প্রাবোয়োর আকস্মিক সিদ্ধান্ত
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোয়ো সুবিয়ান্তো প্রথমে বেইজিং সফর বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দেশে ব্যাপক প্রতিবাদের কারণে তিনি চীনের সামরিক কুচকাওয়াজে অংশ নেবেন না বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে চীনের জরুরি অনুরোধে মত বদলান এবং ৩ সেপ্টেম্বর সকালে ধূসর স্যুট পরে তিয়েনআনমেন স্কয়ারের কুচকাওয়াজে যোগ দেন। তিনি বসেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পাশে, আরেক পাশে ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
সূত্র জানায়, প্রাবোয়ো অনুষ্ঠানের কয়েক ঘণ্টা আগে বেইজিং পৌঁছান এবং এশিয়ান প্রতিনিধি দলের জন্য নির্ধারিত হোটেল ভরতি থাকায় অন্য হোটেলে থাকতে হয়। প্রেসিডেন্টের কার্যালয় জানায়, সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল চীনের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখা।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্ত উপস্থিতি
প্রাবোয়ো ছাড়াও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম, ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট লুয়ং কুয়ং, লাওসের প্রেসিডেন্ট থোংলুন সিসৌলিথ, কম্বোডিয়ার রাজা নোরোদম সিহামনি, মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিন অং হ্লাইং এবং সিঙ্গাপুরের উপপ্রধানমন্ত্রী গ্যান কিম ইয়ং অংশ নেন।
এটি ছিল ৮০তম বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ উপস্থিত হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতাদের উপস্থিতি চীনের প্রতি সমর্থনের বার্তা এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত যে, অঞ্চলের কাছে বিকল্প অংশীদার রয়েছে।
অর্থনীতি ও কূটনীতির টানাপোড়েন
বিশ্লেষক বেঞ্জামিন হো বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি আগ্রাসনের শিকার হিসেবে ঐক্যমত পোষণ করে, অন্যদিকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতির চাপে বিকল্প খুঁজছে। চীনের আয়োজিত কুচকাওয়াজে যোগ দেওয়া ছিল এক ধরনের কূটনৈতিক সংকেত যে, অঞ্চলের দেশগুলোর হাতে বিকল্প পথ আছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলনে বলেছিলেন, বিশ্বে আধিপত্যবাদ ও সুরক্ষাবাদ এখনো বড় হুমকি। তিনি একীকরণ, বহুপক্ষীয়তা এবং বৈশ্বিক গণতন্ত্র বৃদ্ধির পক্ষে বক্তব্য রাখেন। এ ধরনের বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কচাপে থাকা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
চীনের নেতৃত্বের বার্তা
চীনা বিশ্লেষক ওয়াং ইওয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় হতাশ হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এখন ক্রমশ পূর্বমুখী হচ্ছে। চীন শুধু সামরিক নয়, অর্থনীতিতেও এখন এ অঞ্চলের ইঞ্জিন। অনেক দেশের জন্য কুচকাওয়াজে যোগ দেওয়া ছিল শুধু ইতিহাস স্মরণের জন্য নয়, বরং চীনের নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ স্বীকৃতি।
শি জিনপিং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে জানান, উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থ রক্ষায় চীন একসঙ্গে কাজ করবে। তিনি প্রাবোয়োর সঙ্গে বৈঠকে unilateral বা একতরফা আধিপত্যবাদের বিরোধিতার আহ্বান জানান।
বাস্তববাদী কূটনীতি
অস্ট্রেলিয়ার বন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জনাথন পিং মনে করেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপস্থিতি ছিল এক ধরনের বাস্তববাদী কৌশল। চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত নীতি এবং শুল্ক যুদ্ধ—সব মিলিয়ে অঞ্চলটি চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে।
ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষক পিটার মামফোর্ড বলেন, এ ধরনের বড় অনুষ্ঠানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অংশগ্রহণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকায় আমন্ত্রণ পেলে নেতারা যোগ দিতে আগ্রহী হন।
সীমাবদ্ধতা ও সন্দেহ
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বিরোধ চীন-আসিয়ান সম্পর্ককে জটিল করে তুলছে। বিশেষত বেইজিং ও ম্যানিলার মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। চীন প্রায় পুরো সাগরের ওপর মালিকানা দাবি করছে।
বেঞ্জামিন হো বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অবস্থান হলো “সতর্ক সমর্থন”। কারণ শুধু অনুষ্ঠান বা নৈশভোজ দিয়ে সম্পর্ক মজবুত হয় না। বাস্তবে চীন কিভাবে কূটনীতি চালায়, সেটাই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ধরন।
চীন চাইছে এ অঞ্চলে পশ্চিমাদের বিকল্প হয়ে উঠতে এবং বহুপাক্ষিক বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে। কিন্তু দক্ষিণ চীন সাগরে বিরোধ ও দ্বন্দ্ব তাদের দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো তাই একদিকে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, অন্যদিকে সতর্কভাবে দেখছে চীন আসলে কতটা নির্ভরযোগ্য অংশীদার হয়ে উঠতে পারে।