদের বিষয়। কিন্তু আমাদের কথা হলো, দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের। তাই কোনো সময় নষ্ট না করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে মনযোগী হতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে এক সঙ্গে নিয়ে সরকারকে নির্বাচনি যাত্রায় শামিল হতে হবে।”
“এটা যদি সরকার করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে। তখন দেশি-বিদেশি অপশক্তি সুযোগ নেবে,” মনে করেন তিনি।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান মনে করেন,” আসলে জামায়াতকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলগুলো বিএনপিকে শক্তি দেখাতে চাইছে। সেই কারণেই তারা রাজধানী, জেলাসহ সারাদেশে ধারবাহিক কর্মসূচি দিচ্ছে। তারা এর মাধ্যমে নির্র্বাচনে বিএনপির কাছ থেকে সুবিধা নিতে চাইছে। আরেকটা বিষয় হলো, এর মাধ্যমে তারা নির্বাচনের আগে একটা রাজনৈতিক মোর্চা গঠন করতে চাইছে। আসলে তারা কার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে তাই পরিস্কার না। আবার সব ভোট একবাক্সে আনার কথাও বলছে তাদের কেউ কেউ।”
“এখানে যে ইস্যুগুলো সামনে আনা হচ্ছে, তার সবগুলোর ব্যাপারে কিন্তু এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ একমত নয়। আগে শোনা যাচ্ছিলো তারাও থাকবে। কিন্তু যুগপৎ আন্দোলনে তারা নাই। আছে জামায়াতসহ কিছু ইসলামী দল। তারা চাইছে সবাইকে এক জোট করে বিএনপিকে চাপে ফেলতে। আর জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে বিএনপি আসলেই চাপে পড়বে। কারণ, বাকি সবাই নির্বাচন বর্জন করলে তখন নির্বাচনের জন্য বিএনপির সঙ্গে কেউ থাকবে না। ফলে জাতীয় পার্টির থাকা বিএনপির জন্য জরুরি,” বলেন তিনি।
তার কথা,” আমি মনে করি না যে, এটা মাঠের সংঘাতে রূপ নেবে। তবে একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা আমি দেখছি।”
আর রাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট রোখসানা খন্দকারের কথা হলো,” জামায়াত এবং তার সঙ্গে যারা আছে, তারা মনে করছে সরকার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের দিকেই যাচ্ছে। কিন্তু তারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চায় না। তারা নানা হিসাব করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তারা ভালো করায় তারা মনে করছে এই ধারা অব্যাহত থাকলে তাদের রাজনীতির মাঠের অবস্থা আরো ভালো হবে। তাই তারা নির্বাচন পিছাতে চায়। তারা মনে করে, আরো পরে নির্বাচন হলে হয়তো তারা ক্ষমতায়ও যেতে পারে।”
“তারা একই সাথে নির্বাচন চাইছে আবার বলছে, ‘আমাদের দাবী না মানলে আমরা নির্বাচনে যাবো না।’ শেষ সময়ে এসে তারা নতুন নতুন ইস্যু সামনে আনছে। এতেই তাদের উদ্দেশ্য বোঝা যায়,” বলেন তিনি।
তার কথা, ” নির্বাচনের সঙ্গে মিলিয়ে যারা নতুন নতুন দাবি তুলছেন,
তাদের মধ্যে সরকারের টিমও আছে। তাহলে তো সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই সরকারকেই সব কিছু পরিস্কার করতে হবে। তা না হলে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।”
জামায়াত ও তাদের সসমনা ইসলামি দলগুলো ১৮ (বৃহস্পতিবার) সেপ্টেম্বর ঢাকায়, ১৯ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় শহর ও ২৬ সেপ্টেম্বর সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি পালন করবে পাঁচ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। এরপর আবার নতুন কর্মসূচি দেবে। পর্যায়ক্রমে তাদের আন্দোলন আরো কঠোর করবে তারা।
dw.com