গাজায় একটি পরিবারের গাড়িতে গোলাবর্ষণের পর পাঁচ বছরের শিশু হিন্দ রাজাবের মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, এটি মানবিকতার ওপর এক গভীর আঘাতের প্রতীক। ইসরায়েলি গণমাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের যেভাবে ধারাবাহিকভাবে অমানবিক করে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে একটি শিশুকেও শত্রু হিসেবে দেখা সম্ভব হয়ে উঠেছে—এই বাস্তবতাই ফুটে উঠেছে সিনেমা দ্য ভয়েস অব হিন্দ রাজাবে।
সিনেমাটি দেখতে আমার ভয় লাগছিল। কারণ আমি জানতাম, এটি তৈরি হয়েছে একটি পাঁচ বছরের গাজাবাসী শিশুর বাস্তব কণ্ঠস্বরের ওপর ভিত্তি করে। পরিবারের মৃতদেহের পাশে একটি গাড়ির ভেতর আটকে পড়ে হিন্দ রাজাব উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছিল। আমি জানতাম, শেষ পর্যন্ত শিশুটিও মারা যায়। আর এটাও জানতাম, সিনেমাটির নির্মাতা কাওথার বেন হানিয়া এমনভাবে তথ্যচিত্র ও কল্পনার মিশ্রণ ঘটান, যা দর্শকের চোখ ফেরানো কঠিন করে তোলে।
এই সিনেমায় উত্তেজনা নেই, কারণ শেষটা আগেই জানা। কিন্তু দর্শকের প্রতি এক অদ্ভুত দয়া রয়েছে। কোথাও হিন্দকে সরাসরি দেখা যায় না—না তার ভয়, না তার মৃত্যু। পুরো দৃশ্যপট সীমাবদ্ধ থাকে রামাল্লায় অবস্থিত একটি উদ্ধারকেন্দ্রে, যেখানে কর্মীরা কম্পিউটার স্ক্রিন আর কাচের দেয়ালের আড়ালে বসে সমন্বয়ের চেষ্টা করেন। বাস্তবে যদিও সিনেমাটি তিউনিসিয়ায় নির্মিত সেটে ধারণ করা হয়েছে।
আট মিনিটের পথ, দুই ঘণ্টার অপেক্ষা
হিন্দকে উদ্ধারে অ্যাম্বুলেন্সের পথ মাত্র কয়েক মিনিটের। কিন্তু সেই পথ পাড়ি দিতে হলে প্রয়োজন অনুমোদন। কার অনুমোদন, তা স্পষ্ট নয়। জানা যায় শুধু, ‘সমন্বয়’ ছাড়া অ্যাম্বুলেন্স নড়তে পারে না। শেষ পর্যন্ত, যেমনটি আমি আগেই জানতাম, ইসরায়েলি বাহিনীর গোলায় অ্যাম্বুলেন্সটি ধ্বংস হয় এবং সবাই মারা যায়।
![]()
তবে এই মৃত্যুগুলোই সিনেমার মূল বিষয় নয়। আসল বিষয় হলো, যারা এই মৃত্যু ঠেকাতে চেয়েছিল, সেই মানুষগুলোর ভেতরে তৈরি হওয়া নৈতিক ক্ষত। এই উপলব্ধি আমাকে আরও ভয় পাইয়ে দেয়, কারণ এটি অনেক বেশি ব্যক্তিগত ও গভীর।
সমন্বয়: একটি শব্দ, একটি বোঝা
এই সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দটি হলো ‘সমন্বয়’। কখনো ফিসফিস, কখনো চিৎকারে, কখনো অনুনয়ে, কখনো হতাশায় এই শব্দটি বারবার উচ্চারিত হয়। যেন এটি কোনো জাদুমন্ত্র।
উদ্ধারকর্মী মাহদি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে সমন্বয় চলে। তিনি জেরুজালেমে রেড ক্রসকে ফোন করেন। রেড ক্রস যোগাযোগ করে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি ইউনিটের সঙ্গে। তারা রুট নির্ধারণ করে। সেই রুট আবার ফিরে আসে মাহদির কাছে। কিন্তু রুট পেলেই কাজ শেষ নয়। অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর জন্য আলাদা করে ‘সবুজ সংকেত’ দরকার। মাহদি বলেন, নিয়ম না মানলে অ্যাম্বুলেন্সে গুলি চালিয়ে দোষ আমাদের ঘাড়েই চাপানো হতে পারে।
এই প্রক্রিয়ার বেশিরভাগ সময়ই কেটে যায় অপেক্ষায়। উদ্ধারকর্মী ওমর, যিনি সরাসরি হিন্দের সঙ্গে কথা বলছিলেন, এই অপেক্ষা সহ্য করতে পারেন না। তিনি নিয়ম ভেঙে সরাসরি অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে চান। কিন্তু মাহদি মাঠে থাকা উদ্ধারকর্মীদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারেন না।
সমন্বয়ের ঐতিহাসিক ছায়া
‘সমন্বয়’ শব্দটি আমার কাছে ভিন্ন এক অর্থ নিয়ে হাজির হয়। জার্মানিতে নাৎসি আমলে এই শব্দটি ব্যবহার করা হতো প্রতিষ্ঠান ও মানুষদের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে একরেখায় আনার প্রক্রিয়া বোঝাতে। কেউ বিশ্বাস থেকে, কেউ স্বার্থে, কেউ বাধ্য হয়ে সেই পথে হাঁটত।
পরিচালক কাওথার বেন হানিয়া জানিয়েছেন, এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তার মাথায় ছিল না। আরবি ‘তানসিক’-এর সরাসরি অনুবাদ হিসেবেই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তবুও, মিলটি অস্বস্তিকর।
এই সিনেমার চরিত্রদের সমন্বয় ছাড়া উপায় নেই। তবে সবার অবস্থান এক নয়। মাহদি নিয়ম মানাকেই সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রাণ বাঁচানোর উপায় মনে করেন। ওমরের কাছে এই সমন্বয়ই শিশুটির ভয়, আঘাত এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলার নাম। তিনি প্রশ্ন করেন, যারা উদ্ধারকর্মীদের হত্যা করেছে, তাদের সঙ্গেই কীভাবে সমন্বয় সম্ভব। একপর্যায়ে এই দ্বন্দ্ব হাতাহাতিতে গড়ায়।

মানবিকতা বনাম ব্যবহৃত হওয়ার ভয়
সিনেমায় এক পর্যায়ে প্রস্তাব আসে, হিন্দকে উদ্ধারের পর তাকে প্রচারণার কাজে ব্যবহার করার কথা বলা যেতে পারে। ঘরে উপস্থিত সবাই বিস্মিত হয়ে যায়। ধারণাটি বুদ্ধিদীপ্ত মনে হলেও বাস্তবে তা অসম্ভব। কারণ অদৃশ্য এক সত্য সবার জানা—ইসরায়েলি গণমাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের এতটাই অমানবিক করা হয়েছে যে একটি পাঁচ বছরের শিশুকেও শত্রু ছাড়া অন্য কিছু ভাবা হয় না।
দুই ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে যায়। পথ অনুমোদন হয়, কিন্তু সবুজ সংকেত আসে না। হিন্দ বুঝতে পারে না, কেন বড়রা তাকে সাহায্য করতে পারছে না। উদ্ধারকর্মী রানা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, সবাই চেষ্টা করছে, সমন্বয় চলছে।
শেষবার ‘সমন্বয়’ শব্দটি শোনা যায় হিন্দের মায়ের কণ্ঠে। তিনি জানতে চান, সব ঠিক হয়েছে কি না। কর্মীরা আশ্বস্ত করেন।
অ্যাম্বুলেন্সটি যখন গুলিবিদ্ধ হয়, তখন তারা হিন্দের মাত্র প্রায় দুইশ ফুট দূরে ছিল। গোলাবর্ষণের পরও হিন্দ অন্তত এক ঘণ্টা বেঁচে ছিল।
প্রশংসা, পুরস্কার ও নীরব বর্জন
দ্য ভয়েস অব হিন্দ রাজাব সেপ্টেম্বরে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়ে গ্র্যান্ড জুরি পুরস্কার পায়। টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবেও ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় পরিবেশক আগ্রহ দেখালেও একে একে সরে যায়। শেষ পর্যন্ত প্রযোজকদের একজন নিজ উদ্যোগে সীমিত পরিবেশনার ব্যবস্থা করেন। নিউইয়র্ক ও লস অ্যাঞ্জেলেসে সিনেমাটি মুক্তি পায়।
বিশ্বের অন্য দেশে এই সিনেমার বড় পরিবেশক থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলে নেই। এটিও এক ধরনের সমন্বয়—নীরব, কিন্তু গভীর অর্থবহ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















