অস্ত্রের প্রকাশ ও উদ্দেশ্য
সম্প্রতি চীনের সামরিক কুচকাওয়াজে প্রদর্শিত সিজে-১০০০ বা ‘লং সোর্ড-১০০০’ নামের ক্ষেপণাস্ত্রকে বলা হচ্ছে বিশ্বের প্রথম হাইপারসনিক প্লেন ধ্বংসকারী অস্ত্র। এটি ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য একটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, যা ভূমি, সমুদ্র কিংবা আকাশে অবস্থানরত ‘সিস্টেম-নোড’ লক্ষ্যবস্তুতে অতিদূর পাল্লার হামলার জন্য তৈরি।
যদিও চীন আনুষ্ঠানিকভাবে এর পূর্ণাঙ্গ কারিগরি তথ্য প্রকাশ করেনি এবং পরীক্ষার ফলাফলও প্রকাশিত হয়নি, সামরিক বিশ্লেষকদের ধারণা—এটি কার্যকর হলে আকাশযুদ্ধের নিয়মই বদলে দিতে পারে।
সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু
সিজে-১০০০ এর মাধ্যমে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) কয়েক হাজার কিলোমিটার দূর থেকে মাখ ৫-এর বেশি গতিতে আকাশে থাকা গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে আঘাত হানতে পারবে। এর মধ্যে রয়েছে আকাশে জ্বালানি সরবরাহকারী বিমান, আকাশ থেকে শত্রু পর্যবেক্ষণ ও সতর্কীকরণ বিমান (AEW), নজরদারি প্ল্যাটফর্ম, এমনকি রাষ্ট্রপ্রধান পরিবহনকারী বিমানও।
চীনের সামরিক নীতি অনুযায়ী, এ ধরনের অস্ত্র মূলত কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল নোড ধ্বংসে ব্যবহৃত হবে, যা একটি সম্পূর্ণ সামরিক অভিযানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কৌশলগত সিদ্ধান্তের গুরুত্ব
চীনের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির গবেষকরা আগস্টে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, অতিদূরপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত প্রচলিত প্রতিরক্ষা অস্ত্রের মতো স্থানীয় কমান্ড পর্যায়ে হয় না; বরং সর্বোচ্চ পর্যায়ের সামরিক কমান্ডারের অনুমোদন লাগে।
প্রবন্ধে বলা হয়, এ ধরনের হামলার খরচ ও প্রভাব এত বেশি যে, অভিযান-স্তরের (campaign-level) কমান্ডারদের সরাসরি সিদ্ধান্ত ছাড়া ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এর ফলে যে কোনো হামলার সময়, লক্ষ্য নির্ধারণ ও পরিস্থিতি মূল্যায়নে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সরাসরি জড়িত থাকে।
সম্ভাব্য আক্রমণের ধরন
সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সিজে-১০০০ মূলত বড় আকারের, উচ্চতায় উড়লেও তুলনামূলক ধীরগতির মার্কিন নজরদারি ও সহায়ক বিমানগুলোকে লক্ষ্য করবে। যেমন—E-3 Sentry AWACS, KC-135/KC-46 রিফুয়েলার, অথবা RC-135 গোয়েন্দা বিমান, যা গুয়াম, হাওয়াই কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকেও পরিচালিত হতে পারে।
কৌশলগত বিপ্লব
আধুনিক আকাশযুদ্ধে ‘ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার’ হিসেবে এসব সহায়ক বিমানের ভূমিকা অপরিহার্য—এগুলো সতর্কতা, ইলেকট্রনিক সহায়তা, তথ্য সংহতকরণ ও জ্বালানি সরবরাহ করে। এগুলো ধ্বংস হলে কোনো সরাসরি যুদ্ধবিমান না নামিয়েও পুরো আকাশযুদ্ধ অচল হয়ে যেতে পারে।
সিজে-১০০০ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৬,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে কিংবা দক্ষিণ চীন সাগরের নৌঘাঁটি থেকেও এটি উৎক্ষেপণ করা সম্ভব। হাইপারসনিক গতিতে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষের পাল্টা প্রতিক্রিয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
সনাক্তকরণ এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা
সিজে-১০০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় অপেক্ষাকৃত নিচু উচ্চতায় উড়ে এবং স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনের কারণে অতিরিক্ত কৌশলগত গতিশীলতা লাভ করে। ফলে বর্তমান সতর্কীকরণ স্যাটেলাইট ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্তকরণ রাডার এড়িয়ে যেতে সক্ষম হতে পারে।
স্তরভিত্তিক প্রতিরক্ষা কৌশল
ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির গবেষণায় দেখা গেছে, কম্পিউটার-ভিত্তিক বৃহৎ সামরিক যুদ্ধ খেলার মাধ্যমে তিন স্তরের আকাশ প্রতিরক্ষা কৌশল অনুশীলন করা হচ্ছে।
- প্রথম স্তর: ড্রোন ও স্বল্প দূরত্বের হুমকির জন্য স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
- দ্বিতীয় স্তর: মধ্য ও দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, যা মূলত স্টেলথ লক্ষ্যবস্তু ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করবে।
- তৃতীয় স্তর: সিজে-১০০০ এর মতো অতিদূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, যা শুধুমাত্র সর্বোচ্চ সামরিক সদর দপ্তরের অনুমতিতে চালানো যাবে।
এভাবে ধাপে ধাপে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে যাতে অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা না বাড়ে এবং কেবল সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তেই এ ধরনের কৌশলগত অস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
বৈশ্বিক প্রভাব
দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা নিরাপদ দূরত্বে সহায়ক বিমান ব্যবহার করে আসছিল, যা প্রচলিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বাইরে থাকত। সিজে-১০০০ এর আবির্ভাব সেই নিরাপত্তার গ্যারান্টি ভেঙে দিয়েছে। এর ফলে আকাশযুদ্ধের ভারসাম্যে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে, যা বৈশ্বিক সামরিক কৌশল পাল্টে দিতে সক্ষম।