১০:৩৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

রাজসাহীর ইতিহাস (পর্ব -২৩)

(১) তিলি-তিল শস্য বিক্রেতাকে আদিতে তিলি জাতি বলিত। এক্ষণ ব্যবসায়ী জাতিকে তিলি বলে। রাজসাহীতে পাঁচুপুর, গোবিন্দপুর, হাতিয়ানদহ, আড়ানী, মালঞ্চি প্রভৃতি স্থানে তিলি জাতীয় অনেক ধনী লোক আছে। তিলি জাতির মধ্যে দিঘাপতিয়ার রাজা প্রসিদ্ধ। এই তিলি জাতিতে প্রায়শই দরিদ্র নাই। এই জাতির আর একটি শ্রেণি তেলি নামে কথিত আছে। ইহারা তৈলবিক্রেতা। কোন কোন স্থানে তেলি জল-অনাচরণীয় জাতি বলিয়া প্রসিদ্ধ।

(২) মালি-ইহারা মালকার নামে প্রসিদ্ধ। ইহাদের ব্যবসা পুষ্পচয়ন করা এবং মালা গ্রন্থন দেওয়া। অধুনা ইহারা বিবাহ, চূড়াকরণ প্রভৃতি মাঙ্গলিক কার্যে শোলার মুকুট ও ফুল প্রস্তুত এবং দেবপ্রতিমাদি চিত্র করিয়া থাকে।

(৩) তামুলি-ইহাদের আদি ব্যবসা পান বিক্রয় করা। এই রাজসাহীতে গোয়ালকান্দি ও আমরাইল গ্রামে যে তামুলি আছে তাহারা জমিদার। তামুলিরা কুসিদজীবী। ইহা কথিত আছে যে তামুলিরা এত বেশি হারে সুদ গ্রহণ করিত যে অধমর্ণেরা এত বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হইয়াছিল যে প্রায় ৬৫ কি ৭০ বৎসর পূর্বে ‘তামুলি লুট’ নামে একটি বৃহদাকারে বড়গাছিতে তামুলির বাড়ি লুট হয়। বড়গাছি রামপুর-বোয়ালিয়া হইতে প্রায় ১২ মাইল উত্তর। তাহিরপুর পরগণার প্রজারাই বেশি প্রপীড়িত হয়। ইহারা ও অন্যান্য প্রজারা লুট করে। খত, খাতা, ও যাবতীয় কাগজপত্র অগ্নিসাৎ করে। এই ঘটনা হইতে তামুলি জাতিকে সেক্সপিয়ারের সাইলক (Shy-lock) বলিলে অত্যুক্তি হইত না। এক্ষণ তামুলি জাতির কুসিদ ব্যবসায় উন্নতি নাই। এক্ষণ প্রায় সকল জাতিই কুসিদজীবী।

(৪) গোপ-শব্দার্থে গো রক্ষককে গোপ বলে। বঙ্গের দক্ষিণ ভাগে সঙ্গোপকে গোপ বলে। ইহাদের সাধারণ ব্যবসা কৃষি। হুগলি জেলাতে অনেক সদ্বংশজাত শিক্ষিত সাপের বাস। কিন্তু ঐ দেশে যাহাদের গোয়ালা বলে তাহারা নবশাখ নহে এবং তাহারা অনাচরণীয়। রাজসাহীতে যাহাদের গোপ বলে তাহারা দধি দুগ্ধ ব্যবসায়ী এবং তাহারা জল আচরণীয়। রাজসাহীতে দক্ষিণ দেশের ন্যায় গোয়ালা নাই। দক্ষিণদেশ সদৃশ সদগোপ এ জেলায় অতি অল্প সংখ্যক। ইহাদের ব্যবসা কৃষি। ইহাদের কুটুম্ব হুগলি, বীরভূম, বাঁকুড়া প্রভৃতি জেলায় আছে।

(৫) নাপিত-ইহাদের ব্যবসা ক্ষৌর কার্য। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব সন্ন্যাস গ্রহণ সময় মধু নাপিত তাহার মস্তক মুণ্ডন করে। এই সময় হইতে মধু নাপিতের বংশধরেরা ক্ষৌর কর্ম ত্যাগ করিয়া মোদকাদি প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে। রাজসাহীর অন্তর্গত কলম, ডায়া প্রভৃতি গ্রামে কতিপয় মধুবংশীয় নাপিত আছে।

(৬) গোছালি-ইহারা পান প্রস্তুত করে এবং বিক্রয় করে। ইহাদের সাধারণত ‘পানতীয়া’ বা বারুই বলে। গুচ্ছ শব্দে আঁটি বুঝায়। যে পানের আঁটি বা গুচ্ছ বাঁধে তাহাকে গোছালি বলা যায়।

(৭) কামার-ইহারা লৌহদ্রব্য প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে।

(৮) কুমার-ইহারা মৃন্ময় ঘটাদি প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে।

২. বার মাসিয়া-ইহাদের নির্দিষ্ট বাসস্থান নাই। প্রায় নৌকাই ইহাদের বাসস্থান। সূচ, সুতা, চিরণী, আয়না ইত্যাদি দ্রব্য লইয়া হাটে ও গ্রামে গ্রামে বিক্রয় করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে।
৩. জোলা-ইহারা মোটা কার্পাস বস্ত্র এবং মোটা মশারি প্রস্তুত করে। ইহাদের সংখ্যা নিতান্ত কম।
৪. নলুয়া– ইহারা নলের দড়মা প্রস্তুত করে এবং কেহ কেহ সময় সময় কৃষিকার্যও করে।
৫. চুলি ও বেহারা-রাজসাহী জেলার দক্ষিণভাগে কতকগুলি মুসলমান আছে। তাহারা বিবাহ আদিতে ঢোল বাজায় এবং পালকি আদি বহন করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে।
বার মাসিয়া, জোলা, নলুয়া, চুলি ও বেহারা এই প্রকার নিম্ন শ্রেণির মুসলমানদের সহিত প্রথম শ্রেণির বা কৃষকশ্রেণি ভদ্রবংশজাত মুসলমানদের বিবাহ বা আহারাদি প্রচলিত নাই। এই সকল নিম্ন মুসলমানের ব্যবহার ও ব্যবসা কোন কোন অংশে ইতর হিন্দুর সমান। মুসলমান রাজত্বকালে কতকগুলি ইতর হিন্দু মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়। নিম্ন শ্রেণি ও অনেক কৃষক মুসলমানদের আচার, নীতি ও ধর্মপ্রণালী দেখিয়া ইহা সম্পূর্ণ সম্ভব যে নিম্ন শ্রেণি ও কতকগুলি কৃষক শ্রেণির মুসলমানেরা ইতর হিন্দুর বংশধর হইবে। ইহাদের মধ্যে অনেকে ইতর হিন্দুদের আচার ব্যবহার ও ধর্মপ্রণালী ত্যাগ করিয়া প্রকৃত মুসলমানের আচার ব্যবহার গ্রহণ করিতেছে।

রাজসাহীর ইতিহাস (পর্ব -২৩)

০৭:২০:৫৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

(১) তিলি-তিল শস্য বিক্রেতাকে আদিতে তিলি জাতি বলিত। এক্ষণ ব্যবসায়ী জাতিকে তিলি বলে। রাজসাহীতে পাঁচুপুর, গোবিন্দপুর, হাতিয়ানদহ, আড়ানী, মালঞ্চি প্রভৃতি স্থানে তিলি জাতীয় অনেক ধনী লোক আছে। তিলি জাতির মধ্যে দিঘাপতিয়ার রাজা প্রসিদ্ধ। এই তিলি জাতিতে প্রায়শই দরিদ্র নাই। এই জাতির আর একটি শ্রেণি তেলি নামে কথিত আছে। ইহারা তৈলবিক্রেতা। কোন কোন স্থানে তেলি জল-অনাচরণীয় জাতি বলিয়া প্রসিদ্ধ।

(২) মালি-ইহারা মালকার নামে প্রসিদ্ধ। ইহাদের ব্যবসা পুষ্পচয়ন করা এবং মালা গ্রন্থন দেওয়া। অধুনা ইহারা বিবাহ, চূড়াকরণ প্রভৃতি মাঙ্গলিক কার্যে শোলার মুকুট ও ফুল প্রস্তুত এবং দেবপ্রতিমাদি চিত্র করিয়া থাকে।

(৩) তামুলি-ইহাদের আদি ব্যবসা পান বিক্রয় করা। এই রাজসাহীতে গোয়ালকান্দি ও আমরাইল গ্রামে যে তামুলি আছে তাহারা জমিদার। তামুলিরা কুসিদজীবী। ইহা কথিত আছে যে তামুলিরা এত বেশি হারে সুদ গ্রহণ করিত যে অধমর্ণেরা এত বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হইয়াছিল যে প্রায় ৬৫ কি ৭০ বৎসর পূর্বে ‘তামুলি লুট’ নামে একটি বৃহদাকারে বড়গাছিতে তামুলির বাড়ি লুট হয়। বড়গাছি রামপুর-বোয়ালিয়া হইতে প্রায় ১২ মাইল উত্তর। তাহিরপুর পরগণার প্রজারাই বেশি প্রপীড়িত হয়। ইহারা ও অন্যান্য প্রজারা লুট করে। খত, খাতা, ও যাবতীয় কাগজপত্র অগ্নিসাৎ করে। এই ঘটনা হইতে তামুলি জাতিকে সেক্সপিয়ারের সাইলক (Shy-lock) বলিলে অত্যুক্তি হইত না। এক্ষণ তামুলি জাতির কুসিদ ব্যবসায় উন্নতি নাই। এক্ষণ প্রায় সকল জাতিই কুসিদজীবী।

(৪) গোপ-শব্দার্থে গো রক্ষককে গোপ বলে। বঙ্গের দক্ষিণ ভাগে সঙ্গোপকে গোপ বলে। ইহাদের সাধারণ ব্যবসা কৃষি। হুগলি জেলাতে অনেক সদ্বংশজাত শিক্ষিত সাপের বাস। কিন্তু ঐ দেশে যাহাদের গোয়ালা বলে তাহারা নবশাখ নহে এবং তাহারা অনাচরণীয়। রাজসাহীতে যাহাদের গোপ বলে তাহারা দধি দুগ্ধ ব্যবসায়ী এবং তাহারা জল আচরণীয়। রাজসাহীতে দক্ষিণ দেশের ন্যায় গোয়ালা নাই। দক্ষিণদেশ সদৃশ সদগোপ এ জেলায় অতি অল্প সংখ্যক। ইহাদের ব্যবসা কৃষি। ইহাদের কুটুম্ব হুগলি, বীরভূম, বাঁকুড়া প্রভৃতি জেলায় আছে।

(৫) নাপিত-ইহাদের ব্যবসা ক্ষৌর কার্য। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব সন্ন্যাস গ্রহণ সময় মধু নাপিত তাহার মস্তক মুণ্ডন করে। এই সময় হইতে মধু নাপিতের বংশধরেরা ক্ষৌর কর্ম ত্যাগ করিয়া মোদকাদি প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে। রাজসাহীর অন্তর্গত কলম, ডায়া প্রভৃতি গ্রামে কতিপয় মধুবংশীয় নাপিত আছে।

(৬) গোছালি-ইহারা পান প্রস্তুত করে এবং বিক্রয় করে। ইহাদের সাধারণত ‘পানতীয়া’ বা বারুই বলে। গুচ্ছ শব্দে আঁটি বুঝায়। যে পানের আঁটি বা গুচ্ছ বাঁধে তাহাকে গোছালি বলা যায়।

(৭) কামার-ইহারা লৌহদ্রব্য প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে।

(৮) কুমার-ইহারা মৃন্ময় ঘটাদি প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে।

২. বার মাসিয়া-ইহাদের নির্দিষ্ট বাসস্থান নাই। প্রায় নৌকাই ইহাদের বাসস্থান। সূচ, সুতা, চিরণী, আয়না ইত্যাদি দ্রব্য লইয়া হাটে ও গ্রামে গ্রামে বিক্রয় করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে।
৩. জোলা-ইহারা মোটা কার্পাস বস্ত্র এবং মোটা মশারি প্রস্তুত করে। ইহাদের সংখ্যা নিতান্ত কম।
৪. নলুয়া– ইহারা নলের দড়মা প্রস্তুত করে এবং কেহ কেহ সময় সময় কৃষিকার্যও করে।
৫. চুলি ও বেহারা-রাজসাহী জেলার দক্ষিণভাগে কতকগুলি মুসলমান আছে। তাহারা বিবাহ আদিতে ঢোল বাজায় এবং পালকি আদি বহন করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে।
বার মাসিয়া, জোলা, নলুয়া, চুলি ও বেহারা এই প্রকার নিম্ন শ্রেণির মুসলমানদের সহিত প্রথম শ্রেণির বা কৃষকশ্রেণি ভদ্রবংশজাত মুসলমানদের বিবাহ বা আহারাদি প্রচলিত নাই। এই সকল নিম্ন মুসলমানের ব্যবহার ও ব্যবসা কোন কোন অংশে ইতর হিন্দুর সমান। মুসলমান রাজত্বকালে কতকগুলি ইতর হিন্দু মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়। নিম্ন শ্রেণি ও অনেক কৃষক মুসলমানদের আচার, নীতি ও ধর্মপ্রণালী দেখিয়া ইহা সম্পূর্ণ সম্ভব যে নিম্ন শ্রেণি ও কতকগুলি কৃষক শ্রেণির মুসলমানেরা ইতর হিন্দুর বংশধর হইবে। ইহাদের মধ্যে অনেকে ইতর হিন্দুদের আচার ব্যবহার ও ধর্মপ্রণালী ত্যাগ করিয়া প্রকৃত মুসলমানের আচার ব্যবহার গ্রহণ করিতেছে।