নেতৃত্বের দৌড়ে তাকাইচি
সানায়ে তাকাইচি জাপানের লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি)র নেতৃত্বে আসার ইচ্ছা ঘোষণা করেছেন। শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে লক্ষ্যভিত্তিক কর ছাড় এবং সেমিকন্ডাক্টরসহ কৌশলগত খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করবেন।
৬৪ বছর বয়সী এই রক্ষণশীল রাজনীতিক নির্বাচনে জয়ী হলে জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হবেন। তিনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বলেন, “জাপানকে আবারও বিশ্বের শীর্ষে নিয়ে যেতে চাই। অর্থনৈতিক শক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আমি প্রবৃদ্ধি অর্জনে অটল থাকব।”
রাজনৈতিক ধারা ও পূর্বের অভিজ্ঞতা
তাকাইচি দীর্ঘদিন ধরে জাপানি ঐতিহ্যগত মূল্যবোধে জোর দিয়ে আসছেন। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে তিনি পরিচিত। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে নিজের রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।
তিনি এর আগে দু’বার এলডিপি সভাপতির প্রার্থী হয়েছিলেন (২০২১ ও ২০২৪ সালে)। ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রথম রাউন্ডে সর্বাধিক ভোট পেলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে শিগেরু ইশিবার কাছে পরাজিত হন।
নারা প্রিফেকচারে জন্ম নেওয়া তাকাইচি ১৯৯৩ সালে প্রথমবার প্রতিনিধি পরিষদে নির্বাচিত হন এবং নয়বার পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও সামলেছেন—২০০৬ সালে প্রথম আবে মন্ত্রিসভায় ওকিনাওয়া ও উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা বিষয়ক মন্ত্রী, পরে অভ্যন্তরীণ বিষয় ও যোগাযোগ মন্ত্রী (২০১৪–২০১৭ ও ২০১৯–২০২০), এবং দুবার এলডিপির নীতি গবেষণা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।
২০২২ সালে ফুমিও কিশিদা প্রশাসনে তিনি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিষয়ক দায়িত্ব পান।
জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন
সর্বশেষ সমীক্ষায় তাকাইচিকে অন্যতম প্রধান প্রার্থী হিসেবে দেখা হচ্ছে। আগস্টের শেষ দিকে নিক্কেই ও টিভি টোকিওর জরিপে ২৩% সমর্থন পেয়ে তিনি প্রথম স্থানে ছিলেন, কৃষিমন্ত্রী শিনজিরো কোইজুমি ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে ২২% সমর্থন নিয়ে। তবে এলডিপি সমর্থকদের মধ্যে কোইজুমি অনেক বেশি জনপ্রিয় (৩২%), যেখানে তাকাইচির সমর্থন মাত্র ১৭%।
তাকাইচি সামাজিক মাধ্যমে অত্যন্ত সক্রিয়। তার এক্স (টুইটার) অনুসারীর সংখ্যা ৮ লাখ ৪০ হাজারের বেশি, যা ইশিবার ৫ লাখ ৩০ হাজার বা কোইজুমির ১ লাখ ৪০ হাজার থেকে অনেক বেশি। ইউটিউবেও তার প্রায় ৪ লাখ ৭০ হাজার সাবস্ক্রাইবার রয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবন
তাকাইচির বাবা ছিলেন এক উৎপাদন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, মা কাজ করতেন নারার প্রাদেশিক পুলিশে। তিনি মাতসুশিতা ইনস্টিটিউট অফ গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট থেকে পড়াশোনা করেন, যা বহু রাজনীতিক তৈরি করেছে। ১৯৮৭ সালে তিনি মার্কিন কংগ্রেসের এক নারী সদস্যের অফিসে ফেলো হিসেবে কাজ করেছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তাকাইচি হানশিন টাইগার্স বেসবল দলের সমর্থক। ছাত্রজীবনে তিনি একটি হেভি মেটাল ব্যান্ডে ড্রাম বাজাতেন। তার শখের মধ্যে স্কুবা ডাইভিং ও জাপানি মার্শাল আর্ট দেখা অন্যতম।
তিনি ২০০৪ সালে সংসদ সদস্য তাকু ইয়ামামোতোকে বিয়ে করেছিলেন। ২০১৭ সালে রাজনৈতিক মতবিরোধে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তবে পরে তারা আবারও মিলিত হয়ে ২০২১ সালে পুনর্বিবাহ করেন।
নীতিগত অবস্থান ও বিতর্ক
তাকাইচি দীর্ঘদিন ধরে আবের অর্থনৈতিক নীতি “আবেনমিক্স”-এর সমর্থক এবং সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতি ও মুদ্রানীতির পক্ষে। তিনি জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধির সমালোচক ছিলেন। তার সম্ভাব্য বিজয়কে অনেকে শেয়ারবাজার বৃদ্ধির এবং ইয়েন দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন। প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোর পক্ষে তার অবস্থানও বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ জাগিয়েছে।
তিনি বলেছেন, বৈশ্বিক প্রবণতা এখন অতিরিক্ত মিতব্যয়ী নীতি থেকে সরে গিয়ে দায়িত্বশীল সক্রিয় আর্থিক নীতির দিকে যাচ্ছে, যা সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে সামাজিক সমস্যার সমাধান করে।
তবে তার কিছু অবস্থান বিতর্ক তৈরি করেছে। তিনি অতীতে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি ইয়াসুকুনি মন্দির পরিদর্শন করবেন, যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের স্মৃতিও রয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলো এটিকে জাপানের সামরিক অতীতের প্রতীক মনে করে। এবার সমর্থন বাড়াতে তাকে এই ধরনের কঠোর অবস্থান কিছুটা নরম করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
ভোক্তাপর্যায়ে খাদ্যপণ্যে শূন্য কর আরোপের প্রস্তাবও তিনি দিয়েছিলেন, যা এলডিপির সরকারি অঙ্গীকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।
দলীয় পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা
সাম্প্রতিক নির্বাচনে এলডিপি সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। বিরোধীদলের সহযোগিতা ছাড়া তারা বিল বা বাজেট পাস করতে পারবে না। ফলে তাকাইচি প্রধানমন্ত্রী হলে কার সঙ্গে সমঝোতা করবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তার অতিরিক্ত রক্ষণশীল অবস্থান কোমেইতো দলের সঙ্গে সম্পর্কেও টানাপোড়েন তৈরি করতে পারে।
এলডিপির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা সোমবার হবে, আর ভোটগ্রহণ ও গণনা হবে ৪ অক্টোবর। তাকাইচির নেতৃত্ব পেলে দল কি নতুন ভোটার আকর্ষণ করতে পারবে এবং জাপান কি তার প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী পাবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।