(১) তিলি-তিল শস্য বিক্রেতাকে আদিতে তিলি জাতি বলিত। এক্ষণ ব্যবসায়ী জাতিকে তিলি বলে। রাজসাহীতে পাঁচুপুর, গোবিন্দপুর, হাতিয়ানদহ, আড়ানী, মালঞ্চি প্রভৃতি স্থানে তিলি জাতীয় অনেক ধনী লোক আছে। তিলি জাতির মধ্যে দিঘাপতিয়ার রাজা প্রসিদ্ধ। এই তিলি জাতিতে প্রায়শই দরিদ্র নাই। এই জাতির আর একটি শ্রেণি তেলি নামে কথিত আছে। ইহারা তৈলবিক্রেতা। কোন কোন স্থানে তেলি জল-অনাচরণীয় জাতি বলিয়া প্রসিদ্ধ।
(২) মালি-ইহারা মালকার নামে প্রসিদ্ধ। ইহাদের ব্যবসা পুষ্পচয়ন করা এবং মালা গ্রন্থন দেওয়া। অধুনা ইহারা বিবাহ, চূড়াকরণ প্রভৃতি মাঙ্গলিক কার্যে শোলার মুকুট ও ফুল প্রস্তুত এবং দেবপ্রতিমাদি চিত্র করিয়া থাকে।
(৩) তামুলি-ইহাদের আদি ব্যবসা পান বিক্রয় করা। এই রাজসাহীতে গোয়ালকান্দি ও আমরাইল গ্রামে যে তামুলি আছে তাহারা জমিদার। তামুলিরা কুসিদজীবী। ইহা কথিত আছে যে তামুলিরা এত বেশি হারে সুদ গ্রহণ করিত যে অধমর্ণেরা এত বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হইয়াছিল যে প্রায় ৬৫ কি ৭০ বৎসর পূর্বে ‘তামুলি লুট’ নামে একটি বৃহদাকারে বড়গাছিতে তামুলির বাড়ি লুট হয়। বড়গাছি রামপুর-বোয়ালিয়া হইতে প্রায় ১২ মাইল উত্তর। তাহিরপুর পরগণার প্রজারাই বেশি প্রপীড়িত হয়। ইহারা ও অন্যান্য প্রজারা লুট করে। খত, খাতা, ও যাবতীয় কাগজপত্র অগ্নিসাৎ করে। এই ঘটনা হইতে তামুলি জাতিকে সেক্সপিয়ারের সাইলক (Shy-lock) বলিলে অত্যুক্তি হইত না। এক্ষণ তামুলি জাতির কুসিদ ব্যবসায় উন্নতি নাই। এক্ষণ প্রায় সকল জাতিই কুসিদজীবী।
(৪) গোপ-শব্দার্থে গো রক্ষককে গোপ বলে। বঙ্গের দক্ষিণ ভাগে সঙ্গোপকে গোপ বলে। ইহাদের সাধারণ ব্যবসা কৃষি। হুগলি জেলাতে অনেক সদ্বংশজাত শিক্ষিত সাপের বাস। কিন্তু ঐ দেশে যাহাদের গোয়ালা বলে তাহারা নবশাখ নহে এবং তাহারা অনাচরণীয়। রাজসাহীতে যাহাদের গোপ বলে তাহারা দধি দুগ্ধ ব্যবসায়ী এবং তাহারা জল আচরণীয়। রাজসাহীতে দক্ষিণ দেশের ন্যায় গোয়ালা নাই। দক্ষিণদেশ সদৃশ সদগোপ এ জেলায় অতি অল্প সংখ্যক। ইহাদের ব্যবসা কৃষি। ইহাদের কুটুম্ব হুগলি, বীরভূম, বাঁকুড়া প্রভৃতি জেলায় আছে।
(৫) নাপিত-ইহাদের ব্যবসা ক্ষৌর কার্য। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব সন্ন্যাস গ্রহণ সময় মধু নাপিত তাহার মস্তক মুণ্ডন করে। এই সময় হইতে মধু নাপিতের বংশধরেরা ক্ষৌর কর্ম ত্যাগ করিয়া মোদকাদি প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে। রাজসাহীর অন্তর্গত কলম, ডায়া প্রভৃতি গ্রামে কতিপয় মধুবংশীয় নাপিত আছে।
(৬) গোছালি-ইহারা পান প্রস্তুত করে এবং বিক্রয় করে। ইহাদের সাধারণত ‘পানতীয়া’ বা বারুই বলে। গুচ্ছ শব্দে আঁটি বুঝায়। যে পানের আঁটি বা গুচ্ছ বাঁধে তাহাকে গোছালি বলা যায়।
(৭) কামার-ইহারা লৌহদ্রব্য প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে।
(৮) কুমার-ইহারা মৃন্ময় ঘটাদি প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে।
(৯) পুটুলি-গন্ধবণিক, শঙ্খবণিক, তদ্ভবায়, ময়রা এই কয়েক জাতি পুঁটুলি বলিয়া প্রসিদ্ধ। ইহাদের ব্যবসায়ী দ্রব্য পুটুলি বাঁধিয়া বিক্রয় করিতে হয়। এই জন্য ইহাদের পুঁটুলি বলে।
৭. জল আচরণীয় হিন্দু অথচ নবশাখ নহে-জল আচরণীয় হিন্দুর মধ্যে কতকগুলি জাতি আছে যাহাদের জল এ জেলায় প্রচলিত আছে অথচ তাহারা নবশাখ নহে, যথা-১. কৈবর্ত, ২. দধি দুগ্ধ ব্যবসায়ী গোপ (গোয়ালা)। কৈবর্ত জাতির উল্লেখ বাল্মীকি প্রণীত রামায়ণে দেখা যায়। রাম বনবাস সময়ে কৈবর্তরাই তাহাকে গঙ্গানদী পার করিয়াছিল। এটি পুরাতন জাতি। ‘কৈবর্তে দাস দাস-ধীবরৌ’, এরূপ কৈবর্ত রাজসাহীতে নাই। কৈবর্তগণ দুই ভাগে বিভক্ত যথা-১. হেলে কৈবর্ত ২. জেলে কৈবর্ত। যাহারা কৃষি কর্ম ও দাসবৃত্তি করে, তাহারা হেলে কৈবর্ত। যাহারা মৎস্য ধরে এবং নাবিকের কার্য করে, তাহারা জেলে কৈবর্ত। রাজস্যহীতে দ্বিতীয় শ্রেণির কৈবর্ত নাই। এই জেলায় হেলে কৈবর্তই সমুদয়। ইহারা জল আচরণীয় কিন্তু ইহাদের পুরোহিতের জল ব্যবহার নাই। দধি দুগ্ধ ব্যবসায়ী গোপ (গোয়ালাদের) এবং তাহাদের পুরোহিতের জল প্রচলিত আছে। এই দধি দুগ্ধ ব্যবসায়ী গোপ দুই ভাগে বিভক্ত যথা-একভাগ দুগ্ধ মন্থন করিয়া মাখন প্রস্তুত করে। ইহাদের কাড়িয়া গোয়ালা বলে এবং ইহারা কৃষিকর্মও করে। অপরভাগ দধি মন্থন করিয়া মাখন প্রস্তুত করে। ইহাদের ব্যরেন্দ্র বা বাথানীয়া গোপ বলে। ইহারা পূর্বে একটি বিস্তৃত মাঠে বহুসংখ্যক গাভি রাখিয়া দধি দুগ্ধের ব্যবসা করিত। কৃষি কার্যের উন্নতিতে গাভী পোষণের জন্য মাঠ আর পাওয়া যায় না। যে মাঠে গাভীগণ থাকিত, তাহাকে বাথান বলিত। এক্ষণ রাজসাহীতে আর বাথান নাই। এক্ষণ গ্রাম গ্রাম হইতে দুগ্ধ ক্রয় করিয়া ব্যবসা করে।
কৈবর্তের সংখ্যই বেশি। কৈবর্ত প্রায় ৬০,০০০ কি ৭০,০০০; গোয়ালা প্রায় ১০০০ কি ১০,০০০ হইবে। কৈবর্ত প্রায়ই কৃষক। গোয়ালা ও কৈবর্তের অবস্থা সাধারণত মন্দ নহে। রাজসাহীর উত্তর ও দক্ষিণ ভাগেই কৈবর্তের সংখ্যা বেশি। পদ্মানদীর তীবরর্তী বেঙ্গগাড়ি গ্রামে যে সকল কৈবর্ত আছে; তন্মধ্যে ভৌমিক বংশীয়েরা শিক্ষিত। ইহারা জমিদার ও বাণিজ্য ব্যবসায়ী।
৮। জল অনাচরণীয় হিন্দু এই প্রকার হিন্দুর মধ্যে নানা শ্রেণি। রজক, হেলে’ রজক, তাঁতি, যোগী, গুঁড়ি বা সাহা, ছুতার, চণ্ডাল, জালিয়া, হকার প্রভৃতি অনাচরণীয় হিন্দুর বাস। হেলে রজক ও সাহা জাতির মধ্যে কতকগুলি ধনী মহাজন ও জমিদার আছে। ইহাদের সংখ্যা অতি কম। পুরাণ শাস্ত্র প্রণয়নের সময় হইতে হিন্দু সমাজ হীন অবস্থায় পতিত। এসময় হইতে এদেশীয় অসভ্য জাতিদের আর্যগণ বিবাহাদি করিতে লাগিলেন বা দ্বিজাতীরা অসবর্ণা ভার্যা গ্রহণ করিতে লাগিলেন। ইহাতে হাড়ি, ডোম, চণ্ডাল, যুগী, হেলে রজক প্রভৃতি নিচ জাতি সকলের উৎপত্তি হইল। ইহারাই সঙ্কর জাতি বলিয়া একটি সাধারণ নাম ধারণ করিল। রাজসাহীতে সঙ্কর জাতি নিতান্ত কম নহে।
রাজসাহীতে বৈষ্ণবের সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার বা ১৫ হাজার হইবে। ইহারা কোন জাতির অন্তর্গত নহে। মহাত্মা চৈতন্যদেবের সময় হইতে এই জাতির উৎপন্ন হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে ভেদাভেদ নাই। অধুনা অধিকাংশই ভিক্ষা ব্যবসায়ী। কেহ কেহ অন্য ব্যবসা করে এবং লেখাপড়া শিক্ষা করিয়া চাকরিও করিয়া থাকে।
মুসলমান রাজসাহী জেলার মোট লোক সংখ্যার তিন ভাগের অধিক মুসলমান, প্রায় এক ভাগ হিন্দু। রাজসাহীর মুসলমান সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে। এক শ্রেণির মুসলমান কোরাণের প্রকৃত ধর্ম প্রতিপালন করিয়া থাকে। অপর শ্রেণি মুসলমান উভ্যা হিন্দু ও মুসলমান দেবতাকে কোন কোন স্থানে সমানভাবে ভক্তি করে। প্রথম শ্রেণি মুসলমানের সংখ্যা অতি কম। ইহাদের মধ্যে অনেকেই সুশিক্ষিত। দ্বিতীয় শ্রেণি মুসলমানের রীতিনীতি ও ধর্মপ্রণালী কোন কোন অংশে ইতর হিন্দুর ন্যায়। ইহাতে বিশ্বাস করা যাইতে পারে যে, ইহারা পূর্বে ইতর হিন্দু ছিল। মুসলমান রাজত্ব সময় ইহারা মুসলমান হয়। ইহারা প্রায়ই অশিক্ষিত। আজি কালি এই দ্বিতীয় শ্রেণির মুসলমান মধ্যেও শিক্ষা বিস্তার আরম্ভহইয়াছে। মুসলমান মধ্যে যদিচ জাতিভেদ নাই, তথাপি দ্বিতীয় শ্রেণির মুসলমানদিগকে ৫ শ্রেণিতে বিভক্ত করা যাইতে পারে। যথা-
১. কৃষক-এই শ্রেণি মুসলমানের মধ্যে অনেকে ভদ্রবংশীয়। ইহাদের ব্যবসা অতি পবিত্র। রাজসাহীর কর্যকদের অবস্থা নিতান্ত মন্দ নহে। ইহাদের মধ্যে কেহ কেহ কোরাণের প্রকৃত ধর্ম আচরণ করে। আজকাল কৃষক সন্তানেরাও সুশিক্ষিত হইতেছে।
২. বার মাসিয়া-ইহাদের নির্দিষ্ট বাসস্থান নাই। প্রায় নৌকাই ইহাদের বাসস্থান। সূচ, সুতা, চিরণী, আয়না ইত্যাদি দ্রব্য লইয়া হাটে ও গ্রামে গ্রামে বিক্রয় করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে।
৩. জোলা-ইহারা মোটা কার্পাস বস্ত্র এবং মোটা মশারি প্রস্তুত করে। ইহাদের সংখ্যা নিতান্ত কম।
৪. নলুয়া– ইহারা নলের দড়মা প্রস্তুত করে এবং কেহ কেহ সময় সময় কৃষিকার্যও করে।
৫. চুলি ও বেহারা-রাজসাহী জেলার দক্ষিণভাগে কতকগুলি মুসলমান আছে। তাহারা বিবাহ আদিতে ঢোল বাজায় এবং পালকি আদি বহন করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে।
বার মাসিয়া, জোলা, নলুয়া, চুলি ও বেহারা এই প্রকার নিম্ন শ্রেণির মুসলমানদের সহিত প্রথম শ্রেণির বা কৃষকশ্রেণি ভদ্রবংশজাত মুসলমানদের বিবাহ বা আহারাদি প্রচলিত নাই। এই সকল নিম্ন মুসলমানের ব্যবহার ও ব্যবসা কোন কোন অংশে ইতর হিন্দুর সমান। মুসলমান রাজত্বকালে কতকগুলি ইতর হিন্দু মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়। নিম্ন শ্রেণি ও অনেক কৃষক মুসলমানদের আচার, নীতি ও ধর্মপ্রণালী দেখিয়া ইহা সম্পূর্ণ সম্ভব যে নিম্ন শ্রেণি ও কতকগুলি কৃষক শ্রেণির মুসলমানেরা ইতর হিন্দুর বংশধর হইবে। ইহাদের মধ্যে অনেকে ইতর হিন্দুদের আচার ব্যবহার ও ধর্মপ্রণালী ত্যাগ করিয়া প্রকৃত মুসলমানের আচার ব্যবহার গ্রহণ করিতেছে।
মুসলমান অধিকাংশই কৃষক। নাটোর, বাগা, বাঘধনী, তারাটিয়া প্রভৃতি স্থানে কতিপয় মুসলমান জমিদার আছে।